“Truth is stranger than fiction.”
কথাটা যে কতো সত্যি যখন মানুষ ঘটে যাওয়া “সত্যি ঘটনাগুলোর” দিকে ফিরে তাকায় তখন বোঝে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় গল্পটার কথা বলতে একজন বাঁকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- “দুধে জল, না জলে দুধ?” আমিও একটা বয়সে পৌঁছে বুঝেছি যে এমন অদ্ভুত কিছু ঘটনা জীবনে ঘটে যায় যে তাই দিয়ে অনায়াসেই একটা রোমহর্ষক হিন্দি সিনেমা বানানো যায়।
সার্জারিতে স্পেশালাইজেশন করে বিদ্যুৎপর্ষদের চাকরিতে ফিরে এলাম। ব্যান্ডেল থার্মাল পাওয়ার প্রোজেক্টটা আদপে ছিল মগরা-বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে। লাখ লাখ টাকার কয়লার চোরাচালান হতো সেই জায়গায়। (জানিনা লেখা উচিত হলো কিনা।) জমি দখলের লড়াইয়ে একজন দুজনের মৃত্যুর খবর প্রায়ই পাওয়া যেতো। সাধারণ নাগরিকদের মতো আমারও বিশ্বাস ছিল যে এই ধরনের গুন্ডা বদমাশদের দর্শন পাওয়া ভয়ানক কুলক্ষণ।
আমার “ছা”টা তখন গুড়গুড় করে হেঁটে বেড়ায়। আমি আক্ষরিক অর্থে ছাপোষা মানুষ। হাসপাতালের কাজ মিটে গেলে সোজা বাড়ি চলে এসে ছেলের সঙ্গে খেলতাম। আর আমার সারাক্ষণ বকবক করা ছেলে ঘুমোতো বেশ রাত করে। ছেলে ঘুমোলে পাড়া জুড়তো – সেই জুড়নোটাও হতো প্রায় রাত একটা নাগাদ। তার মা তাকে চেপে জড়িয়ে থাকলে একটা সময় তার বকবকানি থামতো।
একদিন সে ঘুমিয়ে পড়ার পর বর্গী এলো দেশে। তখন প্রায় রাত দেড়টা বাজে। যেহেতু প্র্যাকটিস করতাম না সেহেতু কলিংবেলের আওয়াজে স্বামী স্ত্রী দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। দরজা খুলে দেখি তিন-চার জন দাঁড়িয়ে আছে। পোশাকপরিচ্ছদ ভদ্রসভ্য। কথাবার্তাও বেশ মার্জিত। খুব বিনয়ের সাথে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক জানালেন যে তাঁর দাদা অসুস্থ, তাঁকে দেখতে যেতে হবে।
“আমি তো প্রাইভেট প্র্যাকটিস করিনা। আর তাছাড়া আমার যে সাবজেক্টে স্পেশালাইজেশন তাতে কিছু করতে হলে রোগীকে হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমে আনতে হবে। আপনারা বরং কোনো মেডিসিনের ডাক্তারকে কল দিন।”
আমার কথাটা শেষ হবার আগেই পেছনে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক সামনে এগিয়ে এলো। তার হাতে যে জিনিসটা শোভা পাচ্ছিলো সেটা ফরেনসিকের ক্লাস করার সময় দেখেছি আর থার্ডগ্রেড হিন্দি সিনেমায় দেখেছি। সেটা মোটেই আমার দিকে তাক করা ছিলো না। নিজের হাতের মাঝখানে রিভলবারটা রেখে আরো বিনয়ের সাথে বলে “একবার যদি পায়ের ধুলো দেন!”
