একটা কথা আজকাল প্রায় শোনা যায়, এখনকার বাচ্চারা বড্ড অল্পেতেই ভেঙে পড়ে। বছর ১০-১২ ছেলেমেয়েরা মারাত্মক অবসাদে ভোগে। একাকিত্ব গ্রাস করে। অনেকেই এতে টিপ্পনি কাটেন। আবার অনেকে এই সমস্যাগুলোকে বিশেষ পাত্তা দেন না। অনেক পরিবারেই তাই দুর্ঘটনাও ঘটে যায়। সামান্য মোবাইল কিনে না দেওয়ায় ১৬ বছরের কিশোরের আত্মহত্যা কিংবা সোনার ব্রেসলেট নিয়ে ঝগড়া হওয়ায় বাবাকে কোপ মারে বছর উনিশের ছেলে, এমন ঘটনা আমরা খবরের কাগজে পড়ি। হতবাক হই। স্কুলে নম্বর ভালো না পাওয়ায় আত্মহত্যার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ।
আসলে এখন মানুষ মানসিক রোগ নিয়ে যদি ০.০০১ শতাংশ সতর্ক হয়, আগের প্রজন্ম তাও ছিল না। তাই সেরকম বিশেষ তথ্য নেই, যার সাহায্যে আমরা বুঝতে পারবো, এই সমস্যা কি শুধুই এই সময়ের ছেলেমেয়েদের নাকি আগের প্রজন্মেও ছিল।
তবে, কয়েকটা ঘটনা দেখে বেশ হাসি পায়। মনে হয়, এই ধরণের মা-বাবার ছেলেমেয়ে যদি ফুলের ঘায়ে মুর্চ্ছা যায়, তাতে কি আর বাচ্চাগুলোকে দোষারোপ করা যায়!
বাচ্চা স্কুলে যাবে, তাই মা দুই পেল্লাই বোতল সঙ্গে দিয়েছেন। একটিতে পরিশ্রুত পানীয় জল আরেকটিতে কখনো ফলের রস আবার কখনো পুষ্টিকর গরম পানীয় ভরে দেন। ক্লাস করতে করতে যদি বাচ্চা দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে খাবে!
স্কুল ব্যাগ ছেলেমেয়ে বইতে পারবে না। এমনকি ১২-১৩ বছরের ছেলেমেয়েরাও বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা স্কুল বাস পর্যন্ত ব্যাগ পিঠে নিয়ে যেতে পারে না। এত দুর্বল পিঠ নিয়ে তারা সারা জীবন কীভাবে চলবে সেটা সত্যিই বেশ গভীর প্রশ্ন। তবে, আমি নিশ্চিত ওই ছেলে মেয়েগুলোর পিঠ যতখানি দুর্বল, তার চেয়ে ঢের বেশি দুর্বল তাদের করে রাখা হয়েছে। বাবা-মায়েরাই করে রেখেছেন।
এমনকি বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া হলেও আজকাল দেখি বাবা-মায়েরা বড় বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। নিজের সন্তানের হয়ে সওয়াল করতে স্কুল, টিউশন, গানের ইস্কুল সর্বত্র তারা দৌড়চ্ছেন। ছেলেমেয়ের বন্ধু মহলে হামলে পড়ে বলছেন, না না, তুই ভুল! আমার সোনা দোষ করেনি। একদম ওকে কিছু বলবি না। যা যা আমাদের বাড়ি আসবি না। আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে তুই কথা বলবি না। মানে, আড়ি-ভাব থেকে হনুমানের লেজ ধরে টানাটানি করা, সবটাই ছেলেমেয়ের হয়ে বাপ-মা করে দিচ্ছেন। তারা বেচারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কী করণীয় খুঁজেই পায় না।
আমারটাই ঠিক। আমারটাই ভালো। বাকি সব শয়তানের দল। আমারটার গুণকে হিংসে করে। হিংসুটের দল! এই হল দিন-রাতের মন্ত্র। হরিনামের মতো জপে যাচ্ছেন।
এতো গেল একটু বড় ছেলেমেয়েদের পিতা-মাতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। তবে, এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটে আরও আগে থেকে। যেমন, বাচ্চা নার্সারিতে পড়ে। একদিন স্কুলে গিয়ে খুব কেঁদেছে। কিছুই পড়াশোনা করানো যায়নি। তবে, অন্য বাচ্চা একটু কম কেঁদেছে বলে সে খাতায় কখানি লাইন টানার মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পাঠ রপ্ত করতে পেরেছে। সে কথা শোনার পরে ক্রন্দনরত শিশুর মা প্রায় মুর্চ্ছা গেলেন। কারণ, তার সন্তান কীভাবে কেঁদে সময় নষ্ট করলেন, এত বড় ব্যর্থতা তিনি কীভাবে বইবেন বুঝতে পারছেন না।
আচ্ছা, এমন মানসিক অসুস্থ বাবা-মায়ের কাছে বড় হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা খুব সুস্থ ভাবনা চিন্তা করবে, জীবনের প্রত্যেক সঙ্কটে খুব পরিণত হাবভাব করবে এমন প্রত্যাশা সোনার পাথর বাটি নয় কি?