সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকজন ভুয়ো সরকারি আধিকারিক ধরা পড়ার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের রাজ্যের প্রশাসনিক খামতি কোন পর্যায় পৌঁছেছে। ভুয়ো সার্টিফিকেট, ভুয়ো রেশন কার্ড, ভুয়ো পরিচয়পত্র, ভুয়ো ভোটার তৈরি করতে করতে অবশেষে ভুয়ো সরকারি উচ্চপদস্থ আধিকারিক পর্যন্ত তৈরি করতে সক্ষম আমাদের বাঙলা, যারা কিনা প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিনের পর দিন সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বেড়াচ্ছে।
স্বভাবত:ই সাধারণ নাগরিক হিসাবে মনে প্রশ্ন জাগে সত্যিই কি এভাবে প্রশাসনের চোখে ধুলো দেওয়া সম্ভব? আমাদের রাজ্য পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প সব দিক থেকে যখন নিম্নগামী লেখচিত্র রাজ্যবাসীর অদৃষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন ভুয়ো উন্নয়নের চিত্রকল্প এঁকে সরকার নিজের পিঠ নিজে চাপড়ানোর সংস্কৃতি না বদলালে আমাদের এই ভুয়ো সমাজব্যবস্থার মধ্যেই ক্রমশ: তলিয়ে যেতে হবে।
আসলে যেটা বলার সেটা হল চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের দাপটে যখন আমাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা তখন বদলের স্বপ্ন দু’চোখে মেখে আমরা পরিবর্তন এনেছি। বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় এল তখন তার সূচনা হয়েছিল সরাসরি এই ঘোষণার মাধ্যমে যে কাটমানিতে কোনও অসুবিধা নেই শুধু তা যেন নিজেদের মধ্যে সুষ্ঠু ভাবে ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া হয়। বাম আমলে যা ছিল গোপন ব্যাপার (চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা) পরিবর্তনের সরকার তার ওপর শিলমোহর লাগিয়ে সেই কাটমানিকে যেদিন মান্যতা দিল সেদিন থেকে পশ্চিমবঙ্গে এক নতুন ‘ভুয়ো’ সংস্কৃতির সূচনা হল। যেখানে হাসপাতালে ঝাঁ চকচকে মার্বেল পাথর লাগানো হয় বটে, জীবনদায়ী ওষুধ মেলে না। পরীক্ষায় অবাধ টুকতে দেওয়ার দাবী মেনে নিতে হয় পরিদর্শককে। পরীক্ষায় পাশ করেও শিক্ষক নিয়োগের ভুয়ো লিস্ট বঞ্চিত করে যোগ্য প্রার্থীকে। তারা প্রতিবাদ করলে, খেদিয়ে তুলে দিতে ছোটে করিৎকর্মা পুলিশ। তোলাবাজি, সিন্ডিকেটের দাপট সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। প্রতিবাদ করলে আছে দমন। কাজেই সেলিগম্যান সাহেবের কুকুরের মতো অসহায়তাকে বরণ করে নিতে শিখলাম (Learned helplessness) আমরা।
সামাজিক জীবনে একের পর এক প্রবঞ্চনা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, তোলাবাজদের দাপট সইতে সইতে যেন এই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ালো। পার্টির ধামা ধরতে পারলে অবাধে এই সংস্কৃতি অভ্যাস করা চলতে পারে এমনটা বুঝে যাওয়ায় বেকার যুবকরা সহজেই ভুয়ো আধিকারিক সেজে সাধারণ মানুষকে লুটবে আর সাধারণ মানুষও সে ফাঁদে পা দেবে এ যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
হয়তো সারা ভারতের চিত্রটা এর থেকে খুব বেশি আলাদা নয় তবু ভিন রাজ্যে বাস করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সেখানে অন্যায়কে অন্ত্যত: খোলামেলাভাবে সরকারি শিল মোহর দেওয়ার প্রথা এত প্রকট হয়ে ওঠে নি। এই ভুয়ো সংস্কৃতি থেকে বাঁচতে গেলে সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমরাও আমাদের দায় এড়াতে পারি না। গত বিধানসভা নির্বাচনে বাঙলা বাঁচানোর যে দায় বাঙলার মানুষ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে সেই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য আমজনতাকে গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে।
অন্যায়ের প্রতিবাদ হলে সেই প্রতিবাদে সামিল হয়ে ক্ষমতার চোখ রাঙানিকে ধুলিস্যাৎ করতে না পারলে এই অপসংস্কৃতির চোরাবালিতে ডুবে মরা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গবাসীর পরিত্রাণ নেই। আজ আবার নতুন করে বোঝার সময় এসেছে “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে” উভয়েই সমান দোষে দোষী।