আচার্য শীলভদ্র ত্বরাহীন শান্তকণ্ঠে কহিতেছিলেন –“ইহা সত্য যে সমগ্র উত্তরাপথে পাশুপত ধর্মই আদি শৈবধর্ম। এই সনাতন পাশুপত ধর্মের ধ্যান ও কল্পনার মধ্যেই হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠ বিকাশ পরিলক্ষিত হইয়াছিল।
উত্তরাপথ কেন, সমগ্র আর্যাবর্তই শিবের আরাধনার উৎকৃষ্ট সাধনক্ষেত্র বলিয়া পরিগণিত হইত।
উমা মহেশ্বর মূর্তি কল্পনা করুন দেবি, তাঁহারা পৃথকরূপে পূজিত হইলেও অর্ধনারীশ্বর কল্পনায় যুগলে মিলিয়া গিয়াছেন, অন্তিমে তাঁহারা এক এবং অবিচ্ছেদ্য।
মহাকবি কালিদাসের কুমারসম্ভব পাঠ করিলে আমার বক্তব্য সম্যক উপলব্ধি করিবেন।
কিন্তু ঈশ্বরের রুদ্ররূপ যদি ক্ষমতাদণ্ডরূপে পররাজ্যলোভী রাজার হস্তধৃত অস্ত্রে পরিবর্তিত হয়, তখন ধর্মের অবমাননা হয় — সাধারণ মনুষ্য হইতে সেই ধর্মের দূরত্ব রচিত হয়।
এই অশান্তিময় প্রেক্ষাপটে সর্বলোকবন্দ্য ভগবান সুগত এবং তাঁহার শান্ত, করুণাপূর্ণ সমদর্শী ধর্ম প্রতিনিয়ত প্রাসঙ্গিক হইয়া উঠে।”
রাজকুমারী রাজ্যশ্রী গভীর মনোযোগ সহকারে আচার্যের বক্তব্য শুনিতেছিলেন।
তাঁহার পদপ্রান্তে দীপান্বিতা নতমস্তকে পরিপূর্ণ হৃদয়ে বসিয়াছিল। রাজা যে মহাস্থবির শীলভদ্রকে দেবী রাজ্যশ্রীর সমীপে উপস্থিত করিবার জন্য তাহার সনির্বন্ধ অনুরোধ শ্রবণমাত্র অনুমোদন করিয়াছেন, ইহা সে বিগলিতচিত্তে স্মরণ করিতেছিল এবং অনুক্ষণ হর্ষের অসীম ঔদার্য্যের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করিতেছিল।
ভ্রষ্ট গুরু এবং নষ্ট পণ্ডিতের আস্ফালনে তাহার নিজ ধর্মের নিত্য অবনমন সম্বন্ধে স্বীয় অনুভব যখন আচার্য শীলভদ্রের বক্তব্যেও অনুরণিত হইল, তাহার পূর্ববিক্ষুব্ধ চিত্ত কিঞ্চিৎ শান্তিলাভ করিল।
রাজ্যশ্রীর অশান্ত হৃদয়েও মহাস্থবিরের কোমলকণ্ঠের বুদ্ধবন্দনা এক অনন্য সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে সমর্থ হইতেছিল।
আচার্য ধীরস্বরে বলিতেছিলেন — “করুণার একমাত্র আধার, সর্বজীবের বন্দনার্হ ভগবান বুদ্ধ এবং জগতের একমাত্র দীপসদৃশ তাঁহার সদ্ধর্ম উভয়েই যেন জয় লাভ করে। সকল মহানুভব ভিক্ষুই বুদ্ধ ও ধর্মের সেবা করিয়া সংসারসাগর পারে উপস্থিত হইয়া নির্বাণলাভ করেন।”
স্থানীশ্বর হইতে কান্যকুব্জে আনীত হইবার মুহূর্ত হইতেই দীপান্বিতা হর্ষবর্ধনের রাজঅন্তঃপুরে রাজকুমারী রাজ্যশ্রীর পার্শ্বস্থিত কক্ষে স্থান পাইয়াছিল। অসুস্থ রাজ্যশ্রীর পরিচর্যা হেতু রাজবৈদ্যের অভিমত অনুযায়ী রোগীর যথাসম্ভব নিকটে তাহার উপস্থিতির আয়োজন হইয়াছিল।
কিন্তু রাজকুমারীর সুস্থতালাভের পরেও রাজানুগ্রহে দীপান্বিতার স্থানচ্যুতি ঘটিল না — সে পূর্ববৎ রাজ্যশ্রীর নিভৃতকক্ষের পার্শ্ববর্তী প্রকোষ্ঠটিতে অধিষ্ঠান করিতে লাগিল। ইহাতে দেবকীর্তি, চম্পা প্রমুখ নবীনা দাসীগণের মধ্যে কিঞ্চিৎ জল্পনার উদ্রেক হইল বটে, কিন্তু উপযুক্ত ইন্ধনের অভাবে তাহাদের উৎসুক জল্পনা কালক্রমে আপনি নিবৃত্ত হইয়া গেল।
রাজা হর্ষবর্ধন দিনান্তে রাজকর্ম সমাপ্ত করিয়া ভগিনীর কুশলসংবাদ লইতে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেন।
রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি, অমাত্যগণের কার্যকলাপ, প্রজাদিগের অবস্থা, কৃষি উৎপাদন, বাণিজ্যের সমৃদ্ধি ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে ভ্রাতা ভগিনীর আলাপ আলোচনা হইত।
হর্ষ কদাচিৎ তাঁহার সমীপে আনীত প্রজাবর্গের কোনও সমস্যা সহোদরার নিকট বিবৃত করিয়া উক্ত বিষয়ে তাঁহার মতামত প্রার্থনা করিতেন।
“অদ্য এক ক্ষেত্রকর বিচার প্রার্থনা করিয়া আমার সভায় আসিয়াছিল। তাহার কন্যার বিবাহের ব্যয়ভার বহনের কারণে সে এক কুল্যবাপ পরিমাপ নিজস্ব বাসযোগ্য ভূমি শ্রেষ্ঠী ধনঞ্জয়ের নিকট বন্ধক রাখিয়াছিল। সময়ে ঋণের অর্থ প্রত্যর্পণ করিতে অপারগ হওয়ায় শ্রেষ্ঠী ক্ষেত্রকরকে নিজগৃহ হইতে বিতাড়নপূর্বক ভূমি অধিকার করিয়া বসিয়াছে। বাস্তুহারা, ভাগ্যপীড়িত কৃষক আমার সভায় বিচারপ্রার্থী হইয়া আসিয়াছিল।”
রাজ্যশ্রী উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিতেন — “বিচারে কি হইল রাজন?”
হর্ষ হাসিয়া কহিতেন — “এই বিষয়ে সুবিচারের ক্ষেত্রে তোমার অভিমত কি, ভগিনী?”
ক্ষণেক নিশ্চুপ থাকিয়া রাজ্যশ্রী বলিতেন — “কেহ যাহাতে বঞ্চিত না হয়, তাহা নিশ্চিত করাই তো রাজার কর্তব্য।”
হর্ষ সন্তুষ্ট হইয়া কহিতেন — “যথার্থ কহিয়াছ। শ্রেষ্ঠী ধনঞ্জয়ের রাজাকে প্রদেয় কিছু ভূমিকর অনাদায়ী রহিয়া গিয়াছিল। আমি মুদ্রার পরিবর্তে ঐ বাস্তুভূমিটি রাজস্ব হিসাবে গ্রহণ করিয়াছি। পুস্তপালের সহায়তায় ঐ ভূমি বাস্তুহারা ক্ষেত্রকরের নামে পুনরায় লিপিবদ্ধ করিবার আদেশ দিয়াছি ভগিনী। শ্রেষ্ঠী ধনী ব্যক্তি, এক কুল্যবাপ ভূমিতে তাহার অবস্থার তারতম্য ঘটিবে না, কিন্তু দরিদ্র ক্ষেত্রকর বাসভূমি হারাইলে দাঁড়াইবে কোথায়?”
রাজ্যশ্রীর স্বাস্থ্য লইয়া রাজা অন্তরে সন্তোষলাভ করিলেও প্রকাশ্যে সর্বদা চিন্তা ব্যক্ত করিতেন। বস্তুত, দীপান্বিতার সস্নেহ সেবা এবং সাগ্রহ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ পাঠে রাজ্যশ্রীর মলিন বিষণ্ণতা প্রায় বিলীন হইয়া গিয়াছিল — তাঁহার দৃষ্টি সজীব, দেহ লাবণ্যপূর্ণ এবং কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক হইয়াছিল। রাজা হর্ষবর্ধন ইহা লক্ষ করিয়া প্রীত ও নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন।
ভগিনীর নিকট বিদায় লইবার পরে, অন্তঃপুরের বহির্দ্বারে দীপান্বিতার সহিত তাঁহার নিত্য সাক্ষাৎ হইত। তাঁহাদের মধ্যে অধিক বাক্যবিনিময় হইত না।
যেখানে একটি অন্তরের সহিত অপর অন্তর সূত্রহীন মাল্যের গ্রন্থিবন্ধনে চিরস্থায়ীরূপে বাঁধা পড়িয়া গিয়াছে, সেখানে অধিক বাক্যবিনিময় নিষ্প্রয়োজন।
দৈবাৎ রাজা হয়ত প্রশ্ন করিতেন – “রত্নাবলী, আশা করি সকল কুশলমঙ্গল রহিয়াছে।”
দীপান্বিতা হাসিয়া উত্তর করিত — “যে স্থলে পরমভট্টারক মহারাজ স্বয়ং মঙ্গলদীপ হইয়া রাজ্যের ললাটে প্রজ্বলিত রহিয়াছেন, সেই স্থানে অমঙ্গলের অন্ধকারের কোনও অস্তিত্ব থাকে না — দুর্ভাগ্য আপনা হইতেই দূরীভূত হইয়া যায়।”
হর্ষ তাহার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া গাঢ়স্বরে বলিতেন — “মঙ্গলদীপ আপনিই জ্বলে না রত্নাবলী, তাহাকে প্রজ্বলিত করিবার জন্য অগ্নিশলাকার প্রয়োজন হয়।”
উভয়ে পরস্পরের মুখোপরি সপ্রেম দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেন।
দীপান্বিতাকে তাঁহার বাহুডোরে বেষ্টিত করিয়া সবল আলিঙ্গনে তাহার কোমল তনুটি নিষ্পেষিত করিবার, তাহার ঈষদোন্মুক্ত অধরে আপন প্রেমচুম্বন অঙ্কিত করিবার প্রবল বাসনায় হর্ষবর্ধনের ইন্দ্রিয়সকল উত্তেজিত হইয়া উঠিত — রাজা তাঁহার প্রতিটি রোমকূপে বিপুল উন্মাদনা অনুভব করিতেন।
কঠোর চেষ্টায় স্বীয় রিপু দমনপূর্বক পুষ্যভূতি কুলতিলক আপনাকে সংযত করিতেন। তিনি যে সম্রাট! প্রেমাস্পদার আসঙ্গলিপ্সার এই কৈশোরোচিত অধীরতা কি তাঁহাকে শোভা পায়? মধ্যে মধ্যে তাঁহার মন প্রশ্নসঙ্কুল হইয়া উঠিত — দীপান্বিতার হৃদয়ও কি সমান আবেগে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে? সে কেমন করিয়া তাহা দমন করিয়া থাকে? পরমুহূর্তেই ভগিনী রাজ্যশ্রীর স্নিগ্ধশীতল, তপস্বিনী মূর্তি তাঁহার মানসপটে ভাসিয়া উঠিত। স্ত্রীসম্ভোগ অনভিজ্ঞ হর্ষের বোধ হইত, নারীর আত্মসংযম পুরুষ অপেক্ষা অধিক — তাহারা সম্ভবত অনায়াসেই জিতেন্দ্রিয় হইতে পারে। দীপান্বিতার অলক্ষ্যে রাজা একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস মোচন করিতেন।
কিয়ৎকাল পরে হর্ষের চিন্তাজাল ছিন্ন করিয়া প্রাসাদের সিংহদুয়ারে প্রহরশেষের ভেরী বাজিয়া উঠিত। দীপান্বিতা তাঁহাকে নতমস্তকে অভিবাদন জানাইলে রাজা স্মিতমুখে নিষ্ক্রান্ত হইয়া যাইতেন।
দীপান্বিতা পরিপূর্ণ হৃদয়ে আপন প্রকোষ্ঠে ফিরিয়া আসিত। শয়নের পূর্বে জগদীশ্বরকে করজোড়ে প্রণাম জানাইয়া আপ্লুতস্বরে কহিত — পরার্থে সুস্থিতমতি নৃপতি হর্ষকে ভগবান সিদ্ধার্থ যেন সিদ্ধিদান করেন, সুগত যেন সমগ্র পুষ্যভূতি সামাজ্যের প্রজাদিগকে সার্থকতা দান করেন।
