আইনস্টাইন বললেন সময়ও একটা আপেক্ষিক ধারণা। আমাদের গতির সাপেক্ষে সেটা পরিবর্তিত হতে পারে। তার সঙ্কোচন ও প্রসারণ ঘটা সম্ভব। তীব্র মহাকর্ষের প্রভাবে সময়-কালের একসাথে তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে। আপনি সেই সময়-কালের চক্করে পড়ে গিয়ে বিভ্রান্ত, বিমুঢ় হতে পারেন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব জানালো আলো একই সাথে তরঙ্গ ও কণা দুভাবেই থাকতে পারে। কোনো কিছু আপনি দেখছেন তার মানে আপনি কখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না যা সেটি আছে। আবার কোনোকিছু দেখছেন না বলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না সেটি নেই। অমিত সম্ভাবনার এই মহাবিশ্বে আমি আপনি সবাই সম্ভাবনার খেলায় আটকে পড়েছি। স্ট্রিং থিওরির উদ্ভাবকরা বলছেন এই মহাবিশ্বে সবকিছুর মূলে আছে এক সঙ্গীত, যেন একটা মহাজাগতিক সুর- কসমিক মেলোডি। আমাদের সেই সুরটিকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই সুরটিই ‘ঈশ্বর সমীকরণ’ বা ‘থিওরি অফ এভরিথিং’।
তাহলে সেটিকে যদি বিজ্ঞান আবিষ্কার করে তবে কি সেটিই ঈশ্বর? ঈশ্বর কি আদৌ আছেন? কার্ল সাগানকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি কি বিশ্বাস করেন এই মহাবিশ্ব ঈশ্বরের সৃষ্টি? উনি বলেছিলেন, আমি প্রশ্ন করব ঈশ্বরকে তাহলে কে সৃষ্টি করেছেন?
আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টামবাদ, স্ট্রিং থিওরি আমাদের অলীক কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টামবাদ না হয় আমরা কিছু প্রমাণ করেছি। স্ট্রিং থিওরি যদি কোনোদিন প্রমাণিত হয় তবে আমাদের মেনে নিতে হবে প্যারালাল ইউনিভার্স বা মাল্টিভার্সের অস্তিত্বের কথা। মেনে নিতে হবে টেলিপ্যাথি বা টেলিকাইনেসিস অবিজ্ঞান নয়। আরো মেনে নিতে হবে আমাদের চারপাশে কখনও কখনও, আমাদের চেতনায় কদাচ যে অভূতপূর্ব অনুভূতির আবেশ ঘটে তার কিছু না কিছু কারণ থাকলেও থাকতে পারে।
হতেও পারে ঈশ্বর আছেন। তিনি হয়ত আমাদের মতই মানুষ। কিন্তু তিনি ভবিষ্যতের মানুষ। তাঁর জগতের ডায়মেনশন আলাদা। তিনি হয়ত যে জগতে থাকেন তাতে ১০ টি ডায়মেনশন আছে। তাই তিনি আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পারছেন না। কারণ আমরা তিন মাত্রার জগতের লোক। হয়ত তার মহাবিশ্ব আমার ঘরের ভেতরেই আছে। সেই মহাবিশ্বের ‘বাবল্’ আমার বেডরুমেই উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে দেখতে পারছি না। হয়ত এত যোগী, এত সাধু-সন্ত, মহাপুরুষেরা যেসব কথা বলে গেছেন তা মিথ্যে নয়- কখনও কখনও সাধনার তুঙ্গ মুহূর্তে তারা হয়ত সেই দৃষ্টি লাভ করেছেন যে দৃষ্টি দিয়ে তারা সেই ১০ মাত্রার জগতের ধারণা করতে পেরেছেন। সেই জগতের পুরুষ বা নারী তার কাছে এসে চকিতে ধরা দিয়ে গেছে। কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে গেছে। কিংবা তাঁর চেতনায় সেই অনুভূতি এমনভাবে গেঁথে দিয়ে গেছে যে সেই চেতনা তাঁর বেঁচে থাকার তাঁর জীবনের অলঙ্কার হয়ে গেছে। যা থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় আমরা যুগেযুগে উদ্ভাসিত হয়েছি।
