এমা, কি ঘেন্নার কথা মা গো! এতকাল মাগনার ফেসবুকে তবু ইনিয়ে বিনিয়ে দু চাট্টে বস্তাপচা গপ্পো লিখছিল, এ যে একেবারে বাত্তুৃম নিয়ে টানাটানি! আরে, গাইনোর ডাক্তার বলে কি হায়ালজ্জা সব বিসজ্জন দিয়ে বসলি গা!
পদীপিসি এরকম গালমন্দ দিলে আমার কিছু বলার নেই। কারণ, ‘হাগা-মোতা’ ত দূরস্থান, ‘পেচ্ছাপ-পায়খানা’ ও বাঙালীর বহুকাল বন্ধ হয়ে গেছে। বাথরুম-টয়লেট-ল্যাট্টিনের পাট চুকিয়ে ‘ওয়াশরুম’ ও এখন যাকে বলে, রেট্টো। বাঙালী এখন কচুয়ার মহাকালী কেবিনে চল্লিশ টাকার ডিম্ভাতের থালি খেয়ে, স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে, “আঙ্কল, র্যস্টরুম টা কোন সাইডে?” ‘কি করে জানি’ হয়ে যাওয়া ফুটপাতের বাচ্চারাও এখন আর পায়খানা করে না, তাদেরও ‘পটি’ হয়। পদীপিসিও ডাক্তারকে গিয়ে বলেন, ‘টয়লেটটা খুব ঘন ঘন হচ্ছে।’ ডিগ্রিধারী, সভ্য-ভদ্র, গাড়ি-বাড়ি ওয়ালা লোকের কথা বলাই বাহুল্য।
মল, মূত্র আর এই দুটি বর্জন করার আগারের নাম আপামর সমাজে এখন মোটামুটি ‘পটি’, ‘টয়লেট’ আর ‘রেস্টরুম’ – যথাক্রমে এই তিনটি শব্দ দিয়ে চলছে। তা হোক, জনগণের মুখে মুখে ভাষা এভাবেই এগিয়ে চলে। বিদ্বজ্জনরা ত তাই বলে থাকেন।
মুশকিল আমার মত কিছু অভাগা ডাক্তারের। ব্রেন, হার্ট, চোখ এসবের মত দামী এবং পরিচ্ছন্ন অঙ্গ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অবিশ্যি এসব নোংরা বিষয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। যত সমস্যা এই আমার মত গাইনোর ডাক্তার বা পেটের সার্জন বা দু-চারজন যাঁরা এখনও জেনেরাল প্র্যাকটিস করেন, তাঁদের। একটা উদাহরণ দিই।
সেদিন প্রায়-মধ্য রাতে ফোন। “ডাক্তারবাবু, শামিমার হাজব্যান্ বলছি। শামিমার বাত্তুমে খুব পবলেম হচ্ছে।” ‘পবলেম’ কিন্তু এখন আর্ষপ্রয়োগে ব্যাকরণসম্মত, অতএব, নো হাসাহাসি।
– “কখন থেকে হচ্ছে? কি অসুবিধা?” গর্ভবতী মেয়েদের কোনও সমস্যাই ফেলে রাখার মত নয়, সুতরাং ঘুমচোখেও মনোনিবেশ করতে হল।
– “আজ্ঞে, বিকেল থেকে। বারবার লাগতেছে।” অভাগা, নিদ্রাতুর ডাক্তারবাবু ধরে নিয়েছেন, বাত্তুম মানে বাথরুম মানে মূত্র বা মূত্রত্যাগ – সচরারচর সেই অর্থেই ব্যবহার হয় কিনা। একটু বিরক্ত হয়ে তাই প্রশ্ন করলেন – “এতক্ষণ জানাননি কেন? আর কি সমস্যা – পেচ্ছাপের দ্বারে জ্বালা? তলপেটে ব্যথা? জ্বর-জ্বর ভাব?” গর্ভবতী মেয়েদের মূত্রনালীর সংক্রমণ অহরহ হয়, আর ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে হলে বিগড়ে যাওয়াও বিরল নয়। অতএব ঠিকঠাক কেস হিস্ট্রি দরকার।
– “আজ্ঞে, বিশ্বকাপের খেলা চলছিল। কেলাবে খেলা দেখে বাড়ি এলাম, তখন ও বলল। তবে আপনি যেসব বলছেন – সেসব কিছুই নয়। এ হল বাত্তুমের পবলেম। বাত্তুম, বাত্তুম।” শেষের শব্দদুটি বেশ জোর দিয়ে, টেনে।
এবারে মাথায় খানিক আগুন চড়ল – “বাথরুমে কি হয়েছে – মেঝে ফাটল, না কলের প্যাঁচ কাটল? রাজমিস্ত্রি কিংবা কলের মিস্ত্রি ডাকুন, আমি কি করব?”
