জানালা খোলা। সন্ধেবেলা আকাশে বেশ কয়েকটা রং খেলা করছে। লাল থেকে গেরুয়া, নীল থেকে বেগুনি থেকে নীলচে কালো। তাতে ফুটে উঠছে হীরের কুচির মতো ছোটো ছোটো তারা। সুমিত্রা জানালার পাশে বসে ছিলো। অনেক ক্ষণ থেকে। ঐ সব আকাশ দেখার মানসিক অবস্থা ওর নেই। রাস্তার আলো জ্বলে উঠতে দায়সারা ধূপ জ্বালালো। তারপর খাবার টেবিলে রাখা একটা মাথা ব্যথার ওষুধ খেলো। এই সব অসম্ভব চাপ গুলো ও নিতে পারে না। মাথা দপদপ করে। ওষুধটা খেয়ে ফুল স্পীডে ফ্যানটা চালিয়ে শুয়ে পড়লো। আজ বিজনের সঙ্গে শপিং মলে গেছিলো।
আশ্চর্য পৃথিবী! পুরুষগুলো এইরকমই হয়। এদের কোনও সিম্প্যাথি নেই। জাস্ট ভালবাসার জন্য ভালবাসা। এরা ভালবাসার মানেই বোঝে না।
সুমিত্রা ওর বান্ধবী,করবীকে,ফোনে ধরলো।
“কিরে সুমিত্রা কেমন আছিস?’
সুমিত্রা চুপ করে রইলো।
“কিরে? চুপ কেন? কীহয়েছে?”
“ভীষণ খারাপ লাগছে। অস্থির করছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি….”
“এমা কেন কী হয়েছে তোর সোনা?”
“করবী তুই এক্ষুণি চলে আয়…”
“কেন রে? কী হয়েছে বলবি তো…”
“বেশী দূর তো নয়। তুই তো ড্রাইভিং পারিস। একটু চলে আয়”
“শোন না… তুই আমাকে বল তোর কী হয়েছে… আমি ঘরে একা আছি, আসলে শ্বশুরমশাই খুব অসুস্থ…”
বিরক্তি বিরক্তি আর বিরক্তি। পৃথিবীর সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সুমিত্রা ফোনটা কেটে দেয়।
সুমিত্রা ষাঠ ছুঁই ছুঁই একজন মহিলা। এক সময়ে অপূর্ব সুন্দরী ছিলো। ননীর পুতুলের মতো। এখন বয়স এসে আলতো হাত বুলিয়ে গেছে শরীরে। মুখের বলীরেখা প্রায় দৃশ্যমান। হাতের গোছ ঢিলে হয়ে গেছে। সৌন্দর্য চর্চার অভ্যেস আছে সেটা চেহারায়-পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত দেখলেই বোঝা যায়। শরীর চর্চার অভ্যেস, সব বাঙালি মেয়েদের মতো, একেবারেই নেই। বড়জোর প্রাণায়াম বা ইয়োগা পর্যন্ত তার দৌড়। সুমিত্রা উঠে চিকেন, জ্যুস, একটু পরিজ আর নানা রকমের ফল খেয়ে শুয়ে পড়লো। হ্যাঁ ওর বিছানাও কাজের লোকেরা করে রাখে। এসিটা একটু বাড়িয়ে দিলো। বিরক্তিতে শরীর তপ্ত হয়ে গেছে। ঘাম হচ্ছে। ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে। রাতের ওষুধগুলো বিছানার পাশে রাখা থাকে। ঘুমের ওষুধটা খেতেই চোখ জুড়ে ঘুম-বড়ো শান্তির ঘুম। জেগে থাকলেই সমস্ত স্বার্থপরতা, সমস্ত নিজস্ব বৃত্তের মানুষগুলো ওকে ইরিটেট করবে।
তখন ভরাভর্তি দুপুর। কাজের মেয়েদুটোই ওদের ঘরে। একটা সম্ভবতঃ টিভি দেখছে আর অন্যটা ঘুমোচ্ছে। সুমিত্রাও শীতল ঘরে একটু গা এলিয়ে একটা রোমান্টিক সিনেমা দেখছে। কী আশ্চর্য! সারা জীবন ধরে এমনি প্রেমিক কেউ জীবনে এলো না। মোটরবাইক চলেছে। হুহু হাওয়ায় পেছনে বসে আছে প্রেমিকা। হাওয়ায় চুল উড়ে যায়। এই পথ যদি না শেষ হয়। প্রেম হতে হবে এমনই। সুমিত্রা অবশ্য বাইকে বসতে ভয় পায়। ওর গাড়ি না হলে চলে না।
টিংটং। কলিং বেল বেজে উঠলো। কাজের মেয়েগুলো এখন উঠবে না। নিশ্চয়ই কোনও সেলসম্যান-একরাশ বিরক্তি নিয়ে সুমিত্রা দরজা খুললো। যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে ওর গোটা শরীরে আগুন জ্বলে উঠলো। উফফফ আবার জ্বালাতে এসেছে। এদের ন্যাকামি দেখলে গা জ্বলে ওঠে।
দরজায় করবী দাঁড়িয়ে। কপালে ঘাম। টিপ ধেবড়ে গেছে। চটি খুলতে খুলতে বললো “কিরে রাস্তা ছাড় ঢুকতে দিবি না, নাকি?”
