১৯৬২ সালের মাসের ঘটনা। ৪ আগস্ট সরলবালা গোস্বামী নামে এক রোগিণীকে পুরুলিয়া জেলার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সঠিক চিকিৎসার অভাবে ৩৬ ঘণ্টা পর রোগিনীর মৃত্যু হয়।[1] তবে চিকিৎসার গাফিলতি হলেও রোগিণীর আত্মীয়রা হাসপাতাল ভাঙচুর করেননি কিংবা হাসপাতালের কর্মীদের মারধোর করেন নি। এবার দীর্ঘ ছয় দশক পরের দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক।
২০১৭ সালের আগস্ট, পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে কল্পনা পাত্র নামে এক প্রসূতিকে মেদিনীপুর মেডিক্যালে রেফার করা হলে রোগীর আত্মীয়রা হাসপাতালে এসে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলা করে। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক রজত পালকে মারধোর করা হয় এবং তাঁর গায়ে মানুষের বিষ্ঠা মাখিয়ে দেওয়া হয়।[2] এই ঘটনা সমগ্র চিকিৎসক সমাজের মনে সেদিন ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। যার ফলে দোষীদের শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।[3]
১০ জুন ২০১৯, নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীর মৃত্যু হলে তাঁর আত্মীয়-পরিজনেরা জুনিয়র ডাক্তারদেরকে মারধর করেন। এর প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এনআরএস-এর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিলেন তাঁরা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতার অন্যান্য হাসপাতালেও।[4]
এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক সদ্য ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার দিকে। ১৫ এপ্রিল ২০২২, জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গলের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানাচ্ছে “আজ সকালে নিমতা নিবাসী ডা গৌরব রায়ের কাছে এক বুকের ব্যথার এক রোগীকে নিয়ে আসা হয়। ডা রায় রোগীকে দেখে একিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন অর্থাৎ হার্ট এটাক সন্দেহ করেন এবং যথোপযুক্ত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের বাসস্থানে হার্ট এটাকের চিকিৎসার পরিকাঠামো থাকে না, তাই রোগীর কোনও চিকিৎসা তিনি করেননি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রোগীর মৃত্যু হওয়ার পর রোগীর পরিবার এক বিশাল জনতাকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসকের বাসস্থান আক্রমণ করে । বাড়ি ও আসবাব পত্র ভাঙচুর করে এবং চিকিৎসক ও তাঁর পরিবারের মানুষজন প্রহৃত হন।”
তবে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনার উদাহরণ থেকে আমরা বুঝলাম চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু যে বিষয়টি নতুন তা হল চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা। আর এই ধরণের ঘটনার সূত্রপাত আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে। আর এখন চিকিৎসক ও রোগীর পরিবারের মধ্যে অশান্তি আমাদের রাজ্য তথা দেশে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যেকার বিশ্বাসের সম্পর্কে আজ চিড় ধরেছে। যার ফলে দুর্গাপূজার থিমে চিকিৎসককে অসুর রূপে চিত্রায়িত করা হয়েছে।[5] বর্তমান প্রবন্ধে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের পরিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই আলোচনায় সত্তর-আশির দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের পরিবর্তনগুলিকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে।
সমাজে আর পাঁচটা পেশার থেকে চিকিৎসা পেশা একটু আলাদা। চিকিৎসকের পেশা হল সেবাধর্মী। রোগীকে সুস্থ জীবন উপহার দেওয়া চিকিৎসকের প্রধান কাজ। একজন চিকিৎসকই পারেন মৃতপ্রায় রোগীকে বাঁচিয়ে তুলেতে। তাই চিকিৎসকের স্থান ভগবানের ঠিক পরেই বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে প্রাচীন কাল থেকেই চিকিৎসকেরা সমাজে এক বিশেষ সম্মান পেয়ে এসেছেন। চরক ও সুশ্রুত সংহিতায় অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রে চিকিৎসক ও রোগী উভয়কেই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে একজন রোগী নিজের পিতা-মাতা, পুত্র এবং অন্যান্য সম্পর্ককে অবিশ্বাস করতে পারেন কিন্তু তার নিজের চিকিৎসকের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে। একজন রোগীর কোনও ঝুঁকির আশঙ্কা ছাড়াই বিনা প্রশ্নে নিজের জীবনকে চিকিৎসকের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। তাই একজন চিকিৎসকের সর্বোচ্চ ধর্ম হওয়া উচিত রোগীকে তার নিজের সন্তান হিসেবে রক্ষা করা। একজন আদর্শ চিকিৎসকের গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে- যে চিকিৎসক লাভের জন্য বা ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য নয় জীবের প্রতি মমত্ববোধ থেকে চিকিৎসা করবেন। যার ফলে তিনি সকলকে ছাড়িয়ে সবার উপরে অবস্থান করবেন।[6]
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাঁরা হিপোক্রেটিসকে (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০ অব্দ) চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলে মনে করেন। তবে অনেক ভারতীয় পণ্ডিত মনে করেন যে চরক ও সুশ্রুতের আবির্ভাব হয়েছিল হিপোক্রেটিসের আগে। তাই হিপোক্রেটিস এবং চরক-সুশ্রুতকে একই আসনে বসানো উচিত। সে যাইহোক সর্বজনীন মত হল গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস কুসংস্কারের অপসরণ করে চিকিৎসাবিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। তবে যে বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক তা হল যুক্তিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি চিকিৎসা সম্পর্কে এক নৈতিক ধারণাও দিয়েছিলেন হিপোক্রেটিস। তাই আজও সমগ্র বিশ্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের হিপোক্রেটিসের শপথ নিতে হয়।[7] অবশ্য এই শপথ প্রকৃতপক্ষে কে লিখেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা বা উভয়ের মঙ্গল সাধনের জন্য যে এই শপথ গ্রহণের নিয়ম চালু করা হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। চিকিৎসককে নীতিপরায়ণ করে তোলাও ছিল এর উদ্দেশ্য। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই শপথের সংস্করণও করা হয়েছে অনেকবার। শপথের কিছু অংশের বক্তব্য ছিল এইরকম— “আমি অবশ্যই, আমার সাধ্যমতো ও বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী আমার রোগীদের ভালোর জন্য ব্যবস্থাপত্র লিখব এবং কখনই কারও ক্ষতি করবো না। কাউকে খুশি করার জন্য আমি মারাত্মক কোনও ওষুধ লিখব না বা পরামর্শ দেব না, যা তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। …আমি আমার জীবন এবং আমার বিদ্যার পবিত্রতা রক্ষা করব।…প্রতিটি বাড়িতে আমি কেবল আমার রোগীদের ভালোর জন্য প্রবেশ করব। নিজেকে সমস্ত রকম ইচ্ছাকৃত দুর্ব্যবহার এবং মোহাবিষ্ট করা থেকে দূরে রাখব।…”[8] চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক নিয়ে হিপোক্রেটিসের উক্তি হল— “রোগ, রোগী, ও চিকিৎসক হল চিকিৎসাবিদ্যার তিনটি অংশ। চিকিৎসক হলেন চিকিৎসাবিদ্যার সেবক। রোগীর কর্তব্য রোগ মোকাবিলায় চিকিৎসককে সহযোগিতা করা।”[9]
