ডুগডুগি-র বয়স এখন দশ মাস । বনোয়ারীলাল একদিন মুদির দোকানের ঝুলন্ত কাঁটায় ওজন করিয়ে দেখেছিল ওর ওজন মাত্র পাঁচশোগ্রাম।
মুদি দোকানের মন্টু সামন্ত ওকে একটা বিস্কুট দিয়েছিল। বনোয়ারীলাল ডুগডুগিকে কিছু বলেনি তবুও অতটুকু ডুগডুগি চওড়া হাসি হেসে মন্টুদাকে একটা বড় সালাম জানালো। ডুগডুগি বেশ বুদ্ধিমতী।
ডুগডুগির মা নেই। তবে মাসি আছে। তাকে বাড়িতে রেখে এখন বনোয়ারীলাল শুধু ডুগডুগিকে নিয়ে বেরোয়। চুমকি, ডুগডুগির মাসি, সে এখন অন্তঃসত্ত্বা। সে খেলা দেখাতে কষ্ট পায়। কয়েকদিন বাদে তার একটা বাচ্চা হলে তারা এক পরিবারে তিন জন হবে।
অবশ্য বনোয়ারীলালও তো একই পরিবারের সদস্য তাই সব মিলিয়ে চারজন হবে।
সেবার ধূপগুড়ির যুগীপাড়াতে খেলা দেখাতে বেরিয়িছিল বনোয়ারীলাল। মাঝ দুপুরের তীব্র গরমে বটতলাতে জিরোতে জিরোতে তার চোখ জুড়ে এসেছিল ঘুমে । এমন সময়ে গাছের ডাল থেকে ঝুপ করে খসে পড়ে ডুগডুগি। তখন নিতান্তই একটা পাখির মতো প্রকার। বনোয়ারীলাল তাকে পাখির ছানাই ভেবেছিল। কৌতূহল বশতঃ হাতে তুলে দেখল এটা পাখির আয়তনের হলেও প্রাণীটার দুটি হাত দুটি পা আছে। আর আছে একটা গিরগিটির মতো সরু লেজ । দুর্বল হাতে বনোয়ারীলালের বুড়ো আঙুলটা আঁকড়ে ধরে জুলজুল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল ।
উঁচু গাছের ডালের দিকে নজর দিতে চোখে পড়ল একটা বড় ঈগল পাখি একটা বানরকে দু’ পায়ের সুতীক্ষ্ণ নখে বিঁধে আকাশে ভেসে যাচ্ছে। আর্তচিৎকার করছে মা বানরটি। ওর বুক থেকে খসে পড়েছে বাচ্চাটি।
বানরের ভাষা বুঝতে পারে বনোয়ারী। আর বনোয়ারীর ভাষাও বুঝতে পারে চুমকি। মানে সুন্দরী যুবতী চুমকি। ফুলকাটা পুঁতি বসানো জামা প্যান্ট পরে সে ভানুমতীর খেল দেখায়। সে দইওয়ালা সাজে, কনে সাজে, আবার ছোট দারোগা সাজে। এম এল এ, মন্ত্রীও সাজে। বনোয়ারীর বাবা পাটোয়ারীলাল চুমকিকে সব শিখিয়েছিল। তারপর মালোয়ারীতে বুঢ়া পটল তুললে চু্মকি হাত বদল হয়ে তার কাছে আসে । এই চুমকি এখন যুবতী আর সুন্দরী। বনোয়ারীর সাথে গঞ্জে গাঁয়ে ঘাটে আঘাটে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখায়। আর অবসর সময়ে সে মালিকের মাথায় উকুন বেছে দেয় বা তার মাথার কাছে বসে ঝিমোয়।
ডুগডুগি গাছ থেকে ঝুপ করে পড়লে তাকে বুকে আঁকড়ে ধরে চুমকি। মায়ের কোলছাড়া ডুগডুগি সেই থেকে এই মাসির কোলে।
সেদিন ভৈরবকান্ত বটব্যাল এসে হেঁড়ে গলায় বলল, – একজোড়া মাদুলি দে তো বনোয়ারি। শুনেছি তোর চুমকি নাকি ভালো মাদুলি দেয়?
