আলোর গতিবেগ ধ্রুবক ধরলে পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে বস্তুর আপেক্ষিক গতিবেগের যে প্যারাডক্স লক্ষ্য করা যাচ্ছে আইনস্টাইন সেই সমস্যার সমাধান করে ১৯০৫ সালে তার ‘স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ প্রকাশ করলেন। সেখানে তিনি আশ্চর্য কথা বললেন। তিনি বললেন পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে আলোর গতিবেগ একই থাকে। তা কখনও পালটায় না। কিন্তু বস্তুর গতির সাপেক্ষে সময়ের পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ যদি আপনি প্রচন্ড গতিবেগ নিয়ে কোনো মহাকাশযানে পরিভ্রমণ করেন তবে সেই গতির সাপেক্ষে মহাকাশযানের ভেতর আপনার সময় ধীরে চলবে। তাই সময় নির্দিষ্ট নয়। গতির সাথে সাথে তার সঙ্কোচন ও প্রসারণ ঘটে।
প্রচন্ড গতিশীল কোনো মহাকাশযানের ভেতরে বসে থাকলে আপনার ঘড়ি ধীরে চলবে। আপনার সময় প্রলম্বিত হবে। আইনস্টাইন একেই বললেন ‘টাইম ডায়লেশন’। এটা একটা সাঙ্ঘাতিক ধারণা। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা দরকার। তবে সেক্ষেত্রে যে শুধু সময়েরই প্রসারণ হবে তা নয় আপনার মহাকাশযানটিও আকারে ছোট হয়ে যাবে। আপনিও আকারে ছোট হয়ে যাবেন কিন্তু আপনার ভর বেড়ে যাবে। আইনস্টাইনের বিখ্যাত e= mc2 এই সমীকরণ তো সবারই জানা। তাই আপনার গতি প্রচন্ড বেড়ে গেলে যেহেতু e বা শক্তি বেড়ে যাবে তাই c বা আলোর গতিবেগ নির্দিষ্ট হওয়ায় m এর মান বেড়ে যাবে। তাই মহাকাশযানের গতি যত বাড়বে তত আপনি আকারে ছোট হবেন ও আপনার ভর বেড়ে যাবে। অর্থাৎ আপনি রোনাল্ডো থেকে আস্তে আস্তে মারাদোনা হয়ে যাবেন।
কোনো একজন মানুষ যদি ৫০ তলা বাড়ির ছাদ থেকে নিচের দিকে পড়ে যান পড়ার সময় তিনি ভরশূন্য বোধ করবেন। ঠিক যেমন লিফট নীচে নামার সময় আমাদের হালকা লাগে। তিনি যত নীচে পড়বেন তত তার গতিবেগ বেড়ে যাবে। ঠিক মাটি স্পর্শ করার মুহূর্তে তার গতিবেগ সর্বোচ্চ হবে। তাই ৪৯ তলার উচ্চতায় তার যা বেগ ছিল ১ তলার কাছে এলে তা অনেক বেড়ে যাবে। সেই লোকটির হাতে যদি কোনো ঘড়ি থাকে সেই ঘড়ি ৪৯ তলায় থাকার সময় যে গতিতে চলছিল ১ তলায় এসে ধীরে চলবে।
ধরুন ৪৯ তলায় ও ১ তলায় কেউ দাঁড়িয়ে থেকে লোকটির পতন লক্ষ্য করছেন। ৪৯ তলায় যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি পতনশীল লোকটির ঘড়িতে নিজের ঘড়ির সাপেক্ষে যে সময় দেখবেন ১ তলায় যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি কিছুটা কম দেখবেন। কিন্তু এই ‘কম’ এতটাই ‘কম’ যে তা নগন্য। কারণ আমাদের পৃথিবীর মহাকর্ষ বল খুবই কম। তবে বস্তুর গতি যদি খুব বেড়ে যায় তাহলে কিন্তু এই পার্থক্য চোখে পড়ার মত হবে। আমাদের মহাবিশ্বে বিভিন্ন ভরের বস্তু আছে। আমাদের পৃথিবীর থেকে ভারি বস্তু অগণিত আছে। তাই তাদের মহাকর্ষের প্রভাব বেশি হবার দরুন তারা সেই সময়কালকে অনেক বেশি ‘প্রসারিত’ করবে।
এই প্রসঙ্গে একটা খুব আকর্ষণীয় উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আপনারা অনেকেই হয়ত ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইন্টারস্টেলার’ সিনেমাটা দেখেছেন। সেখানে নায়ক জোসেফ কুপার যখন মহাকাশ যাত্রার আগে তার মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন তখন তার ছোট্ট মেয়ে মার্ফি কাঁদতে কাঁদতে তাকে জিজ্ঞাসা করছে যে বাবা কবে ফিরবে? কুপার তখন তাকে দুটো ঘড়ি দেখিয়ে বলছে একটা ঘড়ি সে পরে যাচ্ছে আরেকটা ঘড়ি মার্ফির কাছে থাকবে। সে যখন ফিরে আসবে হতে পারে তার এমন কিছুই বয়স হবে না কিন্তু মার্ফি অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই সে হয়ত এমন সময় ফিরে আসবে যখন তাদের দুজনেরই বয়স সমান হবে।