মুঘল যুগেও এদেশে চিকিৎসকের নৈতিকতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হয়েছে। ১৫৯০-৯১ সালে বদায়ুনী লিখেছিলেন ‘নিজাতুর রসিদ’। যেখানে বলা হয়েছে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য চিকিৎসক বই পড়বেন এবং রোগীর স্বার্থ দেখা তাঁর প্রধান কর্তব্য।[10] এছাড়া মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার কোড অব মেডিক্যাল এথিক্সে চিকিৎসকদের বিভিন্ন কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেক চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সময় তাদের দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে হয়।[11] হিপোক্রেটিসের যুগ থেকে চলে আসা চিকিৎসক ও রোগীর এই বিশ্বাসের সম্পর্ক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ঘরানায় ফিডিউশিয়ারি মডেল নামে পরিচিত। ল্যাটিন ‘ফিডিউশিয়া’ (বিশ্বাস) শব্দ থেকে এসেছে এই নাম।[12] উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পারলাম চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক একটা দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। চিকিৎসা হল একটি মহৎ পেশা। কিন্তু বর্তমানের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত বলে মনে করা হচ্ছে সত্যিই কি এই রকম সম্পর্ক কোনও দিন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের সাহায্য নিতে হবে। আসলে সাহিত্য বা চলচ্চিত্রের মধ্যেই তো সমাজে বিভিন্ন সম্পর্ক বা তার বদলের প্রতিচ্ছবি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। তাই আমরা এবার দেখব সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের দার্শনিক দিকটি কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
চিকিৎসাবিষয়ক সাহিত্যের কথা বলতে গেলে আমাদের প্রথমেই মনে পড়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’[13] উপন্যাসের কথা। এই উপন্যাস একদিকে যেমন আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতির সংঘাতের চিত্র তুলে ধরেছে তেমনি অন্যদিকে চিকিৎসক ও রোগীর আত্মীয়তার সম্পর্ককেও উপস্থাপন করেছে। আমরা দেখেছি জীবন ডাক্তার বা প্রদ্যোত ডাক্তারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলেও একটা বিষয়ে তাদের মিল ছিল, দু’জনেরই ছিল আদর্শ চিকিৎসকের এক সত্তা। জগবন্ধু মশায়ের (জীবন ডাক্তারের বাবা) বন্ধু ঠাকুরদাস তাঁকে বলেছিলেন অর্থ লাভই হল ডাক্তারের প্রধান লাভ, এক্ষেত্রে রোগীর কোনও লাভ নেই সে শুধু ধনেপ্রাণে মরে। প্রত্যুতরে তিনি ঠাকুরদাসকে বলেছিলেন “পয়সার কথাটা পরের কথা। যে লাভ বললাম সে লাভ পয়সার নয়, অথচ ওটাই সংসারের শ্রেষ্ঠ লাভ। একপক্ষের (রোগীর) লাভ আরোগ্যলাভ, অন্যপক্ষের লাভ সেবার পুণ্য।”[14] পিতার দেখানো পথেই চলেছিলেন জীবন দত্ত অর্থাৎ জীবন মশাই তবে তিনি কবিরাজির সাথে সাথে ডাক্তারিও করতেন। তাঁর সম্পর্কে লেখক বলেছেন “…বাপের আমল থেকে তাঁর (জীবন মশাই) আমল পর্যন্ত বিনা ফি-তেই গরিবগুনা মধ্যবিত্তদের ঘরে চিকিৎসা করে এসেছেন।”[15] উপন্যাসে আমরা দেখেছি চিকিৎসকের প্রতি ভালবাসা থেকেই পরান খাঁ জীবন ডাক্তারের বাড়িতে উপহার পাঠিয়েছেন। লেখক বলেছেন “পুরানো কালের লোক পরান; এখনও ভালোবাসার মূল্য দেয়। ক্ষেতের ফসল, পুকুরের মাছ ডাক্তারের বাড়ি মধ্যে মধ্যে পাঠায়। কখনও নিজেই আসে।… ডাক্তারের উপর অগাধ বিশ্বাস পরানের।”[16] অন্যদিকে আধুনিক চিকিৎসার প্রতিনিধি প্রদ্যোত ডাক্তারের কাছেও অর্থের পরিবর্তে রোগীর কল্যাণই ছিল মুখ্য। আর তাই তিনি মতির মা’কে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন “নাঃ, বেঁচে যাবে বুড়ী।… ওকে মরতে আমি দেব না।”[17]
চিকিৎসক তথা সাহিত্যিক বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) কর্তৃক সৃষ্ট দুটি অসাধারণ ডাক্তারি চরিত্র হল অগ্নীশ্বর ও সদাশিব ভট্টাচার্য। অগ্নীশ্বর মুখোপাধ্যায় হলেন ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত “অগ্নীশ্বর”[18] উপন্যাসের নায়ক। তিনি একজন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। কিন্তু রোগীর প্রতি তিনি ছিলেন সহৃদয়। তিনি কারোর কোনও উপকার করলে এই বিষয়ে কাউকে জানতে দিতেন না। এটা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বিশেষত্ব। তিনি জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সেবার আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হন নি।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত বনফুলের “হাটে বাজারে”[19] উপন্যাসের নায়ক ডাক্তার সদাশিব ভট্টাচার্য। যিনি বুঝেছিলেন আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি ছিলেন হাসপাতালের সিভিল সার্জেন। তবে তিনি শুধু হাসপাতালে রোগী দেখতেন না, হাসপাতাল ছাড়াও হাটেমাঠে, বস্তিতে নিম্নবর্গ মানুষের সেবা করতেন। গরিব কিংবা ধনী বাছবিচার না করে কল এলেই ছুটে যেতেন রোগীর কাছে। তিনি গরিব মানুষের কাছে থেকে অর্থ নিতে চাইতেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া নিম্নবর্গের মানুষের কাছের মানুষ, তাদের অভিভাবক। কাউকে মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে তাঁকে ছাড়াতে ছুটে যেতেন ডাক্তারবাবু। আমরা দেখেছি কেবলির স্বামী নারায়ণকে পুলিশ জেল থেকে মুক্তি না দেওয়ায় কেবলি বলেছেন “…আপনি একটা ব্যবস্থা করুন ডাক্তারবাবু। আপনিই তো আমাদের মা বাপ।”[20] চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর ডাক্তারবাবু সাধারণ মানুষের সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেন গরিব মানুষগুলোর চিকিৎসার জন্য। তিনি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন – “ভ্রাম্যমাণ ডাক্তার হব ঠিক করেছি। গ্রামে গ্রামে হাটে বাজারে ঘুরব। চিকিৎসা করব সাধারণ লোকেদের। চিকিৎসা করব পয়সা রোজগার করবার জন্য নয়, নিজের তাগিদে।”[21] ইতিহাস ঘাটলে আমরা এই রকম অনেক বাজার চিকিৎসকের সন্ধান পাবো। মানুচির ‘স্টোরিয়া দো মোগর’ বা বদায়ুনীর ‘মুন্তাখাব-উত তওয়ারিখ’ থেকে মুঘল যুগে এক ধরণের ‘বাজার’ চিকিৎসকের কথা জানা যায়, যাঁরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন।[22] স্বাস্থ্য সমাচার পত্রিকার সম্পাদক কার্তিকচন্দ্র বসুও বাজার ডক্টর ছিলেন। যিনি আমৃত্যু অল্প ফী’তে গরিব মানুষের চিকিৎসা করেছিলেন।[23]
উপন্যাসের গল্পকে অবলম্বন করে আরোগ্য নিকেতন,[24] অগ্নীশ্বর,[25] হাটে বাজারে[26] তিন নামেই চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। চলচ্চিত্রকে মানুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে একটু-আধটু বদল আনা হলেও মূল বক্তব্যের কোনও পরিবর্তন করা হয় নি। এই চলচ্চিত্রগুলি আজও সকলের কাছে সমাদৃত।
সাম্প্রতিক উপন্যাস “অবিরাম জ্বরের রূপকথা”[27]তেও অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আগেকার দিনের চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যেকার সুসম্পর্কের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায় কখ সাহেবের দল কলকাতার ডাক্তারদের সামনে প্রথম কলেরার জীবাণু আবিষ্কারের কাহিনী শোনাবেন। যাঁরা কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করেছেন স্বয়ং তাদের মুখ থেকে জীবাণু কালচারের পদ্ধতির ব্যাখ্যা শোনার জন্য চিকিৎসক দ্বারিকানাথ তাঁর ব্রুহ্যামে গাড়ীতে করে ছুটে চলেছেন। কিন্তু পথের মধ্যে তিন জন এসে দ্বারিকার গাড়ি থামাই এবং তাঁকে নিয়ে যেতে চান। একজন বলেন “তার ভাইয়ের একেবারে হু-হু হাতপোড়া জ্বর। এলাকার কোনও এক ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে জ্বর তো কমেনি, উলটে আরও বেড়ে গেছে”।[28] প্রথমে দ্বারিকা তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। নাকচ করাটাই স্বাভাবিক কারণ এমন সুযোগ কেউ কি হাতছাড়া করতে চায়। কিন্তু যখন বয়স্ক লোকটি বলেন “ডাক্তার মশাই একবার চলুন, আমার বন্ধুর একমাত্র ছেলে…যদি মারা যায়”[29] তখন দ্বারিকানাথের চিকিৎসক সত্তা আর না করতে পারে নি। দ্বারিকা বলেন “চলুন..যাব আপনার সঙ্গে”।[30]
তবে শুধু সাহিত্যের চরিত্রের কথাই আমরা মনে রাখি নি। পাশাপাশি আমরা বাস্তবে বেশ কিছু আদর্শ চিকিৎসকের কথাও মনে রেখেছি, যাঁদের মধ্যে দু’জন হলেন ডাঃ নীলরতন সরকার (১৮৬১-১৯৪৩) ও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় (১৮৮২- ১৯৬২)। ১৯৪৩ সালে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ডাক্তার নীলরতন সরকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন “মানুষকে রোগ-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে হবে, মানুষকে বাঁচাতে হবে এই ছিল তাঁর আজীবন সাধনা। …যখন কোন রোগীকে তিনি হাতে নিয়েছেন টাকার কথা হয়ে গিয়েছে তাঁর কাছে তুচ্ছ। রোগী পয়সা দিতে পারবে কি না তা কখনও ভাবেন নি।… রাজা-রাজড়ার ঘরেও যেমন এই সব নিতান্ত সামান্য লোকের ঘরেও ঠিক তেমনি করেই তিনি চিকিৎসা করেছেন।… রোগীর চিকিৎসা করার সময় তিনি সত্যিই আহার নিদ্রা ভুলে যেতেন।”[31] অন্যদিকে বিধানচন্দ্র রায় শুধু বিনা পয়সায় গরিবের চিকিৎসা করেন নি, প্রয়োজনে তাঁদের ওষুধের ব্যবস্থাও করেছেন। যাঁদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা নিতে আত্মসম্মানে লাগবে অথচ সম্পূর্ণ ফি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাঁদের জন্য তিনি তাঁর বাড়িতে চ্যারিটি বাক্স রাখতেন যেখানে সবাই নিজেদের সাধ্য মত অর্থ দিতেন। অবশ্য এইসব টাকা তিনি গরিবদেরই দিয়ে দিতেন।[32] এই দৃশ্য আমরা হাটে বাজারে সিনেমাতেও দেখেছি। বিধান রায় সম্পর্কে শোনা যায় সারাদিন রোগী দেখার পর কল এলেও তিনি রোগী দেখতে যেতেন।[33] এই কিংবদন্তি চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিন ১ জুলাই তারিখটিকে সারা ভারতে চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু বিধান রায় যে সবার কাছে প্রিয় ছিলেন তা বলা যাবে না। একবার সমর সেনের ঠাকুর্দা অসুস্থ হলে বিধান রায় তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি গিয়ে প্রথমেই তাঁর ‘ফি’ চেয়ে বসেছিলেন আর এতেই তাঁরা বিরক্ত হয়ে নীলরতন সরকারকে ডেকেছিলেন।[34] এই বক্তব্য আমরা জানতে পারি সমর সেনের স্মৃতিকথা থেকে। অবশ্য অগ্নীশ্বর তো এই ধরণের মানুষ ছিলেন।
এপর্যন্ত আলোচনায় চিকিৎসক-রোগীর সুমধুর সম্পর্কের কথা জানলাম। এবার জানব পারিবারিক চিকিৎসকের কথা যারা রোগীর শুধু চিকিৎসা করতেন না, রোগীর খেয়ালও রাখতেন। অবশ্য উপরে বর্ণিত চিকিৎসকেরা পারিবারিক চিকিৎসকের ভূমিকাই পালন করতেন। কোনও পরিবারের কাছে চিকিৎসক ছিলেন পরিবারেরই একজন সদস্য। তাঁরা অনেকটা পাড়ার জ্যাঠামশাই গোত্রের কেউ। পাড়ার কোনও অনুষ্ঠানে স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের সাথে তিনিও নিমন্ত্রিত হতেন সভাপতি বা প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করতে।[35] এই সময় নামে এক বাংলা পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয়তে সুকান্ত সরকার পুরনো দিনের বাড়ির ডাক্তার সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছেন আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে কলকাতা ও শহরতলিতে এই ডাক্তারদের দেখা মিলত।[36] প্রসঙ্গক্রমে তিনি তাদের পারিবারিক চিকিৎসক শঙ্কর ডাক্তারের কথা উল্লেখ করে বলেছেন— “…শঙ্কর ডাক্তার। আমাদের বাড়ির ডাক্তার। শুধু আমাদের নয়, আরও অনেকেরই বাড়ির। বাড়ির ছেলে-বুড়ো সকলকে ডাকনামে চিনতেন তিনি। চেম্বারে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও কম্পাউন্ডার না থাকলে লাল বা গোলাপি রঙের তরল মিকশ্চার করে দিতেন নিজের হাতে।…বাড়িতে এলে একজনের জায়গায় তিনজনকে যেমন এক ভিজিটেই দেখতেন, একইরকমভাবে চেম্বারেও তার অন্যথা হত না। রোগী দেখার পাশাপাশি রোগীর লেখাপড়া বা কাজকর্ম নিয়েও খোঁজ খবর নিতে ভুলতেন না। এমএমবিবিএস শঙ্কর ডাক্তার একাধারে, বাড়ির ছোটদের ডাক্তার অর্থাৎ শিশু-বিশেষজ্ঞ, বয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদ্ররোগ বিশেষজ্ঞ, চেস্ট স্পেশালিষ্ট, নেফ্রোলজিস্ট, ইউরোলজিস্ট, মহিলাদের ক্ষেত্রে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের সার্থক ভূমিকা পালন করতেন।”[37]
একবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল গোপাকৃষ্ণ গান্ধীর (২০০৪-০৯) কাছে রাজ্যপাল পদ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি এই পদটি কেমন তা বোঝানোর জন্য সেই পুরনো ডাক্তারবাবুদের প্রসঙ্গ টেনে এনে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন “বাড়ির পুরনো ডাক্তারবাবু শুধু রোগেরই চিকিৎসা করেন না। পরিবারের ভাল-মন্দ সব কিছুতে তাঁর ভূমিকা থাকে। তিনি পরামর্শ দেন তাঁর কাছে মতামত চাওয়া হয়। তাঁর কথা মান্যতা পায়। বাড়ির ছেলেটির চাকরি না –পাওয়া বা মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা করতে না-পারার মতো সমস্যা নিয়েও ডাক্তারবাবুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায়। তাঁকে বলা যায়, আপনি একটু সাহায্য করুন।”[38]
এখন প্রশ্ন কেন চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে? ডাক্তার রোগীর মাঝে আজ কেন একটা অদৃশ্য দেওয়াল উঠে গেল? ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক একদিনে ভাঙে নি, এই সম্পর্ক ভাঙতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। আর এই সম্পর্কের ভাঙনের মূলে আছে বেশ কিছু কারণ, যে কারণগুলি দেশের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির পরিবর্তনের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে।
অনেকে বলবেন বর্তমানে চিকিৎসকেরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন বেশি এবং অর্থ উপার্জন করতে চায় বেশি। কিন্তু প্রাইভেট প্র্যাকটিস তো নতুন কিছু নয়। প্রাচীন ভারত থেকেই এটি প্রচলিত। চিকিৎসক জীবক চিন্তামণি থেকে জীবন ডাক্তার সকলেই তো অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা করতেন। যেমন তারাশঙ্কর আরোগ্য নিকেতনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন “তিন পুরুষ চিকিৎসা-ব্যবসায়ী মশাইদের চিকিৎসালয়।”[39] অর্থাৎ চিকিৎসাটা ছিল তাদের কাছে ব্যবসা। তাছাড়া আমরা জানি কিংবদন্তি চিকিৎসকদের সকলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকের ফি ছিল বেশ উচ্চ পরিমাণের।
আসলে প্রথম আঘাতটা এসেছিল জেনারেল ফিজিসিয়ান বা পারিবারিক চিকিৎসকের ধারণার অবসানের মধ্য দিয়ে। পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন “হাতে কালো বাক্স। গলায় স্টেথোস্কোপ। চলাফেরায় হন্তদন্ত ভাব। দুয়েক দশক আগেও তাঁদের দেখা যেত হামেশাই। তাঁরা সকাল-বিকেল বাড়িতে এসে রোগী দেখে যেতেন, চা খেতেন। রোগীর বিছানার পাশে পাতা চেয়ারে বাড়ির লোক যাঁদের শশব্যস্ত হয়ে বসাতেন। ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। ডাক্তারবাবুদের এই ‘হোম-কল’-এর প্রচলিত অভ্যাস এখন অতীত হয়ে গিয়েছে।”[40] পারিবারিক চিকিৎসক ধারণার বিদায়ের পাশাপাশি আধুনিক মেডিসিনে স্পেশালিষ্ট চিকিৎসক ধারণার উদ্ভব হল। অবশ্য ১৯৭০-এর দশক থেকেই এই ধারণা বিকশিত হতে শুরু করেছিল।[41] শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অনুযায়ী চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা তৈরি করে দেওয়া হল। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে ১৯৯৯ সালে লেখা হয়— গত ১৫০ বছরে চিকিৎসার জগতে যে পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল: ব্যক্তি চিকিৎসক রোগীর গৃহে গিয়ে চিকিৎসার যে দায়িত্ব নিতেন তার পরিবর্তে একটি জটিল থাক-বদ্ধ, প্রযুক্তি-নির্ভর, পেশাদার চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীসমৃদ্ধ চিকিৎসা ব্যবস্থা।[42] এই ব্যবস্থা একদিকে যেমন সুফল দিয়েছিল অন্যদিকে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছিল। প্রথমত এই আধুনিক মেডিসিনের জগতে চিকিৎসকের কাছে সামগ্রিক মানুষের পরিবর্তে খণ্ড রোগী গুরুত্ব পেল।[43] চিকিৎসক-রোগীর সামগ্রিক দেহের খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। এর ফলে চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকল। দ্বিতীয়ত এই নতুন ব্যবস্থায় রোগীকে নিজেই ঠিক করতে হল তিনি কোন স্পেশালিষ্টের কাছে যাবেন। যার ফলে অনেক সময় সঠিক চিকিৎসক নির্বাচন করতে না পারার অক্ষমতার জন্য রোগীকে বারবার চিকিৎসক বদলাতে হল। রোগীর অর্থের অপচয় বাড়ল। আর এর জন্য চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের মনে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করল।[44]
ঊনবিংশ শতকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে আধুনিকায়নের সূচনা হয় এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও বিজ্ঞান নির্ভর হয়ে উঠতে থাকে। এই শতকে নতুন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতির সূচনা ঘটে। এর আগে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসক ‘হিস্ট্রি টেকিং’ অর্থাৎ রোগী বা রোগের ইতিহাস নেওয়া উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। কিন্তু ইন্সপেকশন (পর্যবেক্ষণ করা), প্যালপেশন (রোগীকে ছুঁয়ে দেখা), পারকাশন (ভেতরের অঙ্গগুলির অবস্থা জানার জন্য আঙুল দিয়ে বাজিয়ে দেখা), অসকাল্টেশন (স্টেথোস্কোপ দিয়ে শব্দ শোনা) অর্থাৎ সংক্ষেপে IPPA পদ্ধতির আবিষ্কারের ফলে রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকের কাজটা একটু সহজ হয়। রোগের ইতিহাস শোনার সাথে সাথে এই ধরণের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ নির্ভর চিকিৎসা রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্ককে মজবুত করেছিল। উনিশ শতকেই রেনে লেনেক আবিষ্কার করেছিলেন স্টেথোস্কোপ। পাশাপাশি প্যাথলজিক্যাল অ্যানাটমির (শব ব্যবচ্ছেদ) জ্ঞান এবং জীবাণু তত্ত্বের বিকাশের ফলে চিকিৎসক আরও সফলভাবে চিকিৎসা করতে সক্ষম হন। চিকিৎসক রোগীর কাছে দেবতায় পরিণত হয়।