এই খেলাটা বলা যেতে পারে বহুৎ-ই ধোঁকাবাজি। বাপ পাটোয়ারীলাল তাকে শিখিয়েছিল। তোমার যা কিছু চাহিদা মনস্কামনা চুমকির কানে কানে বলবে। ও বেছে বেছে তোমার জন্য একটা সাত ধাতূর তৈরি মাদুলি এনে তোমার হাতে দেবে। সেটাই তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে। দশ বিশ পয়সা দাম দিয়ে বনোয়ারী শিলিগুড়ি বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসে মাদুলির খোগুলো। তারপর তার পেটের ভিতরে গাছগাছড়া ভরে মোম দিয়ে সিল করে দেয় । কারো বৌ সংসারে মন দেয় না। বা কারো ছেলের চাকরি হচ্ছে না। কারো গাভিন গরুটা মরে গেলো আচানক। কারো ঘরে সাপের বাসা। সব সমাধান চুমকির মাদুলিতে ।
মাথাভাভার মধু রায়ের এক সমস্যা সে পঞ্চায়েতের প্রধান হতে চায়। কিন্তু বঙ্কিম বর্মন তো যতদিন জীবিত থাকবে সে কিছুতেই এই কাজে সফল হবে না। তাই তাকে নিকেশ করতে হবে। মধুর চাই চুমকির মাদুলি।
কানে কানে তো কথা হয় চুমকির সাথে তবে বনোয়ারী জানে কি করে? জানে, আসলে চুমকি তো সমস্যা জেনে নিয়ে মালিকের কাছে এসে সাংকেতিক ভাষায় কি সব বলে। তার ভাষা বুঝে মাদুলি তৈরি করে বনোয়ারি। চুমকি হলো কম্পাউন্ডার, আর বনোয়ারিই তো ধন্বন্তরি।
এই দেখ, ভৈরবের সমস্যা বড় জটিল। ধুবধুবির বিলে তার এক লপ্তে দশ বিঘে জমি নিয়ে পাশের গ্রামের বিষ্ণু সরকারের সাথে জেলা কোর্টে মামলা চলছে। খুব তাড়াতাড়ি তার ফয়সালা হবে। সে মামলায় তাকে জিততেই হবে। বনোয়ারি বোঝে সবই ফেরেব্বাজি। তবে লোকে শোনে না। বিধান চায়। আসলে কুকর্মের জন্য মনের বল চায়।
করলা নদীর ঘাটে একদিন চুমকি গলার বেল্ট খুলে পালিয়ে যায়। তখন বনোয়ারী দিবানিদ্রা দিচ্ছিলো। বনোয়ারি খুব উদ্বিগ্ন হয়নি। তার প্রগাঢ় বিশ্বাস বনোয়ারি আর ডুগডুগি ছাড়া কোথাও থাকতে পারবে না সে । আবার খুঁজে পেতে তাকে এনে গলায় শিকল পরিয়ে দেয়। কেন যে পালায়? কিসের টানে? এই বিশ্ব প্রকৃতি কি ডাক দেয়? পাটোয়ারিলাল বলেছিল এরা মানুষের ওপরের জাত দেখবি এরা তোকে ছেড়ে যাবে না।
এক হাট পেরিয়ে আর এক হাটে ভৈরব এসে হাজির। বেহেড মাতাল পা টলছে বমি করছে আর মুখে রাজ্যের খিস্তি। চুমকির মা তুলে গালাগাল দিচ্ছে। চুমকি কিছু শুনছে না। চুমকির কোলে পিঠে ডুগডুগি খেলা করছে বা সে কখনও বনোয়ারির কাঁধে পা ছড়িয়ে বসে আছে।
– এই শালা বনোয়ারি তোর চুমকি শালি কি মাদুলি দিল রে? জজ বললে, ‘এ জমি তোর না। এর সব দলিল জাল’, শালি চুমকি। তোকে মেরে ফেলব।
চুমকি নির্লিপ্ত ভাবে বনোয়ারির চুল টেনে যাচ্ছিল। খিস্তিখেউড় শুনে মুখ খিঁচিয়ে একবার ভৈরভকে দেখল।
– চল চুমকি, ডুগডুগি, পালাই। এ বাবু নাশিলী হ্যায়।
আর যাবে কোথায়। ভৈরব চুমকির নেজ ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিল।
মওকা বুঝে চুমকি ঝাঁপিয়ে পড়ল ভৈরবের ওপর। আঁচড়ে কামড়ে নাজেহাল করে দিল তাকে। সে পালানোর পথ পায় না।
তবে সে ঘটনার জল গড়িয়েছিল অনেক দূর । বনোয়ারিকে থানার কোতয়াল ডেকে নিয়ে যায় পরদিন। সে দেখে সারা মুখে ব্যান্ডেজ বেঁধে ভৈরব বসে আছে সেখানে । মুখ ফুলে ঢোল। রক্তে ব্যান্ডেজ ভিজে আছে।
– এই বনোয়ারিলাল, তু কিয়া ইয়ে সব?
– না বাবু, হামনে কুছ নেহি কিয়া।
– তব কোন কিয়া?
– ইয়ে আনপড় জানবর বাবু, না বুঝকে না সমজকে গলতি কর দিয়া।
– তেরা পালা হুয়া জানোয়ার, ইয়ে ক্যায়সে কিয়া?
– উও থোড়া ঘাভড়াহাট হো কে এ্যায়সা কিয়া।
– কিঁউ?
– ও তো বাবু, বাচ্চা হোনেবালি হ্যায়। আপনা বাচ্চা কো রোখনকে লিয়া এ্যায়সা কিয়া।
– কিতনা বাচ্চা হোগা, পিঠমে একটো হ্যায়?
– ও তো বাবু ডুগডুগি। অনাথ পালতু বাচ্চা হ্যায়। উসকি আপনা বাচ্চা নেহি।
– ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। তেরে দোনো কা সুঁইয়া লাগানা হোগা। পালতু হুয়া কুত্তাকো যো লাগাতা হ্যায় না।
– হাম তো গিয়া থা বাবু, জানবার বালা হাসপাতাল মে। বোলা, ‘ভাগ হিঁয়াসে, কুত্তাকে লিয়ে নেহি মিলতা, তো তেরে বান্দরিকি? ভাগ। ‘
– ঠিক আছে, তুই যা।
বনোয়ারি বেরিয়ে যেতেই চেয়েছিল কিন্তু চুমকি টেনে হিঁচড়ে তাকে ভৈরবের কাছে নিয়ে গেল। ভৈরব ভয়ে আঁৎকে উঠে আরো পিছিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু চুমকি যেমন অভিনয় করে, যদি বলা হয় ‘দিখাও চুমকি, বেটি শ্বশুরাল যা রহা হ্যায়’, দিখাও, ঠিক তেমনি অভিনয়ের মতো করে চুমকি তার নরম স্নেহের হাত ভৈরবের মাথা, ঘাড় আর পিঠে বোলাতে লাগল। মনে হল তার চোখে জলের বিন্দু।
– বড়া দুখ পায়া মেরা চুমকি বেটি। চল, কিসিকো দুখ মত দে না।
বিহ্বল হয়ে গেছিল ভৈরব বটব্যাল আর ছোটবাবু কিরণ সরকার।
– যা,যা। বড়া পেয়ারি জানবর হ্যায় তেরা!
চুমকিকে নিয়ে সে আর এখন বাইরে বেরোয় না। ডুগডুগি এখন তার সঙ্গী। বাড়িতে চুমকি একা ঘরে থাকে। তাকে দানাপানি দিয়ে আসতে হয়। ডুগডুগি খেলা শেখে আবার খেলা দেখায় । যারা এতোদিন চুমকিকে দেখে অভ্যস্ত ছিল তারা ডুগডুগির মতো ছোট্ট জানোয়ারের খেলা দেখে। তার চোখ মুখ দেখে মজা পায়। তাকে বনোয়ারিলাল মজার ছলে মাঝে মাঝে পকেটে পুরে রাখে।
এক ঘোর অমাবস্যার বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যাবেলায় চুমকি একটা বাচ্চার জন্ম দেয়। বাজার থেকে ফিরে বনোয়ারি দেখে গভীর মনোযোগে চুমকি একটা একরত্তি বাচ্চাকে সামলাচ্ছে। আর নবাগতকে নিয়ে ডুগডুগির আনন্দের শেষ নেই। সে চাইছে তাকে কোলে নিতে। চুমকি দিতে চাইছে না।
এভাবেই আঁধারঘন রাতে বনোয়ারির কৃষ্ণ লাভ হলো। নাম রাখল কানু।
ইদানিং বনোয়ারিলালের আয় অনেকটা কমে গেছে আর খরচটা একটু বেড়ে গেছে। ছোট বাচ্চা কানু খুবই দুর্বল। তাকে মানুষ করতে বনোয়ারীকে দুধের ডিব্বা কিনতে হচ্ছে। ডুগডুগি এখনও অভিনয় ভালো শেখেনি। বনোয়ারির নিজের একটু নেশা ভাঙ আছে। সব মিলিয়ে কঠিন অবস্থা।
মন খারাপ করে টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়ায় এখানে ওখানে।
বিশ্বজিৎ বাবুর তামাক পাতার গুদামে একদিন কাজের ধান্দায় গেল। কন্ঠিধারী দয়ালু মানুষ। চত্বরের একমাত্র বড় বাঙালি ব্যবসাদার। বছরে লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার।
– কি করবি বল, কাল থেকে চলে আয়। ভোটপট্টির ক্ষেতে তামাক পাতা কাটা হচ্ছে, লেগে পড়। কচি দুটো বাচ্চা নিয়ে সংসার। কেষ্টর জীব। হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ!
বনোয়ারীলাল হনুমানজিকে খুব করে নমস্কার করল। যাহোক কিছু কাজ তো জুটে গেল।
দেখতে দেখতে দুটো মাস পেরিয়েও গেল তামাক পাতার ক্ষেতে কাজ করতে করতে। দিনের শেষে বাবুর গদিতে গেলে নগদ মজুরি দিয়ে দেয়। ভালোমন্দ কথা বলে। বাজার ঘাটের খবর নেয়। চুমকি, ডুগডুগি ও কানুর কথা জিজ্ঞেস করে। মাঝে মাঝে গোডাউনে পড়ে থাকা দু চার কেজি ভাঙা চাল গমও দিয়ে দেয় পোষ্যদের জন্য।
সপ্তাহে সাতদিন তার কাজ। পুরুষ্ট পাতা কেটে একজায়গায় জড়ো করা, শুকনো করা, জাঁক দেয়া, গাঁঠরি বাঁধা, সব কাজ সে করে । বাবু খুব কাজের লোক, কঠোর বৈষ্ণব এবং নিরামিষ ভোজী। ভক্তিমন্ত মানুষ। সন্ধ্যের দিকে তার গদিতে কিছু গুণী মানুষ আসে। কেউ স্কুলের হেডমাস্টার তো কেউ কোর্টে কাজ করা মুহুরী কেউ ক্লাব ফুটবলের রেফারি। বাজারে চেম্বার করা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, জেলা কোর্টের উকিল। চা বিস্কুট খায় আর কত কথা আলোচনা হয়।
– বনোয়ারি, যা তো বাবা একটু চা নিয়ে আয়, ভিতর থেকে।
গদিঘরের সাথে লাগোয়া একতলা পাঁচিল ঘেরা বাড়ি, অনেকটা জায়গা জুড়ে। আঙিনা ঘিরে অনেকগুলো ঘর। ভিতরে গুদাম আছে, কলতলা আছে, একটা পুরোনো ধানের গোলা আছে। হাটখোলার লাগোয়া জায়গা কিন্তু
নিরিবিলি । দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা রাধা কেষ্টর মন্দির আছে।
কাজের মেয়ে হাতে কেটলি কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
– তোমার বাচ্চাদের কি খবর গো বনোয়ারি?
এরা সবাই চেনে তাকে। খুব ছোটবেলা থেকে কাঁধে বানর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর নাচ আর নানা খেলা দেখায়।
– ছোটা বাচ্চা হ্যায়, চুমকিই সব সামালতা হ্যায়। আমি ওদের রান্না করে দিয়ে আসি। কেলা ছোলে খিরা আমরুত জল সব দিয়ে আসি। কাণুকে লিয়ে ভি ভৈঁসকি দুধভি উবালকে রাখ দেতি হ্যায়। ও বহুৎ দুবলা হ্যায়। বহেনজি।
– ঠিক আছে চা নিয়ে যাও । পরে আবার শুনবো।
গদিঘর এখন জমজমাট। আগামী শীতে রাসখোলার মাঠে যে বাৎসরিক মেলা বসবে তার মিটিং চলছে।
বিশ্বজিৎ বাবু সেই মেলার মাথা। গতবারও ছিলেন এ বারও তিনি সভাপতি।
– এ্যাই বনোয়ারি দে সবাইকে চা দে।
– হ্যাঁ বাবু।
গোঁসাইমারির বিষ্টুপদ বর্মন বললে, – দাদা, এবার কিন্তু খুব বড় মেলা হবে। যাত্রাপালা, ভাটিয়ালি, বাউল নাগরদোলা সব থাকবে।
– কেন লটারি খেলা, জুয়ার চাকা থাকবে না ? রাজগ্রামের বিনয় অধিকারী জিজ্ঞেস করল।
জেলা কোর্টের উকিল গোকুল গোস্বামী সামলান মেলার টাকা পয়সার দিক। তিনি বললেন, – প্রায় সবই থাকবে। তবে কিছু জিনিস থাকবে না। কি কি থাকবে না বলছি।
– আচ্ছা উকিল মশাই আপনি বলুন। বিশ্বজিৎ বাবু গোকুলকে বলতে বললেন।
– থানা তিনটি জিনিসের পারমিশন দেবে না বলেছে । আমি তবুও আবার অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেছি । তারা বলছে এই গুলো রাখা বেআইনি।
– কি কি বলুন, সাহেব?
– জনতা সার্কাসের মালিকের নামে চিঠি গেছে তারা আর জন্তু জানোয়ার হাতি ঘোড়া বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা দেখাতে পারবে না। এটা জন্তুদের প্রতি টর্চার মানে পীড়নমূলক কাজ। তাই সার্কাস যদি আসে তবে জীবজন্তু ছাড়া।
– সে কি হয়? ছোটরা কি মজা পাবে এই সার্কাস দেখে? তারা তো বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়া ভালুক জলহস্তি ময়াল সাপ স্বচক্ষে দেখে এই সার্কাসে। জীব জন্তু দেখে শিক্ষা নেয়।
– কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অর্ডার। অন্য রকম কিছু ঘটলে অনেক টাকা ফাইন আর জেলও হতে পারে।
– এতো বড় মুুস্কিলের কথা গো। আর কি বারণ আছে?
– জুয়ার চাকা চলবে না।
– সে তো ভালো কথা। তবে কিনা পুলিশ তো তাদেরকে মেলার বাইরে জায়গা করে দেয়।
– সে তারা যা করে করুক, আমরা ওর মধ্যে নেই।
চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে অঙ্কের মাষ্টার পরিতোষ সিনহা বললেন, – তা যাই বলেন উকিল সাহেব, আমাদের সময় ছিল অন্য রকম। মেলায় একটু তেলে ভাজা বেগুনি, পেঁয়াজি হবে একটু জুয়া লটারি চাকা ঘুরবে, তবে না মেলা!
– সে যা বলেছেন , আমিও লুকিয়ে কত খেলেছি। আর সব বারই হেরেছি। কানের পাশ দিয়ে দানটা চলে যায়।
– আমি একটা লাইফবয় সাবান পেয়েছিলাম একবার।
কথা আরো হলো। আরও একবার চা এলো। মেলা কমিটির মাতব্বররা উঠব উঠব করছে। এমন সময় বনোয়ারি খুব বিনত হয়ে হাতজোড় করে বলল, – বাবু আমার কি হবে?
– কেন তোর আবার কি হলো, তোর কি সমস্যা?
বনোয়ারিকে বোধ হয় চিনতে পারেননি উকিলবাবু। কিম্বা তার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল নন ।
বিশ্বজিৎ \বাবুও তার সমস্যা জানতে চাইলেন। – তোর আবার কি হল?
তারপর নিজেই বললেন, -ওকে চিনতে পারেন নি উকিল সাহের ও বনোয়ারি, পাটোয়ারিলাল পরসাদের ছেলে। ওর বাবা বাঁদর খেলা দেখাতো?
– ও! আচ্ছা। আমরা ওর বাবার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতাম। তা তুই কি করিস?
– বাবু, তিনঠো বাচ্চা।
– মানে?
বিশ্বজিৎ বাবু বললেন, – ঠিক করে বল, তিনটে নয় দুটো বাচ্চা আর একটা বাচ্চার মা।
– চুমকি ভি বাচ্চি হ্যায় বাবু!
বিস্মিত হলেন উকিলবাবু, – তিনটে ছেলে মেয়ে, খাওয়াবে কি করে?
– গরীব আদমি বাবু!
– তা বিবিকে অপারেশন করিয়ে নিসনি কেন? ঠিক আছে এবার করিয়ে নিবি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ক্যাম্প হবে শীতে।
এবার বিশ্বজিৎ বাবু ব্যাপারটা নিয়ে উকিলকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। অতিথিরা এক দুজন বেরিয়েও গেছেন। তাদেরকে দরজা অবধি এগিয়ে বিদায় দিয়ে এসে বললেন, – এই বনোয়ারি এখনও বিয়ে থা করেনি গো। ও যাদের কথা সবগুলো তার পোষ্য। একটি বড় তার নাম চুমকি আর একটা মাঝারি তার নাম ডুগডুগি। ঠিক বললাম তো বনোয়ারি।
– হ্যাঁ জি বাবু, আর ছোটা যো হ্যায়, উসকা নাম হ্যায় কানহা মতলব কানু, বেটা । চুমকি জনম দিয়া।
– ও, তাই বল। তা এরা তো সব বনের প্রাণী। এ তো আইন সিদ্ধ নয়।
– ও তো হাম জানতা নেহি বাবু। মেরা বাবুজি যব গুজর গিয়া তব বোলা, বেটে এ চুমকি মেরা বেটি য্যায়সা। তু উসকি পালো। ঠিক সে রাখনা। তো উস টাইম সে চুমকি মেরে সাত হ্যায়। মেরে বেটি অউর বহেন য়্যায়সি হ্যায়।
– আর দুসরা কোতথেকে এলো ?
– বাবু উও ডুগডুগি হ্যায়। এক বড়া পচ্ছি উসকি মাকো লে গিয়া। পেড় সে গিরা। চুমকি উসকি বচায়া।
– বাবা! এতো বড় সমস্যা। দুই মেয়ে এক ছেলে। মহা মুশকিল। সবই তো ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল। বাড়িতে পোষা বারন।
বনোয়ারি যে নতুন একধরনের মুশকিলে পড়ছে সে সেটা আঁচ করতে পারল । ওপরের সরকার যখন নিদান দেয় সে কি নীচের সরকার অমান্য করতে পারে ।
– ঠিক আছে তুই বাড়ি যা। আমি পরে তোকে বলব, কি করতে হবে।
সবাইকে বিদায় দিয়ে যখন বাবু একা হলো। তখন হাতে দুটো টাকা হাতে দিয়ে বলল, – যা বাচ্চাদের জন্য বাদাম কিনে নিয়ে যা।
তার একটা আধভাঙ্গা সাইকেল আছে। সেটা চালিয়ে সে যখন বাড়িতে এল তখন একটু রাত হয়েছে। জন মানবহীন একটেরে পল্লী প্রান্তে একটা কাঠের কুটির। মাথায় টিনের চাল। চালের ওপরে ঝুলে থাকা বড় একটা শিরীষ গাছ। ভিতরে টিমটিমে একটা বাল্বের আলো জ্বলছে। বিদ্যূতের লাইনটা তার বাবা করে দিয়ে গিয়েছিল। এই ঘরদোর \ও সেই বানিয়েছিল। একটা আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ওরা ঘরে থাকে যদি সাপ বেজি বিছে এসব কিছু ঢুকে পড়ে।
সাইকেল রেখে একবার বেল বাজিয়ে গলা তুলে বলল, -কাঁহা গিয়া সব?
তারা ভিতরে কিচির মিচির করতে লাগল। দরজার গায়ে ভিতর থেকে ধাক্কা মারতে শুরু করলো।
বনোয়ারি আগল খুলে ভিতরে ঢুকলে চুমকি ও ডুগডুগি ঝাঁপিয়ে তার গায়ে চড়ে বসল। ছোট্ট কানু ডুগডুগির লেজ আঁকড়ে বনোয়ারির কাঁধে উঠল। তাদের আওয়াজে আচরণে মনে হল তারা যেন বলছে, ‘আমাদের ছেড়ে তুমি কেথায় ছিলে সারাদিন’? হাতে খাবারের পুঁটলিটার দিকেও কারো মনোযোগ নেই।
– নাও, বাবু তোমাদের জন্য দিয়েছে খাও।
চুমকি প্যাকেটটি খুলে চিনাবাদামের ঠোঙা খুলে খোসা ভেঙে নিজে খেয়ে ডুগডুগিকে দিল। কানু এখনও শক্ত খাবার খেতে শেখেনি।
বনোয়ারি তাদের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল। অলক্ষ্যে তার চোখ সজল হয়ে এল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– তোরা কবে বড় হবি ?
তারা কবে বড় হবে সেই প্রশ্নের জবাব তারা দিল না বা দিতে পারল না তবে বনোয়ারি যখন কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে ভাত বসাল তখন নাবালক তিনটি প্রাণী গভীর আগ্রহে এবং উৎসুক নয়নে রান্নার জায়গাটার পাশে বসে এটা ওটা নেড়ে অপ্রয়োজনীয় কিছু বাসন কোসন এগিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে খুনসুটি করতে লাগল। একদম ছোটটি কখনই ডুগডুগির থেকে দূরে যেতে চায় না।
খাওয়ার পর মনে খচখচানি নিয়ে সারা দিনের জমে থাকা ক্লান্তিতে ছেঁড়া মাদুর পেতে তিন পোষ্য সমেত গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় বনোয়ারিলাল।
ব্যাপারটা নিয়ে তেমন আর উচ্চবাচ্য হয় না। হওয়ার মতো তেমন বিষয়ও নয় অবশ্য। দিন গড়িয়ে মাস চলে যায়। কানু ডুগডুগি বড় হয়, চুমকি আরো পরিনত হয়। এখনও বনোয়ারি বিশ্বজিৎ বাবুর তামাক চাষে দিন মজুরের কাজ করে। মাঝে মাঝে তিনটে প্রাণী নিয়ে বাইরের আলো বাতাসে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। মানুষের সংস্পর্শে এসে তাদের নিত্য নৈমিত্যিক কাজ করতে হবে খেলা দেখাতে হবে অভিনয় করতে হবে।
যে মেলার মাঠে সার্কাস নিয়ে বিতর্কের শুরু সেই মাঠে মেলা একদিন শুরু হলো। মেলার প্রান্তে আকাশ ছোঁয়া প্যান্ডেল পড়লো। লোক লস্কর এল। আলাদা তাঁবু পড়ল খেলোয়াড়দের। জীবজন্তুর খোঁয়াড় তৈরি হলো। শুরু হলো মেলায় সার্কাস শো।
কয়েকটি শো হওয়ার পর লোকজনের ঢল নেমে গেল। জনগণের আবদারে কর্তৃপক্ষ লুকিয়ে তাদের জীবজন্তুগুলোকে নিয়ে খেলা দেখাতে লাগল । লোকমুখে সে খবরও প্রচার হলো। মেলা কমিটি কেউ কিছু প্রতিবাদ করল না। এভাবেই চলল কিছুদিন। মেলা রমরম করে চলল। শেষের দিকে এসে গোল বাধল। বেলা শেষে মেলার প্রান্তে গাছের নীচে বসে বনোয়ারি তার পরিবার নিয়ে খেলা দেখাচ্ছিল। চুমকির সাথে ডুগডুগি। কখনও চুমকি একা।
বনোয়ারির কানে এল হৈ হৈ শব্দ। সার্কাসের দিকটায় একদল তরুণ ছেলে মেয়ে আর কয়েকজন পুলিশ এসে প্রায় দখল নিয়েছে সার্কাসের গেট। যারা খেলা দেখছিল তারা অন্য খেলার দিকে মনোযোগ দিল। ছুটে চলে গেল সার্কাসের তাঁবুর দিকে। বনোয়ারিও চললো তিনটেকে কোলে পিঠে করে। কিছুটা গিয়ে কি মনে করে একটা ঝোলার ভিতরে সব কটাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঢুকিয়ে নিল।
গেটের মুখে বিশ্বজিৎ বাবুর সাথে দেখা। পুলিশ তাকে ও উকিল বাবুকে মেলা কমিটির পক্ষ থেকে ডেকেছে।
পুলিশ বিশ্বজিৎ বাবুকে জিজ্ঞেস করল, – আপনারা কি পারমিশন দিয়েছেন ওদের জীবজন্তুর খেলা দেখাতে? এই পশুপ্রেমী দলটি থানায় কমপ্লেন করেছে।
– দেখুন আমরা সেটা দিতে পারি না কারণ আমি এই সরকারি নির্দেশনামা জানি। আমার কোর্ট পেপারে এগ্রিমেন্ট আছে। এই দেখুন।
উকিল সাহেব পেপারটা এগিয়ে দিলেন।
– আমরা দেখেছি গত কালও বাঘ,হাতি ঘোড়া জলহস্তির খেলা হয়েছে। এটা নিয়ম বহির্ভূত। জীবজন্তুর প্রতি ক্রিমিনাল এ্যাক্ট।
তরুণ দলের সদস্য পশু প্রেমী একজন এগিয়ে এল।
– এটা খুব খারাপ কাজ। আমরা কখনও এর পারমিশন দিইনি এবং কখনও দেব না।
এতক্ষণে সার্কাস দলের একজনকে প্রতিনিধি হিসাবে পাওয়া গেল। সে এসে হাতজোড় করে বলল, – আমায় ক্ষমা করবেন। আমি মিথ্যে কথা বলব না। এই জন্তুগুলোকে টানা একটা বছর খাইয়ে পরিয়ে টেনে বেড়িয়েছি। খরচ খরচা তো কম না। তাই কদিন পয়সা উসুল করার জন্য ওদের খেলা দেখিয়েছি।
– যেটা নিয়ম সেটা তো মানতে হবে।
– আমরা এযাবৎ কাল খেলা দেখিয়েছি। নিয়ম হয়েছে শুনেছি কিন্তু এই পশুগুলোকে নিয়ে আমরা এখন কি করব?
– এদেরকে জঙ্গলে ছাড়তে হবে। ওরা সেখানে স্বাধীন থাকবে।
– ওদের কি সে ক্ষমতা আছে বাবু,না খেতে পেয়ে সেখানে মরে যাবে।
পুলিশ অত কথা শুনতে চায় না। – আমাদের অফিসে কমপ্লেন পড়লে এ্যাকশান নেব। কোন রকম বন্য জীবজন্তু পশু পাখি সাপ পোষা এবং খেলা দেখান নিষেধ।
বনোয়ারি বুঝল তীরটা তার দিকেও আসবে। সে ঝোলার ভিতরে হাত দিয়ে বাচ্চা কটাকে সামলাতে ব্যস্ত হল। সুযোগ পেলেই যেন পিছু হটতে পারে । গলার গামছাটা টেনে মুখটা ডেকে নিল। মনোযোগ দিয়ে কুটকচালি শোনার চেষ্টা করল।
মাথায় ওড়না ঢাকা একজন পরিবেশ কর্মী তরুণী অনেকক্ষণ আড়চোখে লক্ষ্য করছিল বনোয়ারিকে। সে গলা তুলে বলল, – একটু আগে আমি দেখেছি গাছ তলাতে গলায় লোহার চেন পরিয়ে একজন লোক বাঁদর খেলা দেখাচ্ছে। এটা অন্যায়, পশুপাখির প্রতি নৃশংস ব্যবহার। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। আমরা তার এগেনস্টে কমপ্লেন করব।
বিশ্বজিৎ বাবু ভালোমানুষ হলেও তিনি ধুরন্ধর। বাংলার এই প্রত্যন্ত জেলার মহকুমা শহরে নিজের দাপটে মারোয়াড়ী সমাজের ব্যবসায়ীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং জনপ্রিয় লোক।
ব্যাপারটার মধ্যে বনোয়ারি ঢুকে পড়ছে বুঝতে পেরে ঘটনা স্রোত অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য বলল, – মা, এই সব হাতি ঘোড়া বাঘ ভালুক দেখে বাচ্চারা শেখে কোনটা কেমন দেখতে। হাতে কলমে কিছু শিক্ষা হয়। সার্কাস তো শুধু মজার নয় শেখারও ব্যাপার।
– কিন্তু কাকু, সেটা তো মানুষের দিকের ভাবনা। পশুরা যে এই জেলখানায় বন্দী থেকে কষ্ট পায় সেটা তো দেখতে হবে!
– সে তো ঠিকই, মা।
বনোয়ারিকে হাতের ও চোখের ইশারায় তিনি সরে যেতে বললেন।
সে ও বুঝতে পারল আপাততঃ এই স্থান পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। সামনে পেলে এরা কূটকচালি করতেই থাকবে।
কুন্ডলী পাকানো তিনটি প্রাণীকে হাতের ছোঁয়ায় আশ্বস্ত করে সে একপা দু’পা করে পিছু হঠতে থাকল। বিশ্বজিৎবাবু আড়চোখে দেখছে আর ইশারা করছে চত্বর পেরিয়ে যেতে।
আধভাঙ্গা সাইকেলটা গাছতলাতে রাখা ছিল।সেটা নিয়ে চুমকি আর ডুগডুগিকে বসিয়ে নিল কাঁধে। বড় বুকপকেটে কানুকে ঢুকিয়ে নিল। তারপর ওড়নায় মুখ ঢেকে ত্রস্ত পায়ে প্যাডল করতে লাগল ঘরের উদ্দেশ্যে। গঞ্জের সীমান্তে তার ঘর। ঝুঁজকো আঁধারে জোনাকিরা ইতস্ততঃ উড়ে বেড়াচ্ছে। ডুগডুগি আর কানু লাফ দিয়ে নেমে জোনাকি ধরার খেলায় মেতে গেল। বেড়ার পাশে মোটা জবা গাছটার ডালে তারা হুটোপুটি করতে ব্যস্ত।
চুমকি একলাফে একচিলতে বারান্দায় উঠে গিয়ে অপেক্ষায় রইল কখন আগল খোলা হয়। ভিতরে গিয়ে টিমটিমে আলো আর ছাইগুঁড়োর মত উড়ে বেড়ান মশার মধ্যে চিন্তিত বনোয়ারি মেঝেতে পাতা মাদুরে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়ল। বাইরে তারা এখনও খেলে বেড়াচ্ছে।
ছোটবেলায় তার মস্তিষ্কে জল জমেছিল তাই তার চিন্তা করার ক্ষমতা এবং বুদ্ধিবৃত্তির দৌড় সীমিত। চুমকি ছায়াসঙ্গীর মতো মাথার পাশে বসে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছে। অবসাদে ক্লান্তিতে এবং দুশ্চিন্তায় তার চোখ বুজে আসছে।
জোছনার ছায়াপথে কখন তার বিপত্নীক বাবা পাটোয়ারিলাল এসে বললে, – উঠো বাপ। ভুখ তো মিটানা হোগা। আপনা পেট, বাচ্চাকা পেট। হাম ভি তো জুট মিল মে কাম করতা থা। চলা গিয়া নোকরি। একদিন বগল মে যো পেড় হ্যায় চুমকি বেটি উহাসে চলা আয়া। বড়া পেড়মে উসকা ফেমিলি থা। উ স্রিফ মেরা সাথ মে রহে গিয়া।
চটকা ভেঙে জেগে উঠল বনোয়ারি। ততক্ষণে সবাই একসাথে হয়েছে। কেরোসিন স্টোভ জ্বালান হলো। নিত্যদিনের মত বুঁদ বুঁদি ওঠা ডেকচির চারপাশে চারটি প্রাণী ভাতের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে মশগুল হল নৈশ আহারের আগাম প্রস্তুতিতে।
– ইয়ে মেরা ঘর। মেরা বাপ মা কা ঘর।
অবলারা কি বুঝল কে জানে। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বনোয়ারির গায়ে। তার ঘর বা তাদের ঘর কি এসে যায়?তাকে সবাই আদর করতে লাগল।
– ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। সবকো,সব কো ঘর। বড়া পেড় তুমহারা ঘর হ্যায় ইয়ে মেরা ঘর। যব জরুরৎ হোগা তুম আ সকতা হ্যায়।
এরপর বনোয়ারি খুব হাসলো, মন খুলে হাসলো। বাচ্চাগুলো ততোধিক উচ্চৈঃস্বরে কিচির মিচির করতে লাগল।