আর ঘটেছিলও তাই। ফেরার পথে কুপার মহাকাশ যান নিয়ে মিলারস প্ল্যানেট নামে এমন এক গ্রহে অবতরণ করলেন যার তার পাশেই ছিল গারগ্যাঞ্চুয়া নামে এক অতিকায় ‘ব্ল্যাক হোল’। ব্ল্যাক হোলের ভর অসীম আপনারা জানেন। তাই মিলারস প্ল্যানেটের মহাকর্ষও সেই ব্ল্যাক হোলের প্রভাবে অনেক বেশি। সিনেমায় বলা হয়েছে আমাদের পৃথিবীর থেকে ১৩০ গুণ বেশি। তাই সেখানে সময় পৃথিবীর তুলনায় অনেক ধীরে ধীরে চলে। তাই তার দলের লোকেরা যখন মহাকাশ যান থেকে নীচে নামছে তখন কুপার তাদের সাবধান করে দিচ্ছেন, কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। তারা যেন ভুলে না যায় সেই গ্রহে এক ঘন্টা কাটানোর অর্থ পৃথিবীতে ৭ বছর কাটানো।
কুপার যখন ‘পৃথিবীতে’ ফিরে এল তখন দেখা গেল তার বয়স তেমন কিছুই বাড়ে নি কিন্তু তার মেয়ে মার্ফি বৃদ্ধা। মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করছেন। যদিও কুপার পৃথিবীতে ফেরেন নি। পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যাওয়ায় মানুষেরা শনির এক গ্রহে নিজেদের নতুন সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। এ না হয় সিনেমা, বাস্তবে কী এমনটা হয়? হ্যাঁ, বাস্তবে এমনটাই হয়। আমাদের পৃথিবীর চারপাশে যেসব স্যাটেলাইট ঘুরে চলেছে তারা প্রতিনিয়ত আমাদের যে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের জি পি এস কাজ করছে। যেহেতু তারা অনেক ওপরে তাই তাদের ওপর পৃথিবীর মহাকর্ষ বল কম কাজ করছে। সেই কারণে তাদের সময় পৃথিবীর তুলনায় ‘দ্রুত’ চলছে। আবার যেহেতু সেইসব স্যাটেলাইট ঘন্টায় ১৪,০০০ কিমি বেগে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে চলেছে সেই প্রচন্ড গতির জন্য তাদের ঘড়িতে সময় কিছুটা ‘ধীরে’ চলার কথা।
তাই ঘটে। এই দুই সময়ের মোট পার্থক্যে দেখা যায় আমাদের পৃথিবীতে যেমন সময় এক সেকেন্ডে এক সেকেন্ড সেখানে এক সেকেন্ডে এক সেকেন্ডের সামান্য কিছু বেশি। সেই সামান্য সময়ের পার্থক্য বিজ্ঞানীরা হিসেব করে মহাজাগতিক ঘড়িকে বদলে না দিলে আমাদের জি পি এস মোটেই নিখুঁতভাবে কাজ করত না। তা সঠিকভাবে কাজ না করলে আমাদের গাড়ি থেকে শুরু করে এরোপ্লেন সঠিক লক্ষ্যে কিছুতেই পৌঁছতে পারত না।
মার্কিন মহাকাশচারী স্কট কেলি প্রায় ১ বছর ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আই এস এস-এ কাটিয়ে যখন পৃথিবীতে ফিরে আসেন তখন নীল ডিগ্রেস টাইসন ট্যুইট করেনঃ স্কট কেলি, পৃথিবীতে স্বাগত। আমাদের থেকে তোমার বয়স ১/১০০ সেকেন্ড কম বেড়েছে। যেহেতু আই এস এস এর গতি তেমন মারাত্মক কিছু বেশি নয় তাই সেখানে এক বছর কাটানোর অর্থ পৃথিবীতে এক বছরের থেকে ১/১০০ সেকেন্ড কম সময় কাটানো।
সময়ের মহাকর্ষের ও বস্তুর গতির সাপেক্ষে এই যে সঙ্কোচন বা প্রসারণ তা কিন্তু আমাদের ‘টাইম ট্রাভেলের’ ধারনার কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। সিনেমাটার কথাই যদি চিন্তা করি তবে ভেবে দেখুন কুপার কিন্তু প্রচন্ড গতিবেগে মহাকাশযানে করে ‘ভবিষ্যতে’ ফিরে গেছেন তার মেয়ে মার্ফির কাছে যখন সে বৃদ্ধা। অথচ তখন কুপারের বয়স কয়েক মাস বা বছর বেড়েছে মাত্র!