দায়িত্বশীল সোয়ামীটি এবারে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন – “ডাক্তারবাবু, ওই বাত্তুমে কিছু হয়নি, পাতলা বাত্তুম হচ্ছে। এই তুমি বলোনা গো-” এবারে ফোনটি গেল আমার রোগিণীর হাতে – “পাতলা জলের মত পটি হচ্ছে, ডাক্তারবাবু।”
বাঙালির মুখে সহজ বাংলা কথাটি শুনে বুদ্ধু ডাক্তারবাবু এতক্ষণে বুঝলেন এবং নিদান দিয়ে ঘুমোতে গেলেন।
আমি একা নই, এই বাথরুম-টয়লেট-পটি-ল্যাট্টিনের চক্করে বহু সহকর্মীরাই ঘেঁটে যান এবং বোকা বনেন। এরকম কয়েকটি পাল্টা কাহিনী শোনার আশায় রইলাম। তবে রুগীরাই যে সবসময় গণ্ডগোল পাকান, এমনটা নয়, ডাক্তারবাবুরাও কখনও রোগীকে রীতিমতো ধাঁধায় ফেলেন। সেরকমই এক কাহিনী।
চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের চিরব্যস্ত লেবার রুম। তখন ডিজিও প্রশিক্ষণ চলছে। দু হাজার সালে সেখানে বাৎসরিক ডেলিভারি হত কমবেশি বারো হাজার – দিনে গড়ে বত্রিশটি। বর্ষা এবং পূজার ভরা মরশুমে কখনও কখনও দৈনিক চল্লিশও ছাড়িয়ে যেত। ওই রকম এক শেষরাতে হাড়ভাঙা খাটুনির পরে লেবার রুম সবে শান্ত হয়েছে। সহ-শিক্ষার্থিনীকে একঘন্টার বিশ্রামে পাঠিয়ে টেবলের উপরে থুতনি রেখে ঢুলছি। এক নিরীহ অল্পবয়সি প্রসূতি হাজির হলেন হাতে কাগজ নিয়ে। নূতন রোগীর আবির্ভাবে আমাদের বাঁধা গতটি ছিল – “বাথরুমে গিয়ে পেচ্ছাপ করে টেবলে এসে শুয়ে পড়।”। সেই কথাটি বলে আবার ঢুলতে লাগলাম – যতটুকু চোখের পাতা বুজিয়ে রাখা যায় আর কি। ঘুমিয়েই পড়েছিলাম ওভাবে। খানিক পরে ঢুলুনি কাটতে বুঝলাম – অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে, রোগী এখনও টয়লেট থেকে ফিরল না। সব্বোনাশ। ওখানেই প্রসব হয়ে যায়নি তো! মাসিরাও সবে মেঝেতে আঁচল পেতে একটু টান হয়েছেন। তাঁদেরই একজনকে ডেকে বললাম, “শিগ্গির বাথরুমে যান তো। একজন নূতন পেশেন্ট অনেকক্ষণ গেছে, কোনও পাত্তা নেই।” মাসি গেলেন এবং প্রায় ঘাড় ধরে মেয়েটিকে নিয়ে এসে বললেন – “ও ডাক্তারবাবু, আবাগীর বেটি ত ওখানেই মেঝেতে শুয়ে ছিল।”
তম্বি করে বললাম, “বাথরুমে শুয়ে ছিলে কেন গো?”
কাঁচুমাচু মুখে উত্তর এল – “আপনি যে বললেন, বাথরুমে গিয়ে পেচ্ছাপ করে শুয়ে পড়।”
বুঝলাম, মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। ঘুমের ঘোরে বাঁধা গতের মাঝখান থেকে ‘টেবিলে এসে’ অংশটি বাদ পরে গিয়েছিল। গ্রাম্য তরুণীর সেই অভিমানী মুখটি আজও মনে পড়ে। হয়ত হাসপাতালেই প্রথম তার লাল সিমেন্টের মেঝে, আবৃত আলোকিত প্রস্রাবাগার দেখা – বিস্ময়ে, ভয়ে সে ডাক্তারবাবুর কথাকেই আদেশ বলে মেনে নিয়েছিল। আহারে!
বাজে লেখাটি শেষ করি এক প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন রসিকতার উদাহরণ দিয়ে।
সেবাসদনের পরে আমার ঠিকানা ছিল স্পেক্ট্রাম ক্লিনিক, প্রবাদপ্রতিম ডাঃ প্রমথেশ দাসমহাপাত্রের প্রতিষ্ঠানে। যে ঘরে রোগীর ইতিহাস লিখে ফাইল তৈরী করা হত, যাকে বলা হত ‘হিস্ট্রি রুম’, তার পাশেই ছিল একটি ‘টয়লেট’ – মূলত রোগীদের ব্যবহারের জন্য। একদিন বসে হিস্ট্রি নিচ্ছি, একজন ভদ্রলোক, কোনও রোগীর স্বামী হবেন, এসে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন – “ডাক্তারবাবু, আমি কি এই টয়লেটটা ব্যবহার করতে পারি?”
ওঁর বিনয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি বলে ফেললাম – “নিশ্চয়, একশোবার।”
সজ্জন রসিক মানুষটির উজ্জ্বল উত্তরটি দিয়ে এই অখাদ্য লেখার ইতি টানি – “অতবার পারব না ডাক্তারবাবু, খুব কষ্ট হবে।”