সিদ্ধার্থস্য পরার্থ সুস্থিত মতেঃ সন্মার্গমভ্যস্যতঃ
সিদ্ধিঃ সিদ্ধিমনুত্তরাং ভগবতস্তস্য প্রজাসু ক্রিয়াৎ —
কোনও এক যূথীপুষ্পসুরভিত চৈত্রসন্ধ্যায় কান্যকুব্জের প্রাসাদভ্যন্তরে যখন উপরোক্ত মধুর দৃশ্যপট রচিত হইতেছিল, তখন সুদূর পূর্বাঞ্চলে গৌড়রাজ্যের সীমানাস্থিত রোহিতাশ্বগড় জয়স্কন্ধাবারে সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ চিত্রের অবতারণা হইয়াছিল।
জয়স্কন্ধাবারের নিভৃতকক্ষে গৌড়ের অধীশ্বর শশাঙ্কদেব ভ্রূকুটিলাঞ্ছিত ললাটে একাকী পিঞ্জরাবদ্ধ শার্দূলের ভঙ্গিমায় পাদচারণা করিতেছিলেন। তাঁহার পদক্ষেপে স্বভাববিরুদ্ধ অস্থিরতা প্রকাশ পাইতেছিল।
সায়াহ্নে প্রহরশেষের পটহ বাজিয়া উঠিল। দ্বারী আসিয়া সংবাদ দিল — দন্ডভুক্তির মহাপ্রতিহার, রাজার অন্তরঙ্গ জীবদত্ত তাঁহার সাক্ষাৎপ্রার্থী। রাজা সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মস্তক আন্দোলিত করিলেন। অনতিপরেই কক্ষমধ্যে জীবদত্ত প্রবেশ করিলেন।
যথাবিহিত অভিবাদনাদির পরে জীবদত্ত প্রশ্ন করিলেন — “তবে ফিরিয়া যাওয়াই স্থির?”
“হাঁ” — রাজা চিন্তান্বিত মুখে কহিলেন — “কর্ণসুবর্ণ অরক্ষিত পড়িয়া রহিয়াছে।”
জীবদত্ত কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত কন্ঠে বলিলেন — “যুবরাজ রহিয়াছেন। কর্ণসুবর্ণের জন্য চিন্তা নিষ্প্রয়োজন মহারাজ!”
শশাঙ্ক অধীরকন্ঠে কহিলেন — “না! মানব অপরিণত যুবক! ভাস্করবর্মাকে আমি তিলেক বিশ্বাস করি না। সে যে কোনো মুহূর্তে অপ্রস্তুত কর্ণসুবর্ণ আক্রমণ করিতে পারে।”
ক্লান্তভাবে সিংহাসনে উপবেশন করিয়া শশাঙ্ক উত্তপ্ত মস্তক হইতে উষ্ণীষ উন্মোচন করিলেন। দীর্ঘ কেশরাশির মধ্য দিয়া অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে সক্ষোভে বলিয়া উঠিলেন – “দেবগুপ্ত! আমার একমাত্র সখা মালবরাজ দেবগুপ্ত আর ইহলোকে রহিল না জীবদত্ত! ক্রূর রাজ্যবর্ধন তাহাকে স্বহস্তে হত্যা করিল! যতবার আমি তাহার এই শোচনীয় পরিণতির কথা চিন্তা করি, গভীর অনুশোচনায় আমার অন্তর পূর্ণ হইয়া যায়। কেন আমি ঐ অভিশপ্ত ক্ষণে তাহার পার্শ্বে রহিতে অসমর্থ হইলাম? দুর্গম বিন্ধ্যাঞ্চলে অপরিচিত যাত্রাপথে আমার বিলম্বই তাহার কাল হইল! আমি সমস্ত জীবন আপনাকে ক্ষমা করিতে পারিব না জীবদত্ত!”
জীবদত্ত নীরবে নতমস্তকে শশাঙ্কের খেদোক্তিসকল শ্রবণ করিতেছিলেন। পূর্বেও অসংখ্যবার শ্রবণ করিয়াছেন। অবশেষে তিনি মৃদুস্বরে কহিলেন — “আপনার আক্ষেপ যথার্থ মহারাজ! কিন্তু আপনি তো প্রতিশোধ লইয়াছেন! মালবের জঙ্গলাকীর্ণ প্রান্তরে রাজ্যবর্ধন আপনার প্রেরিত আততায়ীর দ্বারা নিহত হইয়াছে। হর্ষবর্ধন সহোদরাকে উদ্ধার করিয়া নিজভূমে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে। তাহার ভগিনীপতির মৌখরীরাজ্য ছারেখারে গিয়াছে। সে আর প্রতি আক্রমণ করিতে সাহস করিবে বলিয়া প্রত্যয় হয় না। এমতাবস্থায় কান্যকুব্জ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করিলে আমাদের লাভের অধিক কিছু হইবে না রাজন! আপনি আজ্ঞা করুন। হর্ষবর্ধন সহজেই পরাভব স্বীকার করিবে!”
শশাঙ্কের ভ্রূকুটি ভয়াল ভাব ধারণ করিল। মন্দ্রগম্ভীর কন্ঠে তিনি বলিলেন — “হর্ষবর্ধনকে তুমি এখনও চিনিতে পারো নাই জীবদত্ত। সে কখনোই পরাভব স্বীকার করিবে না। তাহার ভ্রাতাকে আমি ছল করিয়া নিধন করাইয়াছি, সেই প্রতিশোধ সে অবশ্য লইবে। আমাকে হত্যা করিবে না, তাহার বৌদ্ধধর্মে আগ্রহ হইয়াছে! আপন রাজসভায় সযত্নে কতিপয় দেশীয় ও বিদেশী বুদ্ধ-সেবাদাসকে লালন করিতেছে শুনিতে পাই” — তীব্র ব্যঙ্গের অভিঘাতে তাঁহার মুখমণ্ডল বিকৃত হইয়া গেল। তিনি বলিয়া চলিলেন — “সে আমার প্রাণাধিক প্রিয় গৌড়বঙ্গকে ধর্মচ্যুত করিবে — দিকে দিকে মন্দির ভাঙিয়া চৈত্য নির্মাণ করাইবে, সমগ্র সমতটকে সেই নগ্নপদ মুন্ডিতমস্তক ভিক্ষুর নামে দীক্ষিত করিবে, পুন্ড্রবর্ধন হইতে দন্ডভুক্তি অবধি দেবাদিদেব মহাদেবের চিহ্নসকল মুছিয়া যাইবে! ওহহ –” নিগূঢ় মানসিক যন্ত্রণায় তাঁহার যেন কন্ঠরোধ হইবার উপক্রম হইল।
ক্ষণকাল পরে আপনাকে সংবরণ করিয়া গম্ভীরস্বরে গৌড়াধিপতি কহিলেন — “জীবদত্ত, মহাসামন্তকে স্কন্ধাবার উত্তোলন করিতে আদেশ করো। আমি আর কনৌজ অভিমুখে অগ্রসর হইব না। কল্য প্রাতে আমি কর্ণসুবর্ণ যাত্রা করিব।”
পক্ষকাল পরে বুদ্ধগয়ায় মহাদুর্যোগ ঘনাইয়া আসিল। গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক সৈন্যসমভিব্যাহারে বুদ্ধগয়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
তাঁহার আজ্ঞাপ্রাপ্ত সৈন্যদল নির্মম উন্মাদনায় মহাপুণ্যময় বোধিবৃক্ষ কাটিয়া ফেলিল।
অনুশোচনাহীন রাজা ইহাতেও সন্তুষ্ট হইলেন না। তাঁহার আদেশে সৈন্যরা বৃক্ষমূল উৎপাটিত করিয়া শিকড়ে অগ্নিসংযোগ করিয়া দিল। নীরব ব্যথায় সমবেত শ্রমণদিগের চক্ষু হইতে দরদরধারে অসহায় অশ্রু নির্গত হইতে লাগিল।
নির্বোধ নিষ্ঠুরতায় হাহারবে অট্টহাস্য করিয়া শশাঙ্ক সিংহনাদ করিলেন —
“পাটলীপুত্রে বুদ্ধপদাঙ্কিত শিলাখণ্ড গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিয়াছি! এইবার গয়ার বুদ্ধমূর্তি অপসারণ করিয়া সেই স্থলে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিব! গৌড়বঙ্গের প্রতিটি উপাসনাগৃহে মহা সমারোহে রুদ্রের অভিষেক হইবে!”
তাঁহার বিক্রমবাক্যে আকাশ শিহরিত হইল, বাতাস মথিত হইল – সমবেত জনমন্ডলী ত্রাসে কম্পিত হইয়া উঠিল।
।কেবল আপন মূঢ় মদগর্বী সন্তানের আস্ফালন প্রত্যক্ষ করিয়া অনন্তের অন্তরাল হইতে রুদ্র মৃদু হাস্য করিলেন।
(ক্রমশ)