কিডনিমঙ্গল কথা অমৃতসমান
হাতুড়ে ডাক্তার ভণে শুন বন্ধুগণ
সেদিনকে চা-দোকানে বসে আছি। কদিন ধরে কোমরে ব্যথা আর হলদে হিসি সঙ্গে ইউরিন করার সময় প্রবল জ্বালা। বোধহয় কিডনির ব্যামো। ভাবছি একবার শ্রীভৃগুকে আয়ুরেখাটা দেখিয়ে আসবো কিনা। এমন সময় আমার তিন ইয়ার- অরুণ বরুণ আর কিরণমালা চায়েপে চর্চা করতে দোকানে এসে হাজির। কিরণমালা আমার মুখে চিন্তার ছ্যাটকাব্যাটকা ছাপ দেখে বললো “হুমমমমমমমমমমম”
সুন্দরী যত বলে অ্যাডমায়ারাররা তার শতগুণ বলে। সত্যি বলছি অরুণ বরুণের এই হ্যাহ্যাল্যাল্যা দেখে আমার গা পিত্তি চটকে যায়। বরুণ অবশেষে সব শুনে বললো “চ’ তোকে এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই”
কিরণমালা হুকুম দিলো “এক্ষুনি চলো” {আমার জন্য কিরণমালার এই অনুভূতি আমাকে সিক্ত করে}
খুঁজে পেতে আমাদের এখানে এক আধবুড়ো মাতাল ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া গ্যালো- যাকে এক্ষুনি এক্ষুনি পাওয়া যাবে। তিনি এখন স্বগৃহে বিরাজমান। সুতরাং কিরণমালা এবং তার দু’জন রূপমুগ্ধকে [মুগ্ধ কথাটার অর্থ হলো বোকা] নিয়ে খুঁজে পেতে ওনার দুয়ারে ঠকঠকানোয় ভেতর থেকে একটা ঘড়ঘড়ে ফ্যাসফ্যাসে শব্দ এলো। মনে হচ্ছে কেউ য্যানো বললো “খোলা আছে– ঢুকে পড়ুন”
একটা ঘর। বিছানাময় বৈ পত্তর কাগজ– একটা রীড ভাঙা হার্মোনিয়াম। মাথার ওপরে একটা নিথর ফ্যান– সেটা থেকে মোটা মোটা ঝুল ঝুলে আছে। আর ডাক্তার? মাথার কাছে বনবনে পেডেস্টাল ফ্যান চালিয়ে একটা হলদে কালো লোমশ জন্তুর গায়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে। জন্তুটার দুচোখ বন্ধ। আমাদের আওয়াজ পেয়ে প্রথমে একটা চোখ খুলে আমাদের দেখলো। তারপর দুটো চোখ খুলে দেখলো। তারপর একটা চোখ বন্ধ করে আবার দেখলো। তারপর দুটো চোখ বন্ধ করে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়লো। ডাক্তার সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো করে হাসলো “বড্ড অলস- কাউকে কামড়াবার মতো উৎসাহও নেই”
কিরণমালা জন্তুটার ভয়ে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।
ডাক্তার ঘড়ঘড়ে গলায় প্রশ্ন করলেন “কি বৃত্তান্ত? ভর দুপুর বেলা হঠাৎ বৌ বাচ্চা নিয়ে আমার কাছে?”
ক্কি ক্কান্ড? কার বাচ্চা রে বাবা? অরুণ তো আমার চে’ বয়সে বড়ো! যাগ্গে বলেই ফেলি “ইয়ে আমার বোধহয় কিডনি খারাপ হয়ে গেছে….”
টেকো খোঁচাদাড়ি লোকটা গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে ঝুলিয়ে পুরোনো ছেঁড়া স্প্রিং বার করা বাদামী সোফা কাম বেডটা দেখিয়ে বসতে ঈঙ্গিত করলো। জন্তুটা ল্যাজ আর কান নেড়ে সম্মতি জানালো। ওর ল্যাজে একটা সাদা দাগ আছে। বসার পর প্রশ্ন করলো “কি করে বুঝলেন যে আপনার কিডনি খারাপ হয়ে গেছে?”
