করোনার ভ্যাকসিন কবে বাজারে আসবে ? এই প্রশ্ন এখন গোটা বিশ্বেরই ৷ করোনার টিকা তৈরির গবেষণায় নেমে পড়েছেন চীন, আমেরিকা, জার্মান, ভারত-সহ আরও অনেক দেশের গবেষকরাই ৷ প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও থেকে কিছু আশার খবর আসছে ৷ যদিও করোনার প্রতিষেধক যে তাঁরা তৈরি করে ফেলেছেন, এমন ১০০ শতাংশ দাবি কেউই এখনও পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি ৷ তার মধ্যেই আশার খবর শোনালেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট ৷ তাঁর দাবি, এ বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে করোনার ভ্যাকসিন ৷ গিলবার্ট ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানী দল দাবি করছেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা সম্ভব হবে। তিনি এও জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ১০লক্ষ ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।
ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক সারা গিলবার্টের নেতৃত্বে বিজ্ঞানী দলে আছেন, অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড, টেরেসা লাম্বে, অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল ও ডঃ স্যান্ডি ডগলাস। ইংল্যান্ডের থেমস ভ্যালিতে চলবে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল পর্ব। ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের জন্য ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ৫১২ জন পুরুষ ও মহিলার স্ক্রিনিং চলছে। এদের উপর ট্রায়াল সফল হলে পরবর্তী পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের উপর ট্রায়াল হবে।এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ৫ হাজার মানুষের উপর ট্রায়ালের পর এটি সফল কিনা জানা যাবে। সারা গিলবার্ট এই ট্রায়াল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, আমরা আশাবাদী এই পরীক্ষায় অবশ্যই সাফল্য আসবেই। তাঁর আরও দাবি, এই ভেক্টর ভ্যাকসিন ইবোলার মতোই নষ্ট করে দেবে সার্স, কভ-২ আরএনএ ভাইরাল স্ট্রেইনকে।
কোভিড-১৯ এর মোকাবিলার জন্য তৈরি এই প্রতিষেধকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘চ্যাডক্স ১’ ভ্যাকসিন।
এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বে সাড়ে ২৬ লাখ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছে্ন ১ লাখ ৮৬ হাজার জন। ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হলে বিশ্বের বিপর্যয় শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না। বিশ্বে করোনার থাবা বসানোর পর থেকেই টিকা আবিষ্কারের পথ খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিলেন দেশ ও বিদেশের বিজ্ঞানীরা। ফেব্রুয়ারির শেষে ইসরায়েল দাবি করেছিল, তারা প্রথম করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে আসবে। প্রায় দুই মাস পেরিয়েছে, কোনো খবর নেই। আমেরিকায় একটি এবং চীনের দুটি সংস্থাও প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু সেগুলো সময়সাপেক্ষ। অনিশ্চয়তার এই আবহে ব্রিটেনে শুরু হচ্ছে মানুষের উপর সম্ভাব্য প্রতিষেধকের পরীক্ষা।
সারা গিলবার্ট বলেছেন, আমরা আশা করতে পারি করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য তৈরি এই প্রতিষেধক আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। তবে এই মুহূর্তে প্রতিষেধকের প্রয়োজন রয়েছে বিশ্বের সর্বত্র। বিপুল পরিমাণ মানুষের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন এখন থেকেই শুরু করা দরকার।
ইবোলার প্রতিষেধক তৈরিতে দিশা দেখানো গিলবার্ট বলেন, ‘আমি এ ধরনের প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করেছি। মার্স-এর প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করেছি। এর কী ক্ষমতা তা জানি। আমার বিশ্বাস, এই প্রতিষেধকের কাজ করবে।’
স্কুলজীবন থেকেই মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক ছিল অধ্যাপক গিলবার্টের। ১৯৯৪-এ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। ২০০৪-এ ভ্যাক্সিনোলজির রিডার হিসেবে নিয়োগ করা হয়ে তাকে। অক্সফোর্ডে হিউম্যান জেনেটিক্স প্রজেক্টের জন্য এসেছিলেন তিনি। এক সংবাদমাধ্যমকে এমনটাই জানিয়েছেন সারা।
