সংরক্ষণ বা কোটা নিয়ে ভাবছিলাম। কোটা তো ক্রমশই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। লাভ কিছু হচ্ছে কি? হলেও, কাদের হচ্ছে?
কোটা দিয়ে একেবারেই কিছু লাভ হয়নি, এমন হয়ত নয়। আমারই পরিচিত অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, যারা হতদরিদ্র অবস্থা থেকে কোটা-র সুযোগ ছাড়া এগোতে পারত না। আবার উল্টো উদাহরণও কম নেই। স্বামী-স্ত্রী ডাক্তার, সুপ্রতিষ্ঠিত – মেয়েটি বিয়ে করেছে উচ্চবর্ণে – কিন্তু জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগে মা নিজের তফসিলি জাতির পরিচয়ে সন্তানের জন্যে কোটা-র সার্টিফিকেট বের করেছেন, এমনও দেখেছি। কিন্তু এসব তো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন বায়াস মিশে থাকতেই পারে। কোটা-র কার্যকারিতা – মানে, এটা দিয়ে আদৌ কিছু লাভ হচ্ছে কিনা – সে বিষয়ে কিছু নৈর্ব্যক্তিক ক্রাইটেরিয়া কি ভাবা যেতে পারে??
আচ্ছা, বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থায় উচ্চপদে তপসিলি জাতি/উপজাতিভুক্তদের সংখ্যা কেমন? বা হাইকোর্ট/ সুপ্রিমকোর্টের বড় উকিলদের মধ্যে? অথবা ধরুন দেশের ছোটবড় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের কত শতাংশ তফশিলি জাতি বা উপজাতিভুক্ত? দেশের অধিকাংশ চাকরিবাকরিই তো আপাতত বেসরকারি ক্ষেত্রে – অন্তত মোটা মাইনের চাকরির প্রায় পুরোটাই তাই। সেখানে যদি তফসিলি-দের অনুপাতটা নগণ্য হয়, তাহলে তো উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন কোটা দিয়ে সেভাবে কিছু লাভ হচ্ছে না, তাই না?
মানে, যাঁরা কোটা-র সুবাদে উচ্চশিক্ষা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা লাভ করলেন – ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং আইআইটি আইআইএম প্রেসি-যাদবপুর-জেএনইউ ইত্যাদি পার করলেন – তাঁরা কি কর্পোরেট জগতের চাকরিতেও তরতর করে এগোচ্ছেন? যদি এগোন, খুবই ভালো কথা। কিন্তু যদি তেমন না হয়??
যদি তেমন না হয়, তাহলে তার অর্থ, উচ্চতম শিক্ষালাভের শেষেও এঁরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়েই আছেন। অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যেতেই পারে, “মেধা”-র যে ফারাকটুকুর একমেবাদ্বিতীয়ম কারণ হিসেবে জাতিগত পশ্চাদপদতাকে ভাবা হয়েছিল – সেই ভাবনাটাই ভুল। অর্থাৎ, তাহলে, মেধা – এক্ষেত্রে যাকে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার উপযুক্ততা হিসেবে ভাবা যেতে পারে – সেই “মেধা”-র ফারাকটি দস্তুরমত বাস্তব। এবং সংরক্ষণ দিয়ে সেই ফাঁক পূরণ করার ধারণাটি মস্তবড় ভ্রান্তি। তাই না?
আর্থসামাজিক পশ্চাদপদতা বা জাতিভেদ এদেশে জ্বলন্ত বাস্তব। সেই ভেদাভেদ দূর করার একমাত্র পথ সংরক্ষণ নয় – এমনকি অন্যতম কার্যকরী পথও নয়, যদি না সংরক্ষণের শেষে সংরক্ষণহীন প্রতিযোগিতায় ও কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়, যদি না সংরক্ষণ-প্রাপ্ত শিক্ষার শেষে সংরক্ষণহীন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তাঁদের যোগ্যতা প্রমাণিত হয়।
সমাজের সর্বক্ষেত্রে ভেদাভেদ বিলোপ চট করে সম্ভব নয়। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে সমতা, একটু সরকারি উদ্যোগ থাকলেই, সম্ভব। পিছিয়ে পড়াদের জন্য স্কুলস্তরে বিশেষ সুযোগসুবিধা বা তাদের পড়াশোনার বিশেষ বন্দোবস্ত ইত্যাদি।
স্কুলস্তরে কোনোরকম বাড়তি মনোযোগ না দিয়ে শুধুই উচ্চশিক্ষায় কোটায় হয়ত আদপে কিছুই কাজের কাজ হচ্ছে না – উলটে এক অন্য বিভাজন ও বিদ্বেষের জন্ম নিচ্ছে।
শৈশবাবধি অপুষ্টিতে ভোগা শিশুকে বাকিদের সমান করতে হলে ওই শৈশবেই তার পুষ্টির বন্দোবস্ত করা জরুরি – সেটুকু না করে বারো ক্লাসের মাথায় তাকে হাজার প্রোটিন-ভিটামিন গেলালেও সে বাকিদের সমান হতে পারবে না।
ভুল বললাম কি?
সেই ভেদাভেদ দূর করার একমাত্র পথ সংরক্ষণ নয় – এমনকি অন্যতম কার্যকরী পথও নয়,……. একমাত্র পথ “জাতি প্রথা যার অন্তর বস্তু ব্রহ্মানবাদ তার সমপূর্ন বিলোপ”…বা “Cast Annihilation”. দলিত সংখ্যালঘু অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতিগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কোটা পদ্ধতি চালু হবার পর আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যাবস্থার মানের উন্নতি হয়েছে।
ভালো লেখা।