তাহলে আমরা বুঝলাম প্রচন্ড গতিবেগের মহাকাশযান করে যদি আমরা যাত্রা করতে পারি তবে আমরা ভবিষ্যতে ফিরে যেতে পারি। এটা সায়েন্স ফিকশন নয়। সত্যিই সম্ভব। কিন্তু টাইম মেশিনে করে কি আমরা অতীতে ফিরে যেতে পারব? সেটা আদৌ কি সম্ভব? এর উত্তর দেবার আগে একটা কথা আপনাদের কাছে পরিষ্কার করে বলে দিই টাইম মেশিনে না চেপেও আমাদের পক্ষে অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব খুব সহজেই। আমরা প্রতিদিন যাচ্ছিও। সেটা কিভাবে?
ধরুন খালি চোখে আমরা যেসব নক্ষত্রদের দেখছি তাদের অনেকেরই পৃথিবী থেকে দূরত্ব কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ তাদের যে আলো আমাদের চোখে পড়ছে তা নির্গত হয়েছিল কয়েক লক্ষ বছর আগে। হতে পারে এই সময়ের মধ্যে সেই নক্ষত্রটি ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু আমরা খালি চোখেই কয়েক লক্ষ বছর আগের সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। এটা কি টাইম ট্রাভেল নয়?
বিজ্ঞানীরা কি টাইম ট্র্যাভেলে বিশ্বাস করেন? স্টিফেন হকিং মনে করতেন আমাদের পক্ষে টাইম ট্র্যাভেল করা অসম্ভব। যদিও ভবিষ্যতের খুব উন্নত মানব সভ্যতা ভবিষ্যতে ফিরে যেতে পারে কিন্তু অতীতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। গণিত বলে যে আপনি অতীতে ফিরে গেলেও অতীতের ঘটনাকে কখনও পালটাতে পারবেন না। তাই যা হবার তা হবেই। আপনি যেহেতু ভবিষ্যতকে বদলাতে পারবেন না তাই অতীতের দিকে এই টাইম ট্র্যাভেল আমাদের কিছু কিছু প্যারাডক্সের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
ধরুন আপনি অতীতে এমন সময় ফিরে গেলেন যেসময় আপনার ঠাকুরদা অবিবাহিত। আপনি কোনোভাবে আপনার ঠাকুরদাকে খুন করলেন। যেহেতু উনি মারা গেলেন তাই তার সাথে আপনার ঠাকুমার বিয়ে হল না। আপনার বাবা জন্মালেন না। আপনিও পৃথিবীতে জন্মালেন না। অথচ সেই সময় আপনি পৃথিবীতেই কোনো এক সময়ে বেঁচে আছেন কিন্তু ভবিষ্যৎ থেকে হারিয়ে গেছেন। এ কিভাবে সম্ভব? একেই বলা হয় ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’।
আবার ধরুন আপনি টাইম মেশিনে করে এমন সময়ে গেলেন যখন রবীন্দ্রনাথ জন্মান নি। আপনি রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলোকে সব নিজের নামে প্রকাশ করে বিরাট নাম করলেন আবার ভবিষ্যতে ফিরে এলেন। এখন প্রশ্ন হল সেই কবিতাগুলো কে লিখেছেন আপনি না রবি ঠাকুর? একে আমরা বলি ‘বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স’।
আরেকটিও মজার ব্যাপার আছে। ধরুন আপনি অতীতে ফিরে গিয়ে আপনার মাকে প্রেমে আবিষ্ট করে তাকে বিয়ে করলেন এবং আপনাদের সন্তান হল। তাহলে একই সাথে ভবিষ্যতে আপনি সেই সন্তান আবার সেই সন্তানের পিতা। তাই আপনাকে বারবার ভবিষ্যতে ফিরে গিয়ে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হবে। এটা খুব হেঁয়ালির ব্যাপার। একেই বলা হয় ‘প্রিডেস্টিনেশন প্যারাডক্স’।
সেই না হয় প্যারাডক্সের কথা পরে ভাবব, আমরা এখন যে জায়গায় আছি আমাদের পক্ষে কি আদৌ টাইম ট্রাভেল করা সম্ভব? আমাদের পৃথিবী একদিন না একদিন তো বসবাসের পক্ষে অনুপযুক্ত হবেই। আমরা কি তখন অন্য কোনো গ্রহ বা গ্যালাক্সিতে গিয়ে আমাদের সভ্যতা রক্ষা করতে পারব?
(চলবে)