[45] কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (১৯৩৯-৪৫) চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরও উন্নতি হয়। এই সময় একদিকে যেমন নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার হয়েছিল অন্যদিকে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরও প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ১৯৪৫ সালে পেনিসিলিন সহজ প্রাপ্য হয়ে ওঠে। আর এর ফলেই সংক্রামক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু কম্পিউটার ভিত্তিক রক্ত পরীক্ষা, টোমোগ্রাফি স্ক্যান, Ultasnography (USG), Magnetic Resonance Imaging (MRI) হিস্ট্রি টেকিং, প্যালপেশন বা আসকাল্টেশন এর গুরুত্বকে কমিয়ে দিয়েছিল।[46] আর তাই চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীর দেহ পরিমাপ করে স্ট্যাটিস্টিকের হিসেব-নিকেশ করাটাই প্রধান হয়ে দাঁড়াল। স্টেথোস্কোপ হয়ে উঠল অপ্রাসঙ্গিক। এই প্রযুক্তি নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগী নয় রোগ গুরুত্ব পেল। অর্থাৎ টেকনো-মেডিসিনের যুগে স্বাস্থ্যের পরিবর্তে অসুস্থতা প্রধান হয়ে উঠল।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতির ফলে চিকিৎসক অভ্রান্তভাবে চিকিৎসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু এই উন্নতি চিকিৎসকের হাতে প্রচুর ক্ষমতা এনে দিয়েছিল। চিকিৎসকের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল অহংবোধ। এক্ষেত্রে ফুকোর spatialization[47] (স্থান-সংক্রান্তকরণ) ধারণার উল্লেখ করা যেতে পারে। ফুকো অসুস্থতা সংক্রান্ত তিন ধরণের স্পেশালাইজেশনের কথা বলেছেন। প্রথমটি হল প্রাইমারি স্পেশালাইজেশন, এক্ষেত্রে রোগী নিজের অসুস্থতা বুঝে উপসর্গগুলি ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু হসপিটাল মেডিসিন এসে এই ধারণা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে উপসর্গের সঙ্গে যুক্ত হল চিহ্ন। চিকিৎসককে রোগীর দেহে সেই চিহ্ন খুঁজে বের করতে হল। কারণ এই চিহ্ন প্রকৃতপক্ষে দেহের আভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কোনও অস্বাভাবিকতাকে উদঘাটিত করে। অর্থাৎ চিকিৎসক রোগীর অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করার পরিবর্তে চিহ্ন খুঁজে নিতে শুরু করলেন। ফুকোর ধারণায় এটি ছিল সেকেন্ডারি স্পেশালাইজেশন। রোগ খুঁজতে দেহের পরিমাপ করতে হল। দেহের আয়তন মাপার জন্য বিভিন্ন টেকনিকের (IPPA) ব্যবহার শুরু হল। টেকনিকের সাথে যুক্ত হয়েছিল টেকনোলজি, যেমন—স্টেথোস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, স্ফিগমোম্যানোমিটার, থার্মোমিটার, এক্স-রে ইত্যাদি। ফুকোর ধারণার তৃতীয় ক্ষেত্রটি হল টারশিয়ারি স্পেশালাইজেশন। এক্ষেত্রে রোগীকে গৃহ পরিবেশ থেকে সরিয়ে হাসপাতালে আবদ্ধ রেখে চিকিৎসার প্রচলন ঘটল। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হল ল্যাবরেটরি মেডিসিন। এই হসপিটাল মেডিসিন ও ল্যাবরেটরি মেডিসিনের যৌথ রূপ হল টেকনো মেডিসিন।[48] পোস্টমডার্ন ধারণায় এই হাসপাতালকেই তো আবার জেলখানার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। আসলে Asylum, হাসপাতাল, জেলখানা, শেণিকক্ষের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি পরীক্ষাগার (ল্যাবরেটরি) হিসেবে কাজ করে। এখানে ব্যক্তিকে বন্দী করে রেখে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। ফুকো বলেছেন “এটা কি কোনও অবাক করার মত বিষয় যে কারখানা, ব্যারাক, হাসপাতাল, এই সবগুলির সাথেই জেলখানার মিল আছে?”[49] আমরা জানি ঔপনিবেশিক শাসনে এদেশে কাউকে রোগাক্রান্ত বলে সন্দেহ হলে তাঁকে সমাজ থেকে পৃথক করার জন্য জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে রাখা হত।[50] আধুনিক মেডিসিন সম্পর্কে মনু কোটারি বলেছেন আধুনিক মেডিসিনে (পড়ুন টেকনো মেডিসিনে) একজন চিকিৎসক রোগী ও রোগ কোনটিই দেখেন না। তিনি বেশ কিছু শত্রুকে দেখেন, যাদের যে কোনও উপায়ে ধ্বংস করা আবশ্যক।[51] যাইহোক আমাদের যুক্তি হল, চিকিৎসা ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের আগে চিকিৎসক রোগীর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বা IPPA এর মাধ্যমে নির্ণয় করতেন। রোগীর সঙ্গে কথা বলার জন্য চিকিৎসককে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হতো। কিন্তু চিকিৎসায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের কথোপকথনের প্রয়োজনীয়তা কমতে শুরু করে।
প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসার যখন উদ্ভব হয়ে গেল তখন চিকিৎসক আর নাড়ি টিপে অর্থাৎ অনুমান নির্ভর চিকিৎসা করতে চাইলেন না। তিনি চাইলেন আরও নির্ভুলভাবে চিকিৎসা করতে। তাই তাঁকে বিভিন্ন ধরণের প্যাথলজিক্যাল টেস্ট প্রেসক্রাইব করতে হল। আবার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট নর্মাল হলে রোগীর মনে প্রশ্ন জাগল যে চিকিৎসক হয়তো কাটমানির জন্য অহেতুক টেস্ট লিখেছেন।[52] তবে কাটমানির প্রশ্ন অমূলক নয়। এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নামকরা জার্নালেও এই নিয়ে নিয়মিত লেখা বেরোতে দেখা গিয়েছে। ২০০৩ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের প্রচ্ছদে ছবির মাধ্যমে চিকিৎসকদের ওষুধ কোম্পানির উচ্ছিষ্টভোজী শুয়োরের সঙ্গে তুলনা করা হয়।[53] আর এই ধরণের খবর যখন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় বা কখনও কখনও তারা যখন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তখন সমস্ত চিকিৎসকের প্রতি তাদের সমীহ-ভাব কমতে শুরু করে। তবে বিজ্ঞানের এত উন্নতি যখন হয়েছে তখন রোগীর স্বার্থে তা ব্যবহার না করাটাই বিপজ্জনক। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি দ্বারা যদি আরও ভালো ভাবে রোগ নির্ণয় করা যায় তবে শুধু শুধু কেবলমাত্র খরচসাপেক্ষ বলেই তা থেকে রোগীকে বঞ্চিত রাখা, বা ভালো ডাক্তারি থেকে বঞ্চিত রাখা সঠিক পদক্ষেপ নয়। তাই চিকিৎসক চিকিৎসা জনিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বললেই যে সবক্ষেত্রে তাঁর কাটমানির উদ্দেশ্য আছে সেটা বলা ঠিক হবে না।[54] তাছাড়া কয়েকজনকে দেখে সমগ্র চিকিৎসক সমাজকে দোষারোপ করা উচিত নয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতি মানুষের মনে জরা-ব্যাধি সম্পর্কে ভীতিও কমিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথে ডাক্তারের প্রতি রোগীর শ্রদ্ধা কমতে থাকল। রোগী ভাবতে শুরু করল সবকিছুই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দান, চিকিৎসক এখানে নগণ্য। চিকিৎসক Next to God এর পরিবর্তে Service Provider হয়ে দাঁড়ালেন।[55] তবে শ্রদ্ধা কমলেও চিকিৎসকের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছিল। বেড়েছিল মানুষের চাহিদা। জনগণ ভাবলেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসক রোগের চিকিৎসায় অসাধ্যকে সাধন করবেন।[56] কিন্তু প্রত্যাশামত কাজ না হলেই চিকিৎসক জনরোষের মুখে পড়লেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে অনিশ্চয়তা বলে একটা বিষয় আছে সেটা আর মানুষের মাথায় থাকল না। তবে চিকিৎসকরা যে একেবারে সাধু তা বলা যাবে না। আমরা পরে দেখব চিকিৎসক এই রিস্ক ফ্যাক্টর বা চান্স ফ্যাক্টরের দোহাই দিয়ে কিভাবে অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন।
চিকিৎসা প্রযুক্তিতে যেমন পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল তেমনই তথ্যপ্রযুক্তিতেও আমূল বদল এসেছিল। প্রযুক্তির দৌলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তথ্য সহজে মানুষের হাতের মুঠোয় আসতে শুরু করল। সাধারণ মানুষ গুগল ঘেঁটে চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করল। আর সামান্য তথ্য পেয়ে ডাক্তারের বিদ্যাকে অনেক সময় চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করল অনেকে। যার ফল হিতে বিপরীত হল। যেটাকে বিজ্ঞানের অভিশাপও বলা যায়। কিন্তু সাহিত্যের অগ্নীশ্বর ডাক্তার বা প্রদ্যোত ডাক্তার এবং বাস্তবের নীলরতন সরকার বা বিধান রায়কে এই সমস্যায় পড়তে হয় নি। ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যানের দিকে যদি একটু নজর দেওয়া যায় তাহলে এই বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধি করা আরও সহজ হয়। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৯৮ সালে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ কিন্তু ২০১৬ সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬.৫ শতাংশ।[57]
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের সেকাল-একালের তুলনা করতে গিয়ে বলেছিলেন চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে সহজ-সরল কথোপকথন খুব জরুরি। তিনি বলেছেন “আজকাল চিকিৎসকরা তো কথাই বলতে চান না রোগীর সঙ্গে। দুর্নীতিপরায়ণ চিকিৎসকদের কথা বাদই দিলাম। সৎ, দুর্নীতিমুক্ত চিকিৎসকরাও রোগীর সঙ্গে কথা বলেন না।” তাঁর বক্তব্য আগে এমন অবস্থা ছিল না।[58] এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের একতরফাভাবে দোষ দেওয়া যায় না কারণ আমরা দেখলাম চিকিৎসায় প্রযুক্তির ব্যবহার কিভাবে চিকিৎসক-রোগীর কথোপকথনের গুরুত্ব কমিয়ে দিল। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ্যক্রম সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ্যক্রমকে প্রধানত কগনিটিভ ডোমেন, সাইকোমোটর স্কিল, অ্যাফেক্টিভ ডোমেন এই তিনটি উপাদানে ভাগ করা হয়। প্রথমটিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়। দ্বিতীয় স্তরে শিক্ষার্থী তাদের লব্ধ জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করে। আর তৃতীয় ক্ষেত্রটিতে শিক্ষার্থীরা পরিস্থিতির মূল্যায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মূল্যবোধের প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় আয়ত্ত করে। চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে অ্যাফেক্টিভ ডোমেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে রোগী সম্পর্কে চিকিৎসকের মনে সম্যক ধারণা তৈরি হয়, যার প্রতিফলন ঘটে চিকিৎসায় এবং রোগীর প্রতি চিকিৎসকের আচরণে। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রচলিত পাঠ্যক্রমে তৃতীয় ক্ষেত্রটিকে উপেক্ষা করা হয়। মনে করা হয় শিক্ষার্থী নিজ প্রচেষ্টায় এই বিষয়গুলি শিখে নেবেন।[59] তবে নিজ উদ্যোগে শিখে নেওয়াটা আর হয়ে ওঠে না। যার পরিণতিতে চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বাড়তে থাকে।
তাছাড়া চিকিৎসকদের মূল্যবোধ কমে যাওয়ার পিছনে মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থার যান্ত্রিক হয়ে ওঠার অবদানও কিছুটা আছে। এই বক্তব্যই ফুটে ওঠে আনন্দবাজার পত্রিকার পাতাতে অভিজিৎ চৌধুরীর লেখায়। তিনই বলেছেন “উচ্চবিত্তনন্দন, ডাক্তার হবেন, এটা বহুদিন আগে থেকেই জানা। নিম্নবিত্ত এমনকি গরিব ঘরের মফস্বল ও গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা মেডিক্যাল কলেজে আসতে শুরু করেন সত্তরের দশক থেকে। সামাজিক ন্যায় ও গণতান্ত্রিক ভাবনার সামগ্রিক প্রসারও এ দেশে সে সময়ই। এই ধারার অনুসারীদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগত ভাবনা একটু আলাদা ছিল বলেই, আর সংখ্যাতেও এঁরা বেশি থাকার ফলে সত্তর-আশি এমনকী নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক ন্যায়ের ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার একটা প্রবণতা দেখা যেত। বিত্তশালী, শহরের ছেলেরাও এই বাতাবরণে সমাজবোধে দীপ্ত ও প্রভাবিত হতেন। চিকিৎসা প্রবেশিকা পরীক্ষাকে ‘একমাত্র’ মেধাভিত্তিক করার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষাকে তাৎক্ষণিক দক্ষতা-নির্ভর ‘টিক’ কিংবা ‘গোল’ করার পদ্ধতির আমদানির সময় থেকেই হট্টমেলার শুরু।”[60]
এবার আসা যাক এদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিকাঠামোর কথায়। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের স্বার্থে যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকু চিকিৎসা পরিষেবার দিয়ে ছিল। ফলে সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল খুব কম। কিন্তু ঔপনিবেশিক উত্তর পর্বে ক্ষমতার হাতবদল হয় এবং নতুন সরকার গঠিত হয়। প্রজাকল্যাণকামী রাষ্ট্রের আদর্শ অনুযায়ী জনগণকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। চিকিৎসা পরিষেবাও ছিল তার মধ্যে অন্যতম। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি চিকিৎসা গ্রহণে জনগণের প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে আলমা আটা সম্মেলনে (১৯৭৮) বলা হয় স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার। ফলে সাধারণ মানুষ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাধীনতার দু’দশক পর দেশের সরকার বুঝে যায় এত বিপুল মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সরকার অন্য পথ খুঁজতে শুরু করে। সেই পথটি হল চিকিৎসা ব্যবস্থার বাজারীকরণ। নব্বইয়ের দশকে এসে এই কাজটি সহজ হয়ে যায়। এই সময় দেখা যায় একদিকে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় কম হওয়ার জন্য সরকারি হাসপাতাল ধুঁকতে থাকে অন্যদিকে কর্পোরেট হাসপাতাল ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে।[61] আমাদের কারোর এখন অজানা নেই বেসরকারি হাসপাতালের শোষণমূলক অবস্থানের কথা। বেসরকারি হাসপাতালের নৈরাজ্য সম্পর্কে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৭ সালে এক বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে একজন বলেছিলেন “আমার পুত্রবধূকে এখানে যে ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম, তিনি রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছিলেন, তারপরে চিকিৎসা শুরু হবে। তবে পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে চারদিন লাগবে, সেই ক’দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন ডাক্তারবাবু। আমরা বলেছিলাম সুস্থ মানুষ হাসপাতালে কেন ভর্তি হবে! খুব চাপ দেওয়া হয়েছিল।”[62]
তবে নব্বইয়ের দশকে শুধু যে কর্পোরেট হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল তা নয়। পাশাপাশি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজও তৈরি হতে শুরু করেছিল।[63] অর্থাৎ চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞান বিক্রি করার পদক্ষেপ জোরদার হল গত শতকের শেষ দিক থেকে। এই জ্ঞান কিনে যে চিকিৎসক তৈরি হল তাঁদের কাছে চিকিৎসাটা বাজারী পণ্য ছাড়া অন্যকিছু বলে বিবেচিত হল না। আমরা জানি বাজারীকরণে যুগে কোনও সম্পর্কের গুরুত্ব থাকেনা, সে পারিবারিক বা চিকিৎসক-রোগী যে সম্পর্কই হোক না কেন।
চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক নির্ভর করে তাদের মধ্যে সঠিক কমিউনিকেশনের ফলে। পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক মজবুত হয়। চিকিৎসা করা ছাড়াও চিকিৎসকের অন্যতম দায়িত্ব হল রোগী এবং তার আত্মীয়দের সঙ্গে তথ্যের আদানপ্রদান করা।[64] এই কাজের জন্য চিকিৎসককে রোগীর পেছনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়। যার ফলে প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকিৎসকের। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলেও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা হয় নি। আর তাই চাহিদা যোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা থেকেই যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি হাজার জনসংখ্যায় একজন চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ভারতে সরকারি চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাত হল ১:১০১৮৯।[65]
আশির দশকে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল যে চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে চিকিৎসক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু সেটা হয় নি। তাই সেইসময় পাশকরা অনেক চিকিৎসক সরকারি চাকরি না পেয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে থাকেন। এদিকে নব্বইয়ের দশকে থেকে বেসরকারি হাসপাতালের রমরমা বাজার আরম্ভ হলে ডাক্তাররা সেখানে গিয়ে ভিড় করেন। এর আগে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে যারা টিকেছিল বহুজাতিক সংস্থার দাপটে তাদের ব্যবসা মোটামুটি বন্ধ হয়ে যায়। এবার তাঁরা হাসপাতালের মালিককে মুনাফা লুটতে সাহায্য করেন।[66] তবে সব ডাক্তার নয়। অনেক চিকিৎসক এর প্রতিবাদও করেছেন। ৭৮জন চিকিৎসকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রকাশিত ‘Dissenting Diagnosis’[67] নামক বইটি তারই উদাহরণ। এই ৭৮ জন চিকিৎসকের মধ্যে আমাদের রাজ্যের চিকিৎসক হলেন ৭ জন। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় পরিকাঠামোতে ঘাটতি থেকে যায়। জনগণ বারবার বঞ্চিত হন। এই বঞ্চিত হওয়ার জন্য তারা দায়ী করে চিকিৎসকদের। কারণ তাঁরাই তো চিকিৎসা ব্যবস্থার সামনে থাকেন। অথচ চিকিৎসা ব্যবস্থার পিছনের খবর কেউ রাখেন না। তাই চিকিৎসকদের মধ্যে সরকারি চাকরি না গ্রহণ করার প্রবণতা দেখা দিল। তাঁরা সাহসটা পেলেন কারণ বেসরকারি হাসপাতাল তাঁদের জন্য দরজা খুলে রেখেছিল। এক সময় সরকারি চাকরি গ্রহণের জন্য জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন করেছিল কিন্তু এখন সরকারের বক্তব্য সরকারি হাসপাতালে কোনও চিকিৎসক যোগ দিতে চাইছেন না।[68] কিন্তু কেন চাইছেন না তা আমাদের বুঝতে আর বাকি থাকে না।
আমরা দেখলাম সরকার তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে বেসরকারি পুঁজিকে উৎসাহ যুগিয়েছে। কর্পোরেট শক্তি পুরোদমে এই সুযোগটা গ্রহণ করেছিল। তারা রোগীর পকেট কাটার খেলায় মেতে উঠল। Dissenting Diagnosis বইটি দেখিয়েছে কিভাবে কর্পোরেট হাসপাতাল ও ওষুধ কোম্পানি মানুষকে শোষণ করে। চিকিৎসার প্রযুক্তি নির্ভরতা তাদের কাজে সহায়তা করে। চিকিৎসক হয়ে ওঠে তাদের শোষক যন্ত্র। চিকিৎসার কারণে সৃষ্ট রোগ(Iatrogenic Disorders) বাড়তে থাকে মারা যায় অনেক মানুষ। কেননা অকারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের ব্যবহার, সার্জারি ইত্যাদি মামুলী ব্যাপার হয়ে উঠল বিশ্বায়নের যুগে। Dr Barbara Stanfield তাঁর গবেষণায় আমেরিকায় Iatrogenic Disorders এর কারণে মৃত্যুর সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান দেখিয়েছিলেন।[69] ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায় এদেশে মেডিক্যাল নেগলেজেন্সির কারণে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ মারা যান।[70] কিন্তু চিকিৎসার কারণে সৃষ্ট রোগে বা চিকিৎসার গাফিলতির কারণে রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসক বা কর্পোরেট হাসপাতাল চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত রিস্ক ফ্যাক্টর নামক শব্দের দোহাই দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেতে থাকেন। আর তাই সরকার ডাক্তারদের আইনের জালে বাঁধতে চেষ্টা করে।
আশির দশকে পণ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রতারণা বাড়তে থাকলে সরকার ১৯৮৬ সালে ভোক্তা সুরক্ষা আইন পাশ করে। এই আইন ভোক্তাকে প্রতারকের বিরুদ্ধে কম খরচে মামলা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে এই আইন কার্যকর হবে কি না তা নিয়ে দীর্ঘদিন বিতর্ক চলে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কের নিষ্পত্তি করে রায় দেয় যে এই আইনের অধীনে মেডিক্যাল নেগলেজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। আসলে চিকিৎসা পরিষেবার কেনাবেচা যেভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল তাতে পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক ছিল। এই আইনের বিরুদ্ধে ডাক্তাররা প্রবল আন্দোলন করেছিলেন। তাঁদের যুক্তি, এই আইন চিকিৎসা পরিষেবাটাকে আলু-পটলের মত পণ্য হিসেবে গণ্য করছে। যার ফলে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে সম্পর্ক হয়ে উঠবে ক্রেতা ও বিক্রেতার অর্থাৎ চিকিৎসক হল ‘চিকিৎসাবিক্রেতা’, যার ক্রেতা হল রোগী। ডাক্তারদের আন্দোলনের বক্তব্য ছিল এই আইন কার্যকর হলে ডাক্তার চিকিৎসা ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস হারাবেন। সামান্য মাথা ব্যথার জন্য রোগীকে সিটি স্ক্যান করাতে বাধ্য হবে। ফলে আখেরে রোগীরা সমস্যায় পড়বে।[71] এমনটাই হতে দেখা গিয়েছে পরবর্তী দশকগুলিতে। বৃদ্ধি পেয়েছে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ। এর পরিণতিতেই চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে শুরু করেছে। তবে ডাক্তারদের বক্তব্যের সত্যতা থাকলেও এটা মানতে হবে যে চিকিৎসক যদি যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা করেন তাহলে ডাক্তারের ভুল হলেও সেটাকে তার গাফিলতি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।[72] কিন্তু যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার অভাবের জন্য প্রতিবছর ভারতে প্রচুর মানুষকে মরতে হয়। আর এই বিষয়ে পরিসংখ্যান আগেই দেওয়া হয়েছে।
আবার বেসরকারি হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গিয়ে সরকার ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশ আইন নিয়ে এসেছে। ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইন[73] বলবৎ করে। এখানে বলা হয় কোনও বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসায় গাফিলতি করলে রাজ্য সরকারের দ্বারা গঠিত এগারো জনের কমিটির নিকট অভিযোগ করা যাবে। কমিশন বিষয়টি তদন্ত করে অভিযুক্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির লাইসেন্স বাতিল, জেল এবং জরিমানার মত শাস্তি দিতে পারে। কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে আর্জি করা যাবে না। অধিকাংশ চিকিৎসক, বিশেষ করে যারা বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত বা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন। গড়ে ওঠে Doctors for Democracy, Doctors for Patients, West Bengal Doctors’ Forum-এর মত সংস্থা, যাদের উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষা করা। এঁদের অনেকেই এই বিলের ফলে চিকিৎসক রোগীর মধুর সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কায় পথে নেমেছেন বলে দাবি করেছিলেন।[74] আইন নিয়েও বিতর্ক হয়েছে অনেক। কিছু চিকিৎসক এবং বেশিরভাগ অচিকিৎসকেরা আইনের সপক্ষে কথা বলেন। এই বিষয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজে বিতর্ক সভাও অনুষ্ঠিত হয়।[75] তবে অনেক চিকিৎসকের বক্তব্যঃ এই আইনের ফলে তাদের প্রতি আক্রমণের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে।
চিকিৎসার বেসরকারিকরণ ও চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক নিয়ে আরেকটু তত্ত্বকথা বলা যাক। ফ্রাঁনৎস ফাঁনো নামে এক ফরাসী মনোবিদ উপনিবেশবাদ ও চিকিৎসার মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলজেরিয়ায় ফরাসী উপনিবেশের কথা বলেছেন:* তিনি বলেছেন এখানে চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল উপনিবেশবাদীদের জোর-জুলুম ও আধিপত্য স্থাপনের অন্যতম অংশ। তাই স্থানীয় জনগণ পশ্চিমা চিকিৎসা বর্জন করে চলতেন। কারণ তাঁরা ভাবতেন এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়ার অর্থ উপনিবেশবাদকে মেনে নেওয়া। তাদের চোখে চিকিৎসক ছিল আধিপত্যকারী প্রভু শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ফলে পাশ্চাত্যের চিকিৎসকদের প্রতি তাদের মোটেই বিশ্বাস ছিল না। অবিশ্বাসটা এত ভয়াবহ ছিল যে পুলিশ-প্রশাসনের মধ্য থেকে চিকিৎসকদের বাধ্যতামূলক রোগী দেখার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হত। ফাঁনো বলেছেন উপনিবেশ বহির্ভূত অঞ্চলে রোগী কখনও চিকিৎসককে অবিশ্বাস করেন না। তিনি আরও বলেছেন দেশীয়রা যখন পশ্চিমী চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার হতেন তখন তাদেরেকেও অনেকসময় মানুষ অবিশ্বাস করত। কেননা অনেক অঞ্চলে মানুষ শিক্ষিত হয়ে উপনিবেশবাদী প্রভুদের আচার আচরণ রপ্ত করে নিত।[76] ফলে ফাঁনোর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি উপনিবেশবাদ ডাক্তার-রোগীর সুসম্পর্কের পরিপন্থী। ঔপনিবেশিক ভারতের ক্ষত্রেও একই দৃষ্টান্ত প্রযোজ্য। গ্রামশির আধিপত্যের তত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনে অরবিন্দ সামন্ত বলেছেন “বাংলায় মেডিসিনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার, হয়তো বা অসচেতন ভাবেই, সিভিল সোসাইটি দখলের চেষ্টা করেছিল।”[77] দীপেশ চক্রবর্তীর লেখা থেকেও আমরা জানতে পারি যে এদেশে পশ্চিমী চিকিৎসা প্রবর্তন করতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে কী বেগটাই না পেতে হয়েছিল।[78]
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আরেক সাম্রাজ্যবাদ এসে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে উপনিবেশায়িত করেছে। এই সাম্রাজ্যবাদকে