আজও ক্রিকেট খেলার গল্প বলা গেল না। অনেক দিন পরে ফোন করছিল এক প্রাক্তন রোগি। বলল, লকডাউন শুরু হবার পর থেকে সেই যে ডাব্লু-এফ-এইচ শুরু হয়েছে – তখন থেকে নিঃশ্বাস ফেলার যো নেই। সকাল সাতটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়, অনেক সময়েই চলে রাত্তির দুটো, এমনকি তিনটে অবধিও।
আমার ধারণা ছিল যারা এই রকম অতি-খাটনির নিয়ে নালিশ করছে, তারা হয়ত কাজের সময় আর অ-কাজের সময় আলাদা করতে পারে না। ফলে সারাক্ষণই তাদের মনে হয় আমরা কাজ করেই চলেছি, করেই চলেছি…
এর ক্ষেত্রে দেখলাম তা নয়। সত্যিই কাজের চাপ খুব বেশি। সত্যিই গত তিন মাসে ওকে প্রায় সাতটা আলাদা প্রজেক্টের কাজ দেওয়া হয়েছে, যেখানে ওর সমবয়সী কোলিগরা পেয়েছে বড়োজোর দুটো, কেউ হয়ত তিনটে। আমার রোগির মতে কাজের বহরও একই, এমন না যে একজন হালকা কাজ পেয়েছে, আর একজন ভারি।
বললাম, “সাতটা প্রজেক্টের কাজ তুমি একটার পরে একটা পেয়ে চলেছ, আর অন্যরা? একটা শেষ করে দু-সপ্তাহ ছুটি কাটাচ্ছে?”
বলল, “না, ডাক্তারবাবু। ওরা শেষ করে উঠতে পারছে না বলে ওদের আরও কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। আর আমি অনেক সময় একটা শেষ হবার আগেই আর একটা পেয়ে যাচ্ছি।”
বললাম, “তাহলে তুমি চটপট কাজ শেষ করছ বলেই পরের কাজটা পাচ্ছ। না করলেই দেখতে পেতে না।”
সে একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “খুব মুখ করে, স্যার।”
এটা একটা সমস্যা অবশ্য। বসের মুখ করা সবার সহ্য হয় না। এবং (এক্ষুনি আমার একদল বন্ধু খাউখাউ করে তেড়ে আসবে) বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সব বস মহিলাদের ওপরেই বেশি চোটপাট করে, কারণ মহিলাদের সহজে দাবড়ানো যায়।
বললাম, “টিমের বাকিরা ছেলে? তুমি একমাত্র মেয়ে?”
দেখলাম মিলে গেল। বাকিরা ছেলে, বস তাদেরও মুখ করে, কিন্তু তাদের অত গায়ে লাগে না। তারাও রাত তিনটে অবধি কাজ করে, কিন্তু তারা ফাইনাল প্রোডাক্টটা দিতে সময় নেয় বেশি। সে হয়ত দিনের বেলা অন্য কিছু করে বলে।
বললাম, “যত তাড়াতাড়ি বসকে কাজ করে দেবে, বস ততই আরও কাজ দেবে। বসকে চটপট কাজ দিয়ে দিয়ে ডিপেন্ডেন্ট করে দিয়েছ। এখন থেকে রাত তিনটে অবধি কাজ করে শেষ করতে হবে না। এবং যদি কাজের তোড়ে রাত তিনটে অবধি কাজ করে শেষও হয়ে যায়, তক্ষুনি পাঠাতে হবে না। মনে রেখো রাত দুটো বা তিনটেয় বস ঘুমোচ্ছে। সাহেব সকাল সাতটায় উঠে আরামসে তোমাকে ফোন করবে। তুমি কাজ শেষ করে ঘুমোতে যাবে ফোন অফ করে। পরদিন সকালে সাড়ে এগারোটায় বসকে মেইল করবে। যাতে বস পুরোটা দেখে দুপুরের আগে কল ব্যাক না করতে পারে।”
খুব মজা পেয়ে হি-হি করে হেসে ফোন নামিয়ে রাখল। জানি না, করার দম থাকবে কি না।
আজ থেকে তেত্রিশ আর পঁয়ত্রিশ বছর আগের দুটো ঘটনা মনে পড়ে গেল।
বছর পঁয়ত্রিশেক আগে বনবিভাগের পার্কস অ্যান্ড গার্ডেনস উইং স্থির করেছিল কলকাতার রাস্তায় অ্যাভিনিউ ট্রি কী কী আছে তার একটা খতিয়ান তৈরি করবে। এবং সে শুধু বড়ো রাস্তার নয়, ছোটো রাস্তা, অলি, গলি, তস্য গলি – সবই হিসেবে আসবে। এতবড়ো কর্মযজ্ঞ কে করবে? বলা বাহুল্য, সরকারী কর্মচারীরা নয় – তখন কলকাতায় যতগুলো এন-জি-ও ছিল সবাইকেই ডাকা হলো একটা মিটিঙে।
লোকবলের দিক থেকে প্রকৃতি সংসদ তখন বড়ো সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। তাই আমরা দেখলাম, যে এক একটা সংস্থা যেখানে ৫০০, ৬০০ মিটার, বড়োজোর কিলোমিটার-খানেক রাস্তার দায়িত্ব পাচ্ছে, সেখানে আমাদের বলা হলো রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের গাছ গুনতে – বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে সাহানগর বার্নিং ঘাট (কেওড়াতলা মহাশ্মশান) অবধি – তিন কিলোমিটার। এবং তখন সবে প্রায় পুরো রাস্তাটার ফুটপাথে বাখারি বা কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘিরে ঘিরে বনদপ্তর প্রচুর গাছ লাগিয়েছে কয়েক মাস হলো।
যে যা-ই হোক, আমরা নেমে পড়লাম কাজে – যে তিন সপ্তাহ সময় আমাদের দেওয়া ছিল, তার মধ্যে সব গাছের নাম ধাম গোত্র – এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তার ইতিহাস (উনিশশো কত সালে কোন সায়েব সখ করে এই গাছ আনিয়েছিলেন, এবং তারপরে কলকাতার কোন কোন রাস্তায় এই দক্ষিণ অ্যামেরিকার গাছ শোভা পেয়েছে – রাসবিহারী অ্যাভিনিউ সহ) পর্যন্ত পাওয়া গেল চ্যাটার্জিদার কল্যাণে। ফলে তিন সপ্তাহ পরে যখন আমরা ম্যাপ নিয়ে গাছের তালিকা নিয়ে গেলাম তখন আমাদের কাজ কমপ্লিট।
আমাদের দলের একজন ছিলেন সরকারি চাকুরে। তিনি বার বার বলছিলেন, “শোনো, সবটা দিও না। অর্ধেক দাও। বলো, শেষ হয়নি।”
আমরা বলেছিলাম, “না, না। তা কেন? সবটা করেছি, সবটাই দেব।”
এবং দিলামও।
মিটিঙে অবাক হয়ে দেখলাম, আর একটা এন-জি-ও-ও পুরো কাজ করেনি। কেউ তাদের বরাদ্দ দূরত্বের অর্ধেক, কেউ আরও কম করে এনেছে। একদল তো একটা রাস্তার ছবি এঁকে তার দু-দিকে ফুটকি দিয়ে গোটা বারো ‘ট্রি’, ‘ট্রি’, ‘ট্রি’, ‘ট্রি’, ‘ট্রি’… লিখে এনেছে।
মিটিঙের শেষে বনদপ্তর বাকিদের বলল, “আপনারা আগামী তিন সপ্তাহে যা কাজ দেওয়া হয়েছে, শেষ করে আনুন…” আর আমাদের বললেন, “এই যে যে রাস্তায় শুধু ‘ট্রি’ লেখা আছে, সেগুলো আপনারা শেষ করে দিন, সেই সঙ্গে আগামী তিন সপ্তাহে সাদার্ন আভিনিউটাও করে দিন।”
আমরা অবাক! সাদার্ন আভিনিউ-তে রাসবিহারীর অন্তত তিন-গুণ গাছ। রাসবিহারী করতে আমাদের গলদঘর্ম অবস্থা হয়েছে। এর পরে সাদার্ন অ্যাভিনিউ?
মিটিঙের শেষে বাইরে এসে আমাদের সরকারি চাকুরে দাদা বলেছিলেন, “দেখেছ, সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য কখনওই সাধুবাদ পাবে না। আরও কাজ পাবে। মনে রেখো – এটাই যে কোনও বস-এর বিশেষত্ব।”
(ক্রমশ)