মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যজনক বলটি সম্ভবত মহাকর্ষ। নিউটন যখন এই বল ও তার মহাকর্ষের সূত্রগুলো আবিষ্কার করলেন তাদের দিয়ে আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহগুলোর পরিভ্রমণকাল নির্ভুলভাবে গণনা করা গেল। কেবল বুধের কক্ষপথ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ধোঁয়াশা কাটে নি। আইনস্টাইন যখন তার জেনালেল রিলেটিভিটি আবিষ্কার করলেন তখন নিউটনের মহাকর্ষের ধারণাটিকেই চরম আঘাত করলেন। তিনি স্পেসের বদলে স্পেস-টাইম এই ধারণাটিকে নিয়ে এলেন।
তা বলে কিন্তু একেবারেই ভাববেন না যে মহাকর্ষ বল বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই, বা নিউটনের তত্ত্ব ভুল। আজও নাসা যখন ভয়েজার পাঠাচ্ছে মহাকাশে, আমরা পাঠাচ্ছি চন্দ্রযান সব ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি তত্ত্ব দিয়ে নয় মহাকর্ষ বলের অভ্রান্ত গাণিতিক হিসেব মেনেই সেসব স্বনিয়ন্ত্রিত যান মহাজাগতিক ঘড়ির নিখুঁত সময় মেনে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছে বা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে চলেছে।
আগেই বলেছি আইনস্টাইনের মতে মহাকর্ষ হল এই স্পেস-টাইমের নিভাঁজ ফ্যাব্রিকের মধ্যে বিরাট আকারের মহাজাগতিক বস্তুগুলোর চাপে যে বক্রতা সৃষ্টি হচ্ছে সেটাই। এই স্পেস-টাইমের বক্রতা দিয়ে আলোও যখন প্রবাহিত হয় সেটিও বেঁকে যায়। অলৌকিক শোনাচ্ছে তো! কিন্তু সত্যিই তা হয়। একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী সূর্যগ্রহণের সময় আলোর এই বক্রতা প্রমাণ করেই সারা পৃথিবীতে জেনারেল রিলেটিভিটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন।
আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব ত্রিমাত্রিক। তাই সম্ভাবনার খেলা যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে তা দিয়ে জেনারেল রিলেটিভিটিকে পুরোপুরি বোঝা গেল না। সবচেয়ে সমস্যা করল সেই মহাকর্ষ বল। মহাকর্ষ বল খুব খুব দুর্বল। তাই পরমাণুর কেন্দ্রের কণাদের মধ্যেকার খুব সামান্য দূরত্বের মধ্যে সেই বল কার্যকর হয় না। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে যত কণা আছে তাদের মধ্যে মহাকর্ষকে একটি কণা গ্র্যাভিটন হিসেবে ধরে যদি সেই মডেলে রাখা যায় তবে গণনায় ভুলত্রুটি চলে আসে। তাই কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটিকে কিছুতেই জেনারেল রিলেটিভিটির সাথে এক করা যাচ্ছে না।
আইনস্টাইন মনে করতেন এই মহাবিশ্ব নির্দিষ্ট। তার কোনো সঙ্কোচন বা বিস্তার নেই। সৃষ্টির আদিতে যা ছিল এখনও তাই আছে। কিন্তু মহাকর্ষ তো সব কিছুকেই আকর্ষণ করছে। তাই এমন হওয়া উচিত ছিল যে সবকিছুই ক্রমে কাছে চলে আসবে এবং মহাকর্ষের জন্য সবকিছু একটার ওপর একটা হুড়মুড়িয়ে পড়বে। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। তাই তাঁর তত্ত্বকে প্রমাণ করতে একরকম জোড়াতালি দিয়েই বললেন তাহলে এই মহাবিশ্বে নিশ্চই এমন কোনো শক্তি আছে যা মহাকর্ষের বিপরীত দিকে কাজ করছে। দুটি বিপরীতমুখী বলের ক্রিয়ায় আমাদের মহাবিশ্ব সুস্থিত আছে। তিনি সেই মহাকর্ষের বিপরীতমুখী বলটির নাম দিলেন ‘কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট’ বা মহাজাগতিক ধ্রুবক।
এর মধ্যে একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়ে গেল। এডুইন হাবল নামে একজন মহাকাশবিজ্ঞানী যখন টেলিস্কোপ দিয়ে দূরের এক নক্ষত্র দেখছিলেন তিনি দেখলেন তাতে ‘রেড শিফট’ হচ্ছে অর্থাৎ নক্ষত্র থেকে নির্গত আলোক লাল বর্ণালির দিকে সরে যাচ্ছে। লাল বর্ণালির দিকে দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোই সরে যায়। তাই যদি হয় তবে ওই নক্ষত্র তো একই জায়গায় নেই, কাছেও আসছে না- তাহলে নির্ঘাৎ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে এই মহাবিশ্ব তো আইনস্টাইনের কথামতো নির্দিষ্ট নয় উল্টে প্রসারণশীল।
এই পর্যবেক্ষণ একটি অসাধারণ আবিষ্কার ছিল। যা মহাকাশবিজ্ঞানের রূপরেখাই পালটে দিয়েছিল। এর পরেই ধীরে ধীরে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মতবাদ মান্যতা পায়। আজ আমরা সবাই এটা বিশ্বাস করছি যে এক মহাবিস্ফোরণ থেকেই আমাদের এই মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছিল। আজ এই মহাবিশ্বের সমস্ত ভর একদিন কোনো এক সময় একটা মটরদানার মত আকৃতিতে কেন্দ্রীভূত ছিল। বিস্ফোরণের পরে তার থেকেই এই সমগ্র মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। সেই বিস্ফোরণের অভিঘাতে তা ক্রমশ পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখনও যাচ্ছে। অর্থাৎ এই মহাবিশ্ব প্রসারণশীল।
তাহলে আইনস্টাইন যে বলেছিলেন মহাবিশ্ব নির্দিষ্ট, তার কি হল? হাবলের আবিষ্কার যখন হয় আইনস্টাইন তখনও জীবিত। তাই তিনি তার ‘কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট’ বা ‘মহাজাগতিক ধ্রুবকের’ ধারণাকে ‘ব্লান্ডার’ বলে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিলেন।
বিজ্ঞানীরা মনে করলেন বেশ তাই যদি হয় যে এই মহাবিশ্ব বিগ ব্যাং-এর পরে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে তাহলে এতদিন পরে মহাকর্ষের প্রভাবে তার প্রসারণের গতি নিশ্চই আস্তে আস্তে কমে আসার কথা। আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি তো তাই বলে। কিন্তু সারা পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ১৯৯৮ সালে অন্য তিনজন বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণ দেখে চমকে গেলেন। তারা যখন উন্নত টেলিস্কোপ ও উন্নত কম্পিউটার নিয়ে মহাকাশে কিছু সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করছিলেন তারা আবিষ্কার করলেন এই মহাবিশ্বের সব মহাজাগতিক বস্তুরা মোটেই তাদের নিজেদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার গতি কমিয়ে দিচ্ছে না উল্টে তারা ক্রমশ তাদের গতি বাড়িয়ে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
আশ্চর্য এটা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি মহাকর্ষ বলে কিছু নেই? এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক বছর আগে এক বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণ ও ধারণাকে সামনে নিয়ে এলেন। তিনি ভেরা রুবিন। একে মহিলা মহাকাশবিজ্ঞানী তারপর এমন বেয়াড়া মতবাদ। তারা একে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন অবহেলায়। কিন্তু এবার তাকে আবার সামনে নিয়ে এলেন। নতুন করে ভাবতে বসলেন রুবিনের কথা।
বিজ্ঞানীরা বললেন মহাকর্ষ নেই বলে সবকিছু ক্রমশ আরো দ্রুতিতে দূরে সরে যাচ্ছে না উল্টে মহাকর্ষ আছে বলেই তা সম্ভব। তারা বললেন তাহলে এই মহাবিশ্বে এমন কিছু গোপন ভর বা শক্তি আছে যাকে আমরা দেখতে পাই না। যা আমাদের দৃষ্টির বাইরে অথচ তার ভর সাঙ্ঘাতিক। এতই বেশি যে তা সব গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সিদের নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে তীব্র মহাকর্ষ বলে। তারা তাদের নাম দিলেন ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। আজ সবাই মেনে নিয়েছেন সারা মহাবিশ্বের ৬৭% ডার্ক ম্যাটার, ২৮% ডার্ক এনার্জি আর মাত্র ৫% আমাদের চারপাশের সকল পদার্থের জগত। মানে চাঁদ, পৃথিবী, গ্রহ, আমাদের মিল্কি ওয়ে নীহারিকা, অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা, সব নেবুলা সব সবকিছু ওই মাত্র ৫%।
মজার ব্যাপার হল এই বিপুল ভর ও শক্তির মিলিত টান দেখা গেল আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবকের সাথে মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ আইনস্টাইন যাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন তার সেই বাতিল করা ধারণা আবার ফিরে এল। আজ তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত বলতেন, ওটাকে বাতিল করাই আমার সবচেয়ে বড় ‘ব্লান্ডার’ ছিল।
এই পর্যবেক্ষণ এত সুদূরপ্রসারী যে তার জন্য ওই তিন বিজ্ঞানীকে সুইডিশ অ্যাকাডেমি ২০১১ সালের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন। তারা তাদের সম্মাননাপত্রে খুব সুন্দর লিখেছেনঃ ‘আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী? কেউ মনে করেন পৃথিবী একদিন বরফ হয়ে যাবে, কেউ মনে করেন তা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এই তিনজনের আবিষ্কার আমাদের জানিয়েছে আমাদের পৃথিবী একদিন বরফ হয়ে যাবে’।
সত্যিই তো তাই। এই মহাবিশ্বের সবকিছুই যদি প্রচন্ড দ্রুতবেগে একে অপরের থেকে সরে যায় তবে আমাদের সূর্যও একদিন আমাদের থেকে বহু দূরে সরে যাবে। আর আমাদের প্রাণের উৎস দূরে চলে গেলে আমাদের পৃথিবী, একটি পাতলা নীল বিন্দু, তাপমাত্রা কমে কমে ক্রমেই বরফে ঢেকে যাবে।
(চলবে)
দারুণ লেখা। সমৃদ্ধ হলাম স্যার ৷