‘সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া’ নামটা কি চেনা চেনা লাগছে?
প্রেমেন্দ্র মিত্র মশাই সেই ১৯৪৬ সালে লিখেছিলেন ঘনাদা সিরিজের দ্বিতীয় গল্প ‘পোকা’। ইহুদি বিজ্ঞানী জ্যাকব রথস্টাইন স্রেফ ইহুদি হবার জন্য লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় উন্মাদ হয়ে গিয়ে ইউরোপ ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছেন। পোকা’ রচনার বছরখানেক আগে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোম পড়েছিল। কিন্তু প্রেমেন্দ্র কপিক্যাট নন, উন্মাদ বিজ্ঞানীকে দিয়ে আরেকটা ম্যানহাটান প্রোজেক্ট বানানোর দিকে হাঁটেননি। রথস্টাইনের প্ল্যান, স্রেফ পোকা ছেড়ে ইউরোপকে শ্মশান করে দেবেন। ঘনাদা নামলেন জীবাণুযুদ্ধে। তিন হাজার টন মরা পোকা আকাশ থেকে লিবিয়ার মরুতে আর কর্সিকার সমুদ্রে ঝরে পড়ল। ঘনাদা কি জ্যাকব রথস্টাইনকে হারাতে পারলেন?
জ্যাকব রথস্টাইন, নাকি ‘সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া’, কার সঙ্গে পাঙা নিচ্ছিলেন ঘনশ্যাম দাস, সে প্রশ্ন আপাতত মুলতুবী রেখে পোকা-প্রসঙ্গে আসি।
সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়ার ডাকনাম মরু পঙ্গপাল। বিরাট দল তৈরি করে আকাশ অন্ধকার করে নেমে আসে এরা, ক্ষেতের পর ক্ষেত খালি করে দেয়। কিন্তু তাদের আরেকটা রূপ হল ঘাসফড়িং; এক অতি ভদ্র শান্ত ‘কিউট’ পোকা, দীঘল পায়ে লাফায়, নির্জনে থাকে। ছন্দে মিললে নাগরিক কবিয়াল লিখতেই পারতেন, “ইচ্ছে হল একধরণের ঘাসের ফড়িং”।
কিন্তু হেড অফিসের বড়বাবুর মতন তারা হঠাৎ খেপে গিয়ে পঙ্গপালে রূপান্তরিত হয়। তাদের ডানা আর মস্তিষ্ক বাড়ে; কলম্বাসের মত তারা বহু দূরে নতুন অঞ্চলে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে সে দেশ ছারখার করে দেয়।
দুটি প্রাণী। একটি সুন্দর, সাজানো গোছানো জীবনযাপন করে। অন্যটি গুণ্ডা। প্রথমটি ঘাসফড়িং, দ্বিতীয়টি পঙ্গপাল।
‘সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া ঘাসফড়িং যখন পঙ্গপাল দশায় রূপান্তরিত হয় তখন তাদের দেহে সেরোটোনিন দ্রুত বেড়ে যায়। তাদের বহু জিনের কাজ পরিবর্তিত হয়। ঘাসফড়িঙের আচরণ ও চেহারা বদলে যায়। কীভাবে এতটা পরিবর্তন হয়? তাদের জিনগুলি বদলে যায় না, তাদের ডিএনএ একই রকম থাকে। কিন্তু জিন থেকে যেভাবে প্রাণীদেহ তৈরি ও পরিচালনার সঙ্কেত ‘পড়া’ হয়, সেই ‘পড়া’-র পদ্ধতিটাই বদলে যায়। ফড়িং-জীবনের নির্দেশ দেওয়া জিনগুলি পঙ্গপাল-জীবন চালানোর নির্দেশ দিতে শুরু করে।
একই জিন, একই জিনোম, তবে একেবারে আলাদা পোকা।
রিচার্ড ডকিন্স, ‘স্বার্থপর জিন’ তত্ত্বের সব চাইতে পরিচিত মুখ। তাঁর দুটো অতি-পরিচিত উদ্ধৃতি—
১) “… তারা আমাদের শরীর এবং মন তৈরি করেছে; … এখন তারা জিন নামে পরিচিত…”
২) “আমরা বাঁচিয়ে রাখার মেশিন—জিন নামে পরিচিত স্বার্থপর অণুকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের অন্ধভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে।”
কিন্তু জিন নিজে কি সত্যি আমাদের শরীর এবং মন তৈরি করে?
কার মন তুমি তৈরি কর হে স্বার্থপর জিন? কিউট ঘাসফড়িঙের নাকি কাফকীয় পঙ্গপালের?
চিত্র পরিচিতি (সবগুলির চিত্রঋণ Wikimedia Commons)
১) ‘পোকা’ প্রচ্ছদ
২) ঘাসফড়িং
৩) পঙ্গপাল
তথ্যসূত্র
১) Dawkins, R. The Selfish Gene. 40 the Edition. Oxford University Press. 2016
২) The selfish gene is a great meme. Too bad it’s so wrong _ Aeon Essays
৩) Werren JH. Selfish genetic elements, genetic conflict, and evolutionary innovation. Proc Natl Acad Sci U S A. 2011;28: 108: Suppl 2:10863-70.