জানুয়ারি থেকে গবেষণা শুরু করেছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জেনার ইনস্টিটিউট’ ও ‘অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ’। শুক্রবার দু’জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। অক্সফোর্ড ও সাউদাম্পটনে পরীক্ষা চলবে। পরে আরও তিনটি জায়গায় শুরু হবে ট্রায়াল। বিজ্ঞানীদের আশা, ফাইনাল পরীক্ষা’ সফল হলে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই মিলে যাবে প্রতিষেধক। প্রথম ভ্যাকসিন নেন এলিসা গ্রানাটো। তিনিও এক জন বিজ্ঞানী। জানিয়েছেন, বিজ্ঞান গবেষণায় সাহায্য করতেই ট্রায়ালে অংশ নিয়েছেন।
অংশগ্রহণকারীদের দু’দলে ভাগ করা হয়েছে। এক দলকে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। অন্য দলকে মেনিনজাইটিসের। কাকে কী দেওয়া হচ্ছে, অংশগ্রহণকারীদের জানানো হবে না। তাঁদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
নয়া এই ভ্যাকসিন সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, এটি একটি ‘অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন’। অ্যাডিনোভাইরাস একটি সাধারণ সর্দি-জ্বরের ভাইরাস, শিম্পাঞ্জিদের থেকে তৈরি। ভাইরাসটিকে ভেক্টর বা বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেক্টর ভ্যাকসিন হল এমন এক ধরনের প্রতিষেধক, যাতে ক্ষতিকর ভাইরাসটির (সার্স-কোভ-২ বা নোভেল করোনাভাইরাস) নিউক্লিক অ্যাসিড একটি বাহক মাইক্রোব (অন্য কোনও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া)-এর সাহায্যে মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হয়। বাহক মাইক্রোবটি ভাল, তারা কোনও ক্ষতি করে না। দেহে ঢুকে তারা খারাপ ভাইরাসটির নিউক্লিক অ্যাসিডের সাহায্যে কিছু প্রয়োজনীয় প্রোটিন (এ ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন) তৈরি করে ফেলে। প্রোটিনগুলোকে দেখে আমাদের শরীর মনে করে ক্ষতিকর ভাইরাসটি হামলা করেছে। সে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে। রোগ হওয়ার আগেই আমাদের দেহে সে রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। এই পদ্ধতিটি বাচ্চা থেকে বয়স্ক, এমনকি অসুস্থদের জন্যেও নিরাপদ বলে দাবি করেছেন অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা।
গিলবার্ট দাবি করেছেন, ‘এই ভ্যাকসিনটি প্রাণী এবং প্রাথমিক পর্যায়ে মানব পরীক্ষায় নিরাপদ বলে মনে হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সে কারণে এই প্রতিষেধকের উপর আমরা আস্থা রাখছি’। তাঁর আরও মত, একাধিক সুরক্ষা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাই ট্রায়াল নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন। উল্লেখ্য,গিলবার্টের দল প্রায় ১০ টি বিভিন্ন ভ্যাকসিনের জন্য একই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, সে দিক থেকে যে পথে বিজ্ঞানীগণ এগোচ্ছেন তাকে সুরক্ষিতই মনে করছে্ন তাঁরা।
তবে এই পরীক্ষার মধ্যেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিজ্ঞানী দল মনে করছেন, বিভিন্ন আবহাওয়া এবং পরিবেশে ভাইরাস যে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে এবং নিজেদেরকে পরিবর্তিত করছে তাতে এই প্রতিষেধকের কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। কারণ তাঁরা মনে করছেন ক্রমপরিবর্তনশীল ভাইরাসের জন্য কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার যথেষ্টই কঠিন ব্যাপার।
একইসঙ্গে অর্থের যোগান এই গবেষণার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যদি এই প্রতিষেধক সফল হয় যে এর চাহিদা তৈরি হবে তার যোগান দেয়ার মত অর্থ এই মুহূর্তে তাঁদের কাছে নেই। কাজেই এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরেও তা তৈরি করার কাজ কিছুটা দীর্ঘসূত্রিতায় ভুগতে পারে।
গবেষক দলের ‘চিফ ইনভেস্টিগেটর’ পোলার্ড জানিয়েছেন, সব ঠিক মতো চললে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই প্রতিষেধক (অন্তত ১০ লক্ষ ডোজ়) তৈরি হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ব্রিটেনের তিনটি ওষুধপ্রস্তুতকারী সংস্থা অক্সফোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তা ছাড়াও ইউরোপের দু’টি, একটি ভারতের ও একটি চীনের সংস্থা সঙ্গে রয়েছে। ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলে তা কাদের আগে দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে ব্রিটিশ সরকার।
তবে এ সবের পাশাপাশি পোলার্ড এ কথাও জানাতে ভোলেননি, খুবই জটিল প্রক্রিয়া। ফলে গোটা বিশ্বকে সুস্থ করার জন্য যে পরিমাণ প্রতিষেধক প্রয়োজন, তা মিলতে হয়তো এ বছরের শেষ হয়ে যাবে।