তা হয়ত বিজ্ঞান নয়। কারণ তা প্রমাণ করা যায় নি। তা এক দৃষ্টি বা ভিসন সেটা হয়ত কারো কারো থাকে। হতে পারে শ্রীকৃষ্ণের মত অমন অনন্ত পুরুষ এই জগতের নয়। তিনি তাঁর শিষ্য তাঁর সখা অর্জুনকেই তাঁর সেই ‘বিশ্বরূপ’ দেখিয়েছেন কারণ তিনি জানেন হৃদয়ে গভীর বিশ্বাস না থাকলে সেই ডায়মেনশনে পৌঁছানো যায় না। বিশ্বাস ও ভক্তিই সেই সময়কাল ও ডায়মেনশন অতিক্রম করে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলতে পারে অন্য কোনো মহাবিশ্বকে। যিনি লিখছেন, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে/ আমার সুরগুলো পায় চরণ আমি পায় নে তোমারে’ সেই অলৌকিক ব্রাহ্ম মুহূর্তে সেই মহাকবি, ঔপনিষদিক ঋষির চেতনায় বিশ্বাস ও প্রেমের তীব্র ভাবাবেগে এমন কিছু দুলে উঠেছে যেন সেই বোধ বা দৃষ্টির মাধ্যমে তিনি চিরকালীন সেই সত্যটিকে উপলব্ধি করেছেন।
সেটা বিজ্ঞান নয়। সেটা সাহিত্য। সেটা সঙ্গীত। সেই স্ট্রিং বা তারের গান যা এই মহাবিশ্ব ও অন্য বহু বহু মহাবিশ্বকে একই সুরে বেঁধে রেখেছে- সেই ধারনা কোনো এক সময় গুরুদেবকে স্পর্শ করে গেছে। কিংবা সেই চির অনন্ত পুরুষ যিনি হয়ত একই সাথে মহান বিজ্ঞানী আবার অন্যদিকে মহান কবি যিনি তাঁর ডায়মেনশন থেকে আমাদের কবির সাথে ওভাবেই যোগাযোগ করতে চেয়েছেন। সেই উপলব্ধির অন্যপারের মানুষটিকেই হয়ত কবির কাছে তাঁর কাঙ্খিত ঈশ্বর বলে মনে হয়েছে। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নম্রতায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন যে, আমার সঙ্গীত তোমাকে পেলেও আমি তো তোমাকে পাই না হে, অসীম!
আমাদের প্রিয়জনেরা হয়ত মৃত্যুর পরে তেমনই অন্য কোনো মহাবিশ্বে চলে যান। তাই অদৃশ্য হয়ে যান আমাদের থেকে। অথচ তাদের জগত থেকে তারা আমাদের সবসময়ই দেখে চলেছেন। কিংবা আমরা হয়ত এই পৃথিবীরই এক প্যারালাল বা সমান্তরাল অন্য পৃথিবীতে চলে যাই। বা আসা যাওয়া করি। বিজ্ঞান হয়ত খুব বালক, সবে তো তার বয়স পাঁচশ হয়েছে। মাত্র পাঁচশ! যদি আমরা গ্যালিলিওর সময় থেকে বিজ্ঞানের সূচনা ধরে থাকি। আরো কত পথ তার চলার বাকি আছে। আমার তো মনে হয় সে সবে হাঁটতে শিখেছে। এক ‘ঈশ্বর সমীকরণ’ আবিষ্কার হলে তারপর আবার অন্য সমীকরণের দিকে ফিরে তাকাবে বিজ্ঞান। একটা প্রশ্নের উত্তর সবসময়ই হাজারটা অন্য প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। আমাদের দেখার ভঙ্গি বদলে যায়। তাই বিজ্ঞান এখানেই দাঁড়িয়ে যাবে এটা হতে পারে না।
কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর তাঁরা তাদের যা সৃষ্টি করেন তা মূর্ত বা বিমূর্ত, কনস্ট্রাকশন বা ডিকন্সট্রাকশন যাই হোক না কেন তা যদি সৎ হয়, তা যদি প্রকৃতই তার ভাবনার সঠিক প্রকাশ হয় সেই, সৃষ্টির মধ্যে সবসময় অজানার ইঙ্গিত থাকে। শিল্পী নিজেও হয়ত জানেন না কোন অলৌকিক মুহূর্তে তার সাথে সেই চিরন্তনের যোগাযোগ হয়ে গেছে। তিনি হয়ত সেই অন্য মহাবিশ্বের ‘মানুষের’ সংকেতের আজ্ঞাবাহক মাত্র। তার চেতনায় তাঁর চেতনা লীন হয়ে গেছে। ‘ইন্টারস্টেলার’ সিনেমায় যেমন দেখানো হয়েছে প্রেম কখনও কখনও সেই দুই জগতের মধ্যে সেতু হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রেমের তীব্র ঈশীশক্তি যিনি উপলব্ধি করেছেন তিনি জানেন সেই শক্তি একটি দ্বিমুখি তরোয়ালের মত তা যেমন অন্ধকারকে কাটিয়ে দিতে পারে তেমনি অন্ধকারকে ঘনিয়ে আনতেও পারে। প্রেমের তীব্র আবেগে আমরা যেন সেই জগতে পৌঁছে যেতে পারি। তা সে যেমনই প্রেম হোক না কেন। আমরা হয়ত কোনোদিন এইসব আবেগ পরিমাপ করতে পারব। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।
প্রেম ভালোবাসা ক্রোধ ভয় স্নেহ মমতা এদের সবারই হয়ত আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি আছে, আলাদা কোয়ান্টাম নাম্বার আছে। আমরা যেদিন তাদের জানতে পারব সেদিন তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে আমরা অন্য জগতে পৌঁছে যেতে পারব। অর্জুন যে স্বর্গে যাচ্ছেন, আবার মর্ত্যে আসছেন; দেব ঋষি অপ্সরা দৈত্যরা স্বর্গ-মর্ত্যে আসাযাওয়া করছেন তা হয়ত সত্যিই সম্ভব। তারা হয়ত সেই কোয়ান্টাম নাম্বার জানতেন। জানতেন সেই তারের কম্পাঙ্ক। হতেই পারে মহাভারত আমাদের অতীতের নয় ভবিষ্যতের মহাকাব্য।
কেপলার দশ বছর ধরে টাইকো ব্রাহের ও তার নিজের পর্যবেক্ষণ করা গ্রহের গতিপথের ডেটা একসাথে কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। হঠাৎ তার মনে হল আচ্ছা আমি যে ধরছি গ্রহরা সূর্যকে বৃত্তাকার পথে পরিভ্রমণ করছে যদি তা ভুল হয়, যদি তারা উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে? ইউরেকা! সব হিসেব একে একে মিলে গেল। শুধু এই ভুল ভাবনাটাকেই সঠিকভাবে ভাবতে তার দশ বছর সময় লেগেছিল। তাই হতেই পারে আমরাই ভুল প্রশ্ন করছি। মহাভারতের যুদ্ধ অতীতের নয়। ভবিষ্যতের। তার চরিত্ররা তাই অদ্ভূত কথা বলছে। ব্যাসদেব টাইম ট্রাভেলার। তিনি ওটিকে লিখে আবার তাঁর ইউনিভার্সে ফিরে গেছেন।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে’ এই গানটি শুনতে শুনতে হঠাতই আমার এসব মনে হল। মনে এল রিলেটিভিটির কথা, কোয়ান্টাম তত্ত্বের কথা, স্ট্রিং থিওরির কথা। গুরুদেবও আমার মত পরলোকে বিশ্বাস করতেন তাই হয়ত তিনি তাঁর লোক থেকে সেই সকালে ব্রাহ্ম মুহূর্তে আমার সাথে ওই গানটির মাধ্যমে সংযোগ করে আমাকে দিয়ে এই সাত হাজার শব্দের প্রলাপ লিখিয়ে নিলেন। তিনি কেন আমাকে নির্বাচন করলেন? হয়ত করেন নি। হয়ত সম্ভাবনার কোনো এক খেলায় আমি সেই চেতনার জগতে ঢুকে পড়েছি কিংবা আমার সংবেদনের সেন্সরে কোনোভাবে সেই সময়ে তাঁর জগত থেকে পাঠানো কোয়ান্টাম ডেটা আমার মস্তিষ্ক এভাবেই ‘রিড’ করল। এটা যদি অন্য কারোর কাছে যেত তার প্রকাশ হয়ত অন্যরকম হত।
হয়ত আমার লেখা কোনো আটমাত্রার জগতের কোয়ান্টাম সুপার কম্পিউটারে পড়ে উনি এখন মিটিমিটি হাসছেন। আমিও তাই ওনার সাথে সেলফি দেবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।
(শেষ)