বুড়ো হয়ে গেলে ছোটোবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। আমি এখনো বুড়ো হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করিনি। তবে চল্লিশ পেরিয়ে বুড়ো হওয়ার পথে কিছুটা এগিয়েছি।
এবং তারপর থেকেই ছোটোবেলার কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। মায়েদের শাড়ি দিয়ে চারদিক ঘিরে ফাংশন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টি ভেজা মাঠে ফুটবল, মাসে দুবার সবাই মিলে বাড়ি থেকে চাল ডাল আলু নিয়ে খিচুড়ির পিকনিক… ছোটোবেলাটা আসলেই ভালো ছিল। কত বৈচিত্র্য ছিল। এভাবে সারাদিন একঘেঁয়ে রোগী দেখতাম না।
ছোটোবেলা মানেই আমি আর সুমনদা মিলে দেওয়াল পত্রিকা অরুণোদয়; কেউ পড়তো না। তাই বুদ্ধি করে কালভার্টের পাশেই টানালাম- সবাই যে জায়গায় ইয়ে করে… মানে মুত্র বিসর্জন করে। ঐ বিশেষ সময়ে লোকজনের মনও ভালো থাকে। সেই ভালো মনে যদি আমাদের দু একটা ছড়া- কবিতা- গল্প পড়ে দেখেন।
আরেকটু বড় হয়ে সত্যিকারের ছাপার অক্ষরে লেখা বার হলো। সৌজন্যে নগরের কথা পত্রিকার সম্পাদক শ্রী ব্যোমকেশ মজুমদার। আমাকে আর সুমনদাকে তিনি অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন লেখার জন্য। সে সময় ফেসবুক ছিল না, কিন্তু নগরের কথা পত্রিকা ছিলো। পাক্ষিক নগরের কথায় প্রতি সংখ্যাতেই আমরা দুজনে লিখতাম- একাধিক লেখা লিখতাম। এমনকী একটা ধারাবাহিক উপন্যাস পর্যন্ত লিখেছিলাম।
তারপর মেডিকেল কলেজ। সেখান থেকে মুর্শিদাবাদে সরকারি চাকরি। জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। এখন আমি রোজকার রোগী দেখার একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য ফেসবুকে আবোল তাবোল লিখি। আর আমার চাইতেও যারা একঘেঁয়ে জীবন কাটান সেই সব ব্যক্তিরা সেই লেখায় লাইক দেন, মন্তব্য করেন।
মুশকিল হচ্ছে একঘেঁয়েমি কাটানোর এই পুরো পদ্ধতিটাও আস্তে আস্তে বেশ একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে সময় ব্যোমকেশ বাবু প্রস্তাব দিলেন (যিনি অক্লান্ত ভাবে ২৬ বছর ধরে নগরের কথা পত্রিকা চালিয়ে যাচ্ছেন) , ‘নগরের কথায় সেই আগের মতো নতুন করে ‘বাঁকা চোখে’ ধারাবাহিকটা লেখো ঐন্দ্রিল। এটাই তো বাঁকা চোখে লেখার আদর্শ সময়।’
এর আগেও দু-একটি পত্রিকায় লেখার প্রস্তাব পেয়েছি। তবে লিখতে রাজি হইনি। কারণ আমি সাহিত্যিক নই। ফাঁকিবাজি করে সাহিত্য হয় না। একপাতা লেখার জন্য অন্তত একশো পাতা পড়তে হয়। লেখার সময় নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়।
আমি ঠিক তার উল্টোটাই করি। সারাদিন খুপরি থেকে খুপরিতে ঘুরেই কেটে যায়। যেটুকু সময় পাই মেয়েদের অংক করাই। ওরা অংক করে, আমি লিখি। ছোট মেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘হেক্টোমিটার থেকে ডেসিমিটার করতে হলে কত দিয়ে গুণ করব বাবা?’
লেখা থামিয়ে কর গুনি, “ডেকে হেঁকে কিল মারো”। গল্পের চরিত্ররা অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে যায়। মেয়েকে বুঝিয়ে আবার লিখতে বসি। ফোন আসে, ‘চারদিন আগে আমার মাকে দেখেছিলেন। ওষুধ খেয়ে ওনার অবস্থা তো আরো খারাপ হচ্ছে।’
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি লিখি। লিখতে লিখতে ঢুলি। এবং শেষমেষ ল্যাপটপ খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের ঘোরে অনেক অর্থহীন অক্ষর টাইপ হয়। গোটা লেখাটাই অনেক সময় ডিলিট হয়ে যায়।
তবু ব্যোমকেশবাবুর প্রস্তাবে অসম্মত হতে পারলাম না। ঐ যে ছোটোবেলায় ফিরে যাওয়ার লোভ। ২২ শে আগস্ট সংখ্যা থেকে নগরের কথা পাক্ষিক সংবাদ পত্রে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে শুরু হয়েছে বাঁকা চোখে। এখন ফেসবুকে লেখা লিখি একটু কম হবে। কারণ মাসে দুই কিস্তি বাঁকা চোখে লেখার সময় বের করাই মুশকিল হয়ে দাড়িয়েছে।
তবে নগরের কথা স্থানীয় পত্রিকাটি নববারাকপুর- মধ্যমগ্রামের বাইরে পাওয়া মুশকিল। ব্যোমকেশকাকু যদি অনুমতি দেন তাহলে পত্রিকা বেরোনোর কদিন বাদে লেখাটা ফেসবুকে দিতে পারি।