“গায়ে হাত দেবেন না”; রাগারাগির মুহূর্তে একথা কতবারই তো শুনেছেন! আবার সপ্তপদী সিনেমায় মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি ছাত্রদের ওথেলো নাটক অভিনয়ের সময়ে রিনা ব্রাউনের (অভিনয়ে সুচিত্রা সেন) সংলাপও নিশ্চয়ই মনে পড়ে। নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে ওথেলোর ভূমিকায় কৃষ্ণেন্দুর (অভিনয়ে উত্তম কুমার) অভিনয় করা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে ডেসডিমোনা রিনা শর্ত দিয়েছিলেন “ও যেন টাচ না করে”! আমার শরীরে কারুর স্পর্শ করা নিয়ে আমাদের আপত্তি তো থাকেই। আর সেই শরীরে যদি হাত দেয় রাষ্ট্র? কতটা তা মানতে পারেন আমজনতা? ব্রিটিশ আমলে সাধারণ মানুষ যে তা মানতে পারতেন না তার হরেক প্রমাণ ছড়িয়ে আছে লেখ্যাগারের নথিতে। ব্রিটিশ সরকার যখন এদেশে প্লেগের টিকার প্রচলন করল তখনকার ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন ডেভিড আর্নল্ড। ১৯৮৭ সালে “সাব অল্টার্ণ স্টাডিজ”-এর পঞ্চম খণ্ডে প্রকাশিত সে-প্রবন্ধের নামই ছিল “টাচিং দ্য বডি”। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের সময়ে দেশের মানুষের সরকারের কাজে সন্দেহের অনেক প্রমাণ আছে। প্লেগের টিকার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় পাঞ্জাবে শোনা গিয়েছিল এমন কথা যে “সূচের সাইজ লম্বায় এক গজ, শরীরে ফোটালেই হয় মৃত্যু নয় বন্ধ্যাত্ব”! উত্তর ভারতে রটে গিয়েছিল ইংরেজরা ইচ্ছে করেই এদেশে মারাত্মক ব্যাধি এনেছে যাতে রাশিয়া ভারত আক্রমণ করতে না পারে। কলকাতায় শোনা গিয়েছিল, ইংরেজরা নিজেদের রক্ষার্থে এদেশের মানুষকে বলি দিতে চায় আর সেজন্যই চলছে টিকার নামে নরমেধযজ্ঞ! আবার বসন্তের টিকার ক্ষেত্রে রটনা ছিল “টিকার উদ্দেশ্য জাত-ভাঙানো, ধর্মনাশ করা”! মোট কথা সরকারের কাজে মানুষের ছিল ঢের সন্দেহ! ইতিহাস বলে, টিকার বিরুদ্ধে জনমতের প্রধান কারণ সরকারকে বিশ্বাস করতে না পারা। এবারের কোভিডের টিকার ক্ষেত্রেও সেই সন্দেহ কি ফিরে এল?
আপনি হয় কোভিডের টিকা নিয়েছেন আর না হয় নেন নি। যদি নিয়ে থাকেন এবং দুটো ডোজই নেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই নিশ্চিন্ত বোধ করছেন এই ভেবে যে, আর ভয় নেই। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। সেই নিশ্চিন্ততা কতটা ঠিক তা বলা কঠিন কারণ টিকার দুটো ডোজ নিয়েও কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার খবরও যে আসছে না তা নয়। তবু টিকা নিয়ে আপনি কিছুটা নিশ্চিন্ত তো বটেই কারণ কোভিড প্রতিরোধ করতে পারে টিকা, এমন প্রচার আপনি বিভিন্ন সরকারি বিজ্ঞাপনে এবং গণমাধ্যমে শুনে আসছেন। কিন্তু কেউ যদি সেই সরকারি বক্তব্যকেই সন্দেহ করে?
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে বিশ্বাস করার যে খুব কিছু কারণ আছে তা নয়। সরকারি প্রচারের ঢক্কানিনাদ নিশ্চয়ই আপনার কানে এসে পৌঁছেছে যে দেশের একশো কোটি মানুষ কোভিডের টিকা নিয়ে নিয়েছেন। এটি একটি নির্ভেজাল মিথ্যে কারণ একশো কোটি টিকার ডোজ দেওয়া আর একশো কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা এক ব্যাপার নয়। মনে রাখতে হবে, যদি দেশের তিরিশ কোটি মানুষ দুটো টিকা নিয়ে থাকেন তাহলে একটা টিকা নিয়েছেন মাত্র চল্লিশ কোটি মানুষ। আর তাহলে একশো তিরিশ কোটি মানুষের দেশে একটিও টিকা নেন নি ষাট কোটি মানুষ। আর একটা মিথ্যে প্রচার হল টিকা দেওয়া হচ্ছে বিনি পয়সায় আর তার জন্য জায়গায় জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যানার লটকানো হয়েছে। কিন্তু একটু খবর নিলেই দেখবেন টিকা গ্রহণকারীদের একটা বড় অংশকেই নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে টিকা নিতে হয়েছে। এর পরিমাণ এখন টিকাপিছু ৭৮০ টাকা। আর তথাকথিত বিনিপয়সার টিকার জন্যও আমজনতার কাছ থেকেই চটজলদি টাকা আদায় করা হয়েছে বিশেষ করে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়িয়ে।
কোভিডের টিকার ক্ষেত্রে ইতিহাসের মত প্রচার হয়তো এত প্রকট নয় তবে ইতি-উতি কান পাতলে যে প্রচ্ছন্নভাবে এমন কথা শোনা যায় না, তাও বলা যায় না। একটা পত্রিকা চোখে পড়ল যার নাম “প্ল্যানডেমিক” (শিয়ালদহ, কলকাতা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১)। সে-পত্রিকার শিরোনাম দেখলে চমকে যাবেন; “করোনা টিকায় প্রাণঘাতী বিষ”, “বাঁচতে চাইলে ভ্যাকসিন থেকে দূরে থাকুন”। এই চরম টিকাবিরোধী পত্রিকাকে যদি অগ্রাহ্যও করেন তবুও অন্য “যুক্তি” শোনেন নি, তা বলতে পারবেন না! যাঁরা টিকা নেন নি তাঁদের ‘যুক্তি’ এই যে সাধারণত যতদিন ধরে পরীক্ষা করা হয়, বিশেষ করে ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’ চলে এই টিকার ক্ষেত্রে আদৌ তা করা হয় নি; চটজলদি টিকা উদ্ভাবন করা হয়েছে। স্বভাবতই অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে কোভিভ রোগের প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবিত হল? এই সন্দেহ করাটা যে অমূলক তাও বলা যায় না কারণ এর আগে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে কয়েক দশক সময় লেগেছে। সেটা মেনিনজাইটিস, হুপিং কাশি, পোলিও, হাম, হেপাটাইটিস বি সবের ক্ষেত্রেই সত্যি।
এটা ঠিক যে কোভিডের প্রতিষেধক এক বছরের কম সময়ে বের হয়ে গেছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই সংক্রান্ত গবেষণা কোভিড অতিমারির প্রাদুর্ভাব হওয়ার পরেই শুরু হল। বস্তুত করোনা ভাইরাস নিয়ে চর্চা নতুন কিছু নয়। কোভিড ১৯ বা অভিনব করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়ার দু’দশক আগে এই ধরনের ভাইরাস (ঠিক এই ভাইরাস নয়) নিয়ে গবেষণা চলছে যার সুফল আমরা পেয়েছি। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন যাঁরা তাঁদের গবেষণার ফল পরস্পরের মধ্যে আদানপ্রদান করেছেন। আর তার সঙ্গে যুক্ত ছিল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের সক্রিয় সহযোগিতা। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যায় উনিশ শতকের প্রথম দিকে যখন গুটিবসন্তের টিকা উদ্ভাবিত হয়েছিল তখনও সাহায্য আর সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের প্রধানেরা। এই তালিকায় ছিলেন রাশিয়ার জার, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি, ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন প্রমুখ। নেপোলিয়ন, এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯-১৮২৩) উদ্ভাবিত গুটিবসন্তের এই টিকা প্রথমে ১৮১২তে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক করে দেন। পরে সমাজেও বাধ্যতামূলক করেন। তবে এর বাস্তবায়ন যে খুব সহজ হয়েছিল তা নয়।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। আমার ভালর জন্য প্রতিষেধক নেওয়ার কথা বলা হলেও আমার শরীরের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কতটা তাই নিয়ে প্রশ্ন বারবারই উঠেছে। আবার এটাও সত্যি যে সরকারি উদ্যোগে টিকাকরণ ব্যবস্থা শুরু হলেও তা সবসময় সর্বত্রগামী হয়নি। ১৯৩৮সালে এদেশে গুটিবসন্তের জন্য টিকাকরণ চালু হলেও তা মোটেই পৌঁছোয় নি গ্রামীণ অঞ্চলে। প্রশ্ন উঠেছিল, এই পরিষেবা কি শুধু এদেশের সাদা মানুষদের রক্ষা করার জন্য? আর এখানেই কোভিডের টিকার তাৎপর্য। গবেষকদের উদ্ভাবনের সুফল যাতে দেশের সকল মানুষের কাছে পৌঁছোয় সেজন্য এবার এগিয়ে এসেছেন সমাজের বিভিন্ন অংশ, তাতে যেমন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা আছেন তেমনই আছেন রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীরা।