কয়েকজনকে আমার সানুনয় অনুরোধ করা আছে, ফেসবুকে নতুন লেখা দিলেই আমাকে জানাতে। তেমনই একজন কাছের লেখক সোমা ব্যানার্জি দিদি। তাঁর শেষের তাঁর নিজেরই কিছু ব্যক্তিগত সখ আর অভ্যাস নিয়ে লেখাটা ভারি মায়াভরা। পড়তে পড়তে… ওই যা হয়, আমারও মনে পড়ে গেল আমার নিজের ইতিহাস।
খুব মায়াভরা জরুরি এক ব্যক্তিগত গদ্য পড়লাম।
এই অত্যন্ত জরুরি প্রসঙ্গে আমার অনেক কিছুই বলার আছে। তার মধ্যে দুতিনটি বলি।
একটা আমার আঁকা-আঁকি নিয়ে। আমি আমার বাকি সারাজীবন আঁকা প্র্যাক্টিস করলেও আঁকিয়ে বন্ধুরা যা আঁকেন তার কাছাকাছি কিছুই আঁকতে পারবো না। তবু উৎসাহ তো যেতে চায় না। সেই আগ্রহের তাড়নায় একবার একটা সেল্ফ পোর্ট্রেট এঁকেছিলাম।
বন্ধু অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বলল, এঁকেচিস ভালোই, মায় লাল ঝুঁটিটাও কিন্তু মুরগিটার পা দু’টো অত লম্বা কেন রে?
দোষের মধ্যে দোষ, সখ করে একটা লাল টুপি দিয়েছিলাম আত্মপ্রতিকৃতির মাথায়।
জীবন এই রকমই!
এবারে গান। রামকৃষ্ণ মিশন হোস্টেলের প্রেয়ার হলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম। সঙ্গীতশিক্ষার্থী সেই এক কিশোর অরুণাচলকে ডেকে প্রণব মহারাজ একদা খুব স্নেহভরে বলেছিলেন, “তোর তো নিষ্ঠা খুব। তবে কী জানিস, জগদীশ বসু বলেছেন এমনকি প্রাণহীন বস্তুও উত্তেজনায় সাড়া দেয়। আহা হারমোনিয়াম বলে কি মানুষ না। তা’ছাড়া চিত্রার্পিত ঠাকুরের কি আর এত ডেসিবেলের গণতন্ত্র সহ্য হয়? তুইই বল!”
আমি ঘাবড়ে বললাম, “মহারাজ ইয়ে, মানে আমার গানেও গণতন্ত্র?”
“বাঃ,গণতন্ত্র না? সপ্তসুর যে একসঙ্গে ঠেলে বেরুচ্ছে! আহা, ঈশ্বরের কী অপার লীলা!” মহারাজ বলেছিলেন।
এইবার চিঠি লেখার ব্যাপারটা বলি। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় প্রচুর চিঠি লিখেছি আমি।দুরকমের।
একরকমের লিখেছি বাবাকে। আবেদন। টাকা পাঠাও। কায়ক্লেশে সংসার চালানো বাবাকে জানিয়েছি আমিও বড় ক্লেশে আছি।
আর অন্য রকমটা হল প্রেমপত্র। ভুল ভাববেন না। প্রেম করেছি ঠিকই। কিন্তু চিঠি লেখার দূরত্ব সুনন্দার সঙ্গে আমার কোনওদিনই হয়নি। হবে কী করে। নিয়ম করে দুবেলা জলখাবারের খোঁজে তার স্বর্ণময়ী হোস্টেলে হানা দেওয়া আর দুপুরে লাইব্রেরিতে আমাকে কান ধরে পড়ানো, এই সবের মধ্যে আমি চিঠি কেন লিখব আর সেই বা পড়বে কেন সেই সব। তবু প্রেমপত্র লিখতাম। মানে লিখতে হত। সেমি-অর্থনৈতিক কারণে।
আমাকে দিয়ে এই সব পাপেভরা পত্র লেখাতো আমার সিনিয়ররা, সহপাঠীরা। এই লাইনে আমার বেশ নাম ছড়িয়েছিল। বলতে লজ্জা করে, চিঠি লেখাতো দুএক জন জুনিয়রও। পারিশ্রমিক দিয়ে। মজুরি বেশি না। চা, ওমলেট, সিগারেট। না পারলে চা বিস্কুটই সই।
এই করতে গিয়ে কিছু বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটত। অখিলেশদা’র হয়ে চিঠি লিখেছি। ললিতাদি’কে। দাদা সেটা নিজের হস্তাক্ষরে কপি করেছেন। চিঠি লিখেই ডিউটি শেষ তা নয়। খামে মুখবন্ধ সেই চিঠি পৌঁছে দিতে হয়েছে ললিতাদি’র হোস্টেলে। আমাকে ভিজিটরস রুমে বসিয়ে ললিতাদি চিঠি পড়তে গেছেন। যাবার আগে চোখ পাকিয়ে বলে গেছেন,- আমি আসার আগে যাবি না অরুণাচল।
ফিরে এসে ডাকসাইটে দিদি বললেন,- শোন্… আমি তো বাংলায় তেমন ইয়ে নই। তুই নাকি লিখিসটিকিস? অখিলেশের চিঠির উত্তরে তুই আমাকে এই এই পয়েন্ট ঢুকিয়ে একটা লিখে দিয়ে যাস তো সন্ধ্যের মধ্যে।
কী করা। নিজের লেখা প্রেমপত্রের উত্তরও নিজেই লিখলাম।
সামান্য দুটো বিস্কুট আর চায়ের লোভে এ জীবনে কত কীই না করেছি।
আর ডায়েরি? প্রত্যেক বছর কসরত করে জোগাড় করা ডায়েরিতে দু চারটি এন্ট্রির পর এগোতে দেয়নি আমার ভুবনবিদিত আলস্য।
অলমিতি।