পায়ের যেটুকু ধুলো ছিলো সেটুকু তখন টেনশনে ঘেমে কাদা হয়ে গেছে। বাচ্চাটা সদ্য ঘুমিয়েছে। স্ত্রী যাতে না টেনশন করে সেজন্য যতটা পারা যায় নির্ভীক গলায় বললাম যে কাছেই একটা পেশেন্ট দেখতে যাচ্ছি। খুব দেরি দেখলে সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারকে জানিও, তিনি আমাকে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসবেন। ডাক্তারদের স্ত্রীরা জানেন যে তাঁদের স্বামী একটা সরু সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হন।
বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছিল – সাদা রঙের অ্যাম্বাসেডর। বেপরোয়া বেগে পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিলো তারা। সেইসব বৈষ্ণব ভাবাদর্শী বিনয়ের অবতার মানুষগুলি প্রায় চ্যাং-দোলা করে একটা ঘরে নিয়ে গেলো আমাকে।
একটি সাধারণ বিছানায় কোমরে গামছা জড়িয়ে একজন শুয়ে আছে। গামছাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কোমরে গুলি লেগেছে- সেটা বার করতে হবে। আমি আঁতকে উঠলাম। পড়েছি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপারেশন হয়েছিল বারান্দায়। এক চিলতে এই ঘরে এরকম বড় এবং বিপজ্জনক অপারেশন করবো কিভাবে? তার ওপর রক্ত লাগতে পারে। একজন গম্ভীর গলায় বললো – “রক্ত লাগবে না, হিমাক্সিল দিয়ে কাজ চালান।” রক্তের বিকল্প হিসেবে খুব অসহায় অবস্থায় হিমাক্সিল ব্যবহার করা যায়। বুঝলাম ডাক্তারির বেসিক ব্যাপারগুলো এরা আমার থেকে একটু বেশিই জানে। সায়েন্স দিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। তাই চুপ করে গেলাম। একজন কাগজ পেন এগিয়ে দিলো, কি কি আনতে হবে তার লিস্ট বানানোর জন্য। আমি প্রথমেই বড়ো বড়ো করে লিখলাম “অ্যাসিস্ট্যান্ট”।
ঠিক আধঘন্টার মাথায় এক ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া সিস্টার আর ইনস্ট্রুমেন্টস নিয়ে তারা হাজির। খাটের মাথা থেকে স্যালাইন ঝোলানো হ’ল। এই অপারেশন কলকাতার বড়ো হাসপাতালে দু বোতল রক্ত এবং একটা ভালো অজ্ঞানের ডাক্তারবাবু ছাড়া কোনো মুর্খও করতে চাইবে না। তার ওপর সিস্টারের হাতও এমন ভাবে কাঁপছিল যে মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল রাস্তার পাশে ঝালমুড়িওলা মুড়ি মাখাচ্ছে।
গুলি ঢুকেছিল ডানদিকের পিঠের কাছে। ‘উন্ড অফ এন্ট্রির’ জায়গাটা অবশ করে শুরু করলাম। নিশ্চয়ই মানুষটার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু একটা টুঁশব্দ শুনতে পাইনি। একটু করে অবশ করছি আর একটু করে ভেতরে কেটে ঢুকছি। গুলিটা কিডনির পাশে ফাসা অফ জেরোটা ভেদ করে বসে আছে। আর এক ইঞ্চি এগিয়ে গেলে মানুষটি ছেঁড়াখোঁড়া কিডনি নিয়ে যমরাজের সাথে ততক্ষণে দেখাসাক্ষাৎ করতে পৌঁছে যেতো। তার পিতৃদেবের অসম্ভব ভালো ভাগ্য বলাই যেতে পারে।
সমাজের ভালো করলাম না মন্দ করলাম জানি না। কোনো ডাক্তার চিকিৎসা করার সময় সেসব কথা ভাবেও না। প্রাণ বাঁচানোর অদ্ভুত একটা আনন্দ আছে। ভোরে রাস্তায় শিউলি ফুল পড়ে থাকার মতো আনন্দ, বৃষ্টি শেষে নীল আকাশের বুক ভরে রামধনু আঁকা থাকার মতো আনন্দ, পুজোর আগে রাতজেগে মহালয়া শোনার মতো আনন্দ। কাউকে বোঝানো যায়না। একটু শ্লাঘা নিয়েই বলি – শুধু ডাক্তাররা বোঝে।
তারপর যতদিন সেখানে ছিলাম সমস্ত উৎসবে আমার বাড়িতে দামি শার্ট প্যান্ট পৌঁছে যেতো। বারণ করার সাহস ছিল না। কাউকে বলা নিষেধও ছিলো। তিন বছর ব্যান্ডেলে থাকার পর হেল্থ সার্ভিসের চাকরি নিয়ে চলে এলাম কৃষ্ণনগর।
যখন ওখানকার বাস একেবারে তুলে দিয়ে কৃষ্ণনগরে আসছি তখন আমার স্ত্রী বলে যে একটা গাড়ি নাকি আমাদের ফলো করছে। ওকে ক্রাইম পেট্রল মার্কা সিরিয়াল দেখতে বারণ করে ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিলাম। কৃষ্ণনগরে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ পরে রাতের খাবার কিনতে বেরিয়ে দেখি গলির মুখে একটা সাদা অ্যামবাসেডর দাঁড়িয়ে আছে। সেটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই গুলি লাগা ভদ্রলোক। এই তিনবছর ধরে তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখলেও তাকে কখনো দেখিনি।
তিনটে বিরিয়ানির প্যাকেট আর ছোট কাগজে তার ফোন নাম্বার লিখে ধরিয়ে দিয়ে বলে – “প্রয়োজন হলেই ফোন করবেন ডাক্তারবাবু।”
প্যাকেটগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। আর ফোন নাম্বারটা মুচড়ে লুকিয়ে রাস্তায় ফেলে দিই।
আমি জানি, প্রয়োজন পড়লেও তার সাহায্য নেবার মতো নরম আমার শিরদাঁড়া নয়।
খুব ভালো লাগলো গল্প টা পড়ে ☺।
ধন্যবাদ স্বাতী ?
গল্প টি পড়ে মনেই হয় না এটা গল্প,সত্যি এবং জীবন্ত।
❤❤❤
লোমহর্ষক কাহিনী! এই ধরনের লেখা কোন ডাক্তার বাবু’র কলমে আগে পড়িনি।তবে ব্যান্ডেল থেকে কৃষ্ণনগর অবধি কৃতজ্ঞ লোকটা এসে তার উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে যেটা সচরাচর দেখা যায়না।খুব ভালো লাগলো পড়ে।
???❤❤❤
খুবই সুন্দর লাগলো আপনার এই উপস্থাপনা ।জীবনে মানুষ কে অনেক কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবে সবাই ডাক্তার বাবু দের ভগবান মনে করে এরা যাই করুক না কেন খতি করবে না। আপনার লেখা পড়তে ভাল লাগে। ভালো থাকবেন।
???❤❤❤
আপনার জীবন ও আইনগত ঝুঁকি নিয়ে মানবসেবা এবং লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম…
???
Sir, আপনি খুব সাহসী ।। সত্যিই গল্পটি রোমহর্ষক। ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো সংক্রামিত হয়ে মাড়া যান কিন্তু আপনি ঐ মানুষ টি কে নতুন জীবন দিয়েছেন ????অসাধারণ ।। sir আপনার গল্প গুলি সত্যিই আমায় মুগ্ধ করে।।।। আরও গল্পের অপেক্ষায় রইলাম ?
??????
দারুণ দারুণ ???
ধন্যবাদ ?
অসাধারণ লিখেছেন ডাক্তার সাহেব । মুগ্ধ হয়ে গেলাম! পরের কিস্তি কবে?? অপেক্ষায় রইলাম!!!
ধন্যবাদ দাদা ??
খুব ভালো লাগলো। আপনার লেখা আগে ও পড়েছি। ঘন ঘন লিখুন।
ধন্যবাদ অনেক। ??
অনির্বান ….জানি তোর এই পরিস্থিতি সামলানোর এলেম আছে
???❤❤❤
অসাধার, কোন তুলনা হয়না। আমি আর মোহর দুজনেই মুগ্ধ হলা।।
ধন্যবাদ ??????