অগত্যা আবার সবটুকু বললাম। কিরণমালা ধনুকভুরু বেঁকিয়ে বললো “জন্ডিসও হতে পারে, তাই না?”
ভদ্রলোক উঠে সিলিং ফ্যানটা চালিয়ে দিলেন। একটা ঝুলন্ত ঝুল চলন্ত ফ্যান থেকে পাক খেয়ে কিরণমালার চিকুরে এসে পড়ায় ও একখানা চিক্কুর ছাড়লো তারপরেই হিংস্র শ্বাপদটা দুটো দাঁত বার করে তাকানোয় চিৎকারটা চেপে গেলো।
“সব সময়েই কি হলুদ হিসি হয়?”
“না বেশী করে জল খেলে হয় না” চটজলদি উত্তর দিলাম।
এরপর যে প্রশ্নটা এলো কিরণমালার সামনে সেটার উত্তর দিতে লজ্জা করছিলো।
“যখন হলদে হিসি হয় তখনই জ্বালা করে এবং বিশ্রী গন্ধ হয়, তাইতো?”
লজ্জা করলেও ঘাড় নেড়ে স্বীকার করলাম।
ভদ্রলোক আবার হিংস্র লোমশ শ্বাপদটার গায়ে মাথা রেখে শুলেন। “তাহলে দাদারা দিদিরা চুপচাপ বসে না থেকে কিছু জ্ঞান শুনবেন নাকি?”
আমরা রাজি হওয়ায় উনি প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বার করলেন। কী আশ্চর্য একটা সিগারেট তো ঠোঁটে ঝুলছে – আবার সিগারেট? লোকটার খেয়াল হলো “এঃহে আগের সিগারেট টা তো ধরানোই হয় নি – আসলে বুড়ো মানুষ চোখে দেখি না তো….আসুন টপিক ধরি…”
সিগারেট ধরিয়ে শুরু করে “কিডনির কাজ হচ্ছে শরীরের দূষিত জিনিসপত্র বা ক্ষতিকর জিনিসপত্র বার করে দেওয়া … তাই তো? আমাদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে যে কার্বনডাইঅক্সাইড বেরোয় সেটা তো ভয়ানক ক্ষতিকর তাই না?” লোকটা ফসফস করে ধোঁয়া ছাড়ে। “এই কার্বনডাইঅক্সাইড জলের সঙ্গে মিশে তৈরি হয় কার্বনিক অ্যাসিড– ওটা রক্তে মিশে থাকে। ওটা বেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অক্কাপটল – বুইলেন? কিডনি ওটাকেও বার করে দ্যায়। জল কম খেলে কম হিসি তৈরি হয় তখন তুলনায় বেশী কার্বনিক অ্যাসিডের জন্যে ঐ অল্প হিসিটা বেশী অ্যাসিডিক হয়ে পড়ে- তখন জ্বালা করে। এর সঙ্গে পেটের অ্যাসিডের কোনও যোগাযোগ নেই কো”
কিরণমালা ভোলার পাত্রী নয়। “কিন্তু গন্ধ?”
“যখন ইউরিনের অ্যাসিড খুব বেড়ে যায় তখন শরীরের অ্যমোনিয়া এসে ঐ বাড়তি অ্যাসিডের থেকে অ্যামোনিয়াম তৈরি করে’ ইউরিন দিয়ে বার করে দ্যায়– ওটা অ্যাসিডিক নয়। এতে করে ইউরিনারি রাস্তাটা অ্যাসিডে পুড়ে যায় না। এর একটা নাম আছে ‘লিমিটিং পিএইচ’। আমরা অ্যামোনিয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধটাই কেবল পাই”
বরুণ বলে “কোমরে ব্যথা? ওটা তো কিডনির অসুখের লক্ষণ?”
“এই ভদ্রলোকের কোমরে ব্যথা? তো কিডনির তাতে কি?” বুড়ো ভদ্রলোক খচরখচর করে, চারটে আঙুল দিয়ে গোটা হাত নাড়িয়ে মানে ঐ জন্তুটার মতো করে পাকা দাড়ি চুলকোতে থাকে।
আমার হঠাৎ মনে হয় -ওনার দাড়িতে কি এঁটুলি আছে নাকি? ঐ হিংস্র জন্তুটাও এ সময়ে ওর সামনের পাটা টানটান করে আড়মোড়া ভাঙে। কিরণমালা ওর রক্তলাল নখ দেখে চিৎকার করে ওঠে “র নখে…. দেখুন ওর নখে রক্ত লেগে আছে…”
“না না রক্ত নয়কো- ওর নখে নখ-পুলিশ লাগিয়ে দিয়েছি, শত হলেও সুন্দরী তো- একটু সাজুগুজু করবে না?” বলে, বুড়ো ঘড়ঘড় করে হাসে।
তারপর আবার বিষয়ে ফেরে “আসলে কিডনি মোটেও কোমরে থাকে না- সুতরাং কোমরে ব্যথার বিষয়ে চাপ নেই”
আমি স্বভাবতই খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম “তাহলে প্রতিদিন আমরা কতোটা করে জল খাবো?”
আধবুড়ো আবার ঘড়ঘড় করে হাসলেন “বলছি বলছি সব বলছি”
লোমশ জন্তুটা গোলাপি রঙের জিভ বার করে ওনার হাতটা একবার চেটে তারপর ওর নিজের রক্তলাল নখগুলো চাটতে লাগলো।
বুড়ো আরম্ভ করলো “দেখেছেন তো শীতকালে মুখ থেকে ধোঁয়ার মতো কি সব বেরোয়? ওটা হলো জলীয় বাষ্প। শীত গ্রীষ্ম সব সময় ফুসফুস থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে দেখা যায় না। ক্যানো? সেটা এখানে বলবো না। ওটা পদার্থবিজ্ঞানের বইয়ে পাবেন। এটার পরিমাণ দিনে প্রায় আধ লিটার। অর্থাৎ আপনার অজ্ঞাতসারে এ্যাতোটা জল প্রতিদিন বেরিয়ে যাচ্ছে। শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে সব সময় কিছু না কিছু ঘাম হয়। ঘাম নাহলে শরীরের তাপমাত্রা ভয়ানক বেড়ে যাবে। ঘাম উবে যাওয়ার সময় লীন তাপ গ্রহন করে শরীরটাকে শীতল রাখে। এতে একেক মরশুমে একেক রকম জল বেরিয়ে যায়। তবে শীতকালেও আমাদের দেশে মোটামুটি এক থেকে দেড় লিটার জল বেরিয়ে যায়। চব্বিশ ঘন্টায় ইউরিনের পরিমাণ আধ লিটারের কম হলে কিডনির ক্ষতি হয়। তাহলে ন্যূনতম আড়াই লিটার জল পান করতেই হবে। এছাড়া হজমের জন্য এবং অন্যান্য কাজের জন্যেও জল লাগে। উচিত চব্বিশ ঘন্টায় অন্ততঃ সাড়ে তিন লিটার জল পান করা ….” ভদ্রলোক সিগারেটে শেষ সুখটানটা দিয়ে সিগারেটের স্টাম্পটা বিছানার পাশে রাখা একটা চায়ের কাপে ফেলে চিপ্টে দিলো।
“আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?” অরুণ জানতে চায়।
আধবুড়ো চশমার ফাঁক দিয়ে তাকায় “করুন। অবশ্যই করতে পারেন। একশো বার প্রশ্ন করতে পারেন”
“আমার কিডনি খারাপ হচ্ছে কিনা কি করে বুঝতে পারবো?”
কিরণমালা শিশুদের মতো হাত তালি দ্যায় “আমি জানি – আমি জানি– ইউরিয়া ক্রিয়াটিনিন পরীক্ষা করতে হয়” কিরণমালার জন্য আমার মাঝে মাঝে গর্ব হয়। কী সপ্রতিভ নারী। এক্কেরে একটি রত্ন।
কিন্তু বুড়ো ডাক্তার ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলে “হয়নি হয়নি ফেল”
“সে আবার কি আমরা তো চিরকাল জানি ইউরিয়া ক্রিয়াটিনিন কিডনির পরীক্ষা…” আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করি। আমার অনুরাগের কিরণমালার ভুল ধরায় আমার ভয়ানক রাগ হয়।
বুড়োর দাড়িগোঁফের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তিনখানা দাঁত দেখা যায়- বোধহয় হাসলেন।
“তার মানে? আমি হাস্যকর কিছু বললাম নাকি?”
“ইউরিয়া ক্রিয়াটিনিন বাড়া মানে কিডনি ইতিমধ্যেই খারাপ হয়ে গ্যাছে– তখন কিডনি আর শরীরের দূষিত বিষাক্ত জিনিসপত্র বার করতে পারছে না….”
অরুণ বরুণ কিরণমালা হাহাহাকার করে ওঠে “তাহলে? আগে জানার কোনও কি উপায় নেই?”
বুড়ো লোমশ জন্তুটার কান উল্টে দিয়ে কানের ভেতরে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলেন “কিডনির কাজ খারাপ জিনিস বার করে দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভেতরে ফেরত পাঠানো। প্রোটিন হলো রক্তের একটা দরকারি উপাদান। যখন কিডনি খারাপ হতে আরম্ভ করে তখন প্রোটিন লীক( leak) করে বেরিয়ে যায়। তখন ইউরিনে প্রোটিন পাওয়া যায়”
কিরণমালার বিষ্ময় থৈ পায় না “প্রোটিন বেরোলেই কিডনি খারাপ?”
লোমশ জন্তু বিরক্ত হয়ে নখ পুলিশ মাখা নখে কান চুলকোতে থাকে। আধবুড়ো ভদ্রলোকও বিরক্ত হন। ক্যানো কে জানে! ডাক্তারদের স্বভাবই বোধহয় বিরক্ত হওয়া।
“আরে অতো সহজে দুই আর দুইয়ে চার করবেন না। শারীরিক কসরৎ করলে বা বেশী জ্বর হলেও ইউরিনে প্রোটিন পাওয়া যেতে পারে”
আমার এবার এই একঘেয়ে কিডনি সমাচারে বিরক্ত লাগতে শুরু করে। বলি “তাহলে এই হলো কিডনি খারাপ হওয়ার লক্ষণ– তাই তো?” যেটা বলিনা সেটা হলো তাহলে এবার আমরা উঠি।
ডাক্তার বেজায় গম্ভীর হয়ে বলেন “মোটেও না- মোটেও না। কিডনির কাজ হলো ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা আর রক্ত তৈরি করা– সুতরাং হঠাৎ সহসা রক্তচাপ বেড়ে গেলে বা অ্যানিমিয়া হলেও কিডনি খারাপের কথা ভাবতে হবে। আর শরীরে সোডিয়াম পটাশিয়াম কমে বেড়ে গেলেও এই সব ভাবতে হবে। এছাড়া পা ফোলা, বুকে পেটে জল জম্ এসবও সঙ্গে থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে”
কিরণমালার পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। “আপনাদের ডাক্তারির ক্ষুরে ক্ষুরে দন্ডবৎ- এ’ও হতে পারে ও’ও হতে পারে … এতো মহা ঝামেলি মশায়– যাগ্গে এবার বিদেয় হৈ – আর সহজ ভাষায় বলবেন কি আপনার এই সুন্দরী কোন ব্রীড মানে কোন জাতের?”
আধবুড়ো চোখ বন্ধ করে খানিকটা ভেবে বলেন “ওর মাথায় কি চুল আছে?” কিরণমালা কিন্তু কিন্তু করে বলে “না …মানে খুবই ছোট ছোট….”
হাস্যমুখ ডাক্তার বলেন “তাহলে অবশ্যই এটা নেড়ি”
কি জন্যে– কী কী জানতে এসেছিলাম সব গুলিয়ে ফেলে গজভোম্বলের মতো আমরা চারমূর্তি বেরিয়ে আসি।