সুমিত্রা সরে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে ফ্যানটা চালিয়ে বললো “বোস আমি কম্পিউটার অফ করে আসি”
করবী মৃদু হেসে বসলো। ও সুমিত্রাকে চেনে। ওর ইতিহাস জানে। কিছুদিন আগেই ডিভোর্স নিয়েছে। বরের সঙ্গে বনতো না। ছেলে মেয়ে বিদেশে থিতু হয়েছে। ওরা এদেশে থাকুক, সঙ্গে থাকুক এটা সুমিত্রা চায়ও না। রূপম ইসলামের ঐ গানটার মতো। এই একলা ঘর আমার দেশ, একলা থাকার অভ্যেস…এটাই ওর ভালো লাগে, আবার এটাই ওকে কুরেকুরে খাচ্ছে।
করবীর মনে হচ্ছে আজ সুমিত্রার সত্যিকারের সাহায্য লাগবে। ওকে বোঝাতে হবে। শত হলেও ছোটোবেলার প্রাণের বন্ধু। আজ এই বয়সে ওর সত্যিই সাহায্যের প্রয়োজন। ওকে বোঝাতে হবে।
দিন কয়েক পরে। দুজনে একটা ঘরে। দুটো টিউব লাইট। একটা ওয়াল হ্যাঙ্গিং ফ্যান, একটা সিলিং ফ্যান। একটু আধময়লা মেঝে। এক গুচ্ছ ম্যাগাজিন ইতস্ততঃ ছড়ানো।একজন ঝিমন্ত বুড়োটে রিসেপশনিস্ট। সুমিত্রার বিরক্ত লাগছে। করবী এটা কোথায় নিয়ে এলো তাকে? একটা রাস্তার ধারে ছোটো খুপরির মতোন চেম্বার। চারপাশে গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ, প্যাঁ পোঁ, বাইকের ভটভটানি।সুমিত্রা এর আগে কোনদিন এরকম চেম্বারে আসে নি। ও সাধারণতঃ কোনও নামকরা এসি ক্লিনিকে দেখাতে যায়।
আধবুড়ো রিসেপশনিস্ট মুখ তুলে বললো “সুমিত্রা মুখার্জি… স্যর ডাকছেন” বলেই আবার ঝিমোতে লাগলো। করবী একটু গলা খাঁকারি দিলো। বুড়ো চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ঈঙ্গিতে ওকেও ভেতরে যেতে বললো।
ভেতরটা এয়ারকন্ডিশনড। একজন মাঝবয়সী মানুষ। চমৎকার দাড়ি কামানো। একটু দুমড়ে যাওয়া জামা। মুখে মাস্ক। এলোমেলো উড়ুউড়ু চুল। খুব ক্লান্ত বিষণ্ণ চোখদুটো।
“বলুন কী কষ্ট?” ডাক্তার আনমনে সাদা কাগজে দাগ কাটে। হাই পাওয়ারের চশমা নিয়নের আলোয় চকচক করে।
“আমি ভীষণ কষ্টে আছি”
ডাক্তার ওর চোখের দিকে তাকান “কেন?”
“সারা জীবন একা একা কাটাচ্ছি…”
করবী বলে “ডিভোর্স হয়ে গেছে, ছেলে মেয়েরা বাইরে থাকে”
ডাক্তার পেনটি কাগজে ঠুকতে থাকে। “আপনি কে হন?”
“ওর ছোটবেলার বন্ধু”
“আমাকে ম্যাডাম মুখার্জির ছোটবেলাটার কথা যদি একটু বিস্তারিত করে বলেন… কোনও ট্রম্যাটিক হিস্ট্রি… বা কোন চাইল্ডহুড অ্যাবিউজ…. দারিদ্র্য… প্রেমে আঘাত… এনিথিং এ্যান্ড এভরিথিং… খুব ভালো হয়…. চা চলবে?”
করবী ঘাড় নাড়ে। চলবে। সুমিত্রা জানায় ওর কফি ছাড়া চলে না। ডাক্তার হাসেন “স্যরি…”
হাসিটা ভারী মিষ্টি। না বলাটাও এতো সুন্দর, এতো ভদ্রতাসম্মত হয়? সুমিত্রা মুগ্ধ হয়ে যায়। এমন মানুষের কাছেই হৃদয় খোলা যায়। দরদী মানুষ। লজ্জা পায় না। এ তো ওর মনের কথা, গোপন কথা, কেউ তো জানবে না।
করবী চায়ে চুমুক দিয়ে সুমিত্রার জীবনকথা বলতে থাকে।
“খুব বড়লোকের মেয়ে, বাবা ছিলেন বিরাট ব্যবসায়ী, ছোটবেলায় ওর অপ্রাপ্ত কিছুই ছিলো না। কাকু ছিলেন দরাজদিল। অনেক সময় মেয়ের বন্ধুদেরও দামী দামী উপহার দিতেন। সুমিত্রারা দুই বোন। সুমিত্রা দুই বোনের ছোটো। সুমিত্রার বিয়ে হয় প্রেম করে। কলেজে ওকে মোমের পুতুল বলতো সবাই। এতো সুন্দরী ছিলো। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই ওদের দুজনের মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়।”
ডাক্তার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলেন “অন্য কোনও অ্যাফেয়ার?”
করবী চোখ নামায়। “হ্যাঁ। কয়েকটা.. মানে কোনোটাই ঠিক সেভাবে ইয়ে হয়নি”
ও অপ্রস্তুত ভাবে সুমিত্রার দিকে তাকায়। “আসলে সুমিত্রা খুব টাচি-মানে সেন্সেটিভ। ছোটো থেকেই। এই তো সেদিন ওর ইয়ের সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হয়েছিলো।”
সুমিত্রা একটু লাল হয়ে ওঠে। করবীর হাতে চাপ দেয়।
“না ম্যাডাম ওনাকে বলতে দিন। ধরে নিন আপনি একটা কনফেশন করছেন। যেহেতু আপনার নিজের বলাটা ঠিক নিরপেক্ষ হবে না, একটু বায়াসড হবে, আমি পুরোটা জানতে পারবো না। এখানে উনি আপনার হয়ে আপনার পরিচিতি জানাচ্ছেন। ম্যাডাম আপনি বলুন…বলতে থাকুন”
করবী আবার খেই ধরে। “ওর সঙ্গে ঝগড়া করে আমাকে তক্ষুণি ওর কাছে আসতে বলে….আমি পারিনি মানে শ্বশুরমশাই খুব অসুস্থ…. তাতে ওর কী রাগ”
ডাক্তার হাসেন “রাগটা কতোক্ষণ ছিলো?”
করবীও হাসে “এই…. ধরুন ঘন্টাখানেক। তারপর আবার ঠিকঠাক? যেই কে সেই?” করবী চায়ের কাপটা সরিয়ে রাখে।
এরপর সুমিত্রা নিজের কিছু টুকটাক অসুবিধের কথা জানায়। এ’ও বলে ও প্যাম্পার্ড হতে ভালবাসে।
ডাক্তার নিজের জন্য আরেকবার চা ঢালেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন “এটা খুবই কঠিন কেস, সেরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব”
সুমিত্রা বলে “কেন? আগের ডাক্তারবাবু তো বলেছিলেন ডিপ্রেশন….. ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে”
“ডিপ্রেশন হচ্ছে একটা কনসিক্যুয়েন্স, মানে সমস্ত কিছুর ফলাফল বা বলা যায় আ স্মল পার্ট অফ দ্য ডিজিজ প্রসেস। বাই দ্য ওয়ে আপনার মা বাবার কারো কোনও মানসিক রোগ ছিলো?”
সুমিত্রা একটু ইতস্ততঃ করে বলে “আমার মায়ের স্কিৎজোফ্রেনিয়া আছে”
ডাক্তার কলমটা কপালে ঠেকান। “মে বি, মে নট বি। তবে সিজোফ্রেনিয়া অনেকটাই বংশগত, জেনেটিক”
করবী মুখ খোলে “কেন সারবে না? এটা কী রোগ?”
“দেখুন মানসিক রোগ কখনই একটা আলাদা করে আসে না। ডিপ্রেশন থাকলে প্যানিক থাকবে, অ্যাংজাইটিও থাকতে পারে। সোমাটাইজেশন আসে…. ছাড়ুন এসব। প্যাম্পার্ড চাইল্ড সিনড্রোম বলে একটা রোগ আছে। যেটা একটা নিস্পাপ শিশুর মধ্যে তার মা বাবাই নিয়ে আসেন। সে যা চায় তাই পায়। একটা সময়ে দেখা যায় কিছুই তার মনোমতো হচ্ছে না। চাওয়া সীমাহীন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশঃ তারা স্বার্থপর হয়ে ওঠে। কিছু চাইলে যতক্ষণ না সেটা পাচ্ছে ততক্ষণ পাগলের মতো করবে। পেলেই আবার অন্য কিছু খুঁজবে। এটা আসলে সম্পর্ক বা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও হতে পারে। এদের চাওয়া ভীষণ তীব্র হয়। আবার তাকে বা সেটা পেয়ে গেলে তত তাড়াতাড়ি সেটায় বিতৃষ্ণা আসে। মানুষের অন্যের সুবিধে অসুবিধে বোঝার ক্ষমতা কমে আসে। বলা যায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। আসলে সুখ তো ভেতরের একটা ব্যাপার, এটা তো দোকানে পাওয়া যায় না। এখান থেকেই তৈরি হয় বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। অতি সহজেই রোগীর ইমোশনাল আউটবার্ষ্ট হয়। এই মুহূর্তে ভীষণ রাগ হবে। আবার খানিক পরে সেটা সে ভুলে যাবে। সব সময় মনে হবে ও বুঝি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটাকে ইনসিকিওরিটি বলা যায়। সোজা কথায় মাত্রাজ্ঞান জিনিসটা আর থাকবে না। এগুলোর ফলাফল হলো নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। বয়স যতোই বাড়বে রোগী ততই নিজের প্রশংসা শুনতে চাইবে। নিজের সম্বন্ধে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একটা বিরাট কিছু তৈরি করবে। এগুলো না পেয়ে খুব বেশী শূন্যতা তৈরি হলে শারীরিক ব্যথাও হতে পারে। এর সঙ্গেই আসে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার- অতিরিক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, হাত ধোওয়া, কাপড় কাচা এইসব আরকি। এবং চলে আসে সিজয়েড পার্সোনালিটি। মানে আমাকে ঠিক এই সময়ে এই কাজটা করতে হবে, তাকে এই সময়ের মধ্যে আসতে হবে। ……দেখুন এটার উদ্ভব হয় শৈশবে। সাধারণতঃ মা বাবার অতি প্রশ্রয়ে। এর ফল ভোগে রোগী। এটা যেহেতু একটা ডীপ রুটেড অসুখ, তাই কাউন্সেলিং আর নিজের চেষ্টা একজনকে অনেক সুস্থ করতে পারে…” ডাক্তার হাসেন “আমি জানি ম্যাডাম মুখার্জির কথাগুলো পছন্দ হচ্ছে না। আর দরকার আপনার মতো একজনের সঠিক সাহচর্য”
করবী বলে “করবী বিশ্বাস। আমি করবী বিশ্বাস”
সুমিত্রা বিরক্ত হচ্ছিল। পয়সা খরচ করে এতোগুলো বদনাম শুনতে হচ্ছে।
ডাক্তার বলতে থাকেন “এটা এই বিশ্বায়নের যুগে আরও বেড়ে গেছে। চাওয়া পাওয়া সীমা ছাড়িয়েছে। ব্র্যান্ডেড ঘড়ি, গাড়ি, জামা, জুতো…. ক্রমশঃ মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কমছে…. ক্রমশঃ মানুষ একা হচ্ছে…. ছেলেমেয়েদের ডিভোর্স বাড়ছে… ঐ যে একটা গান আছে কেহ কারো মন বোঝে না.. ম্যাডাম বিশ্বাস… আপনি ওনাকে ভালবাসেন.. স্নেহ করেন… ওনাকে ছেড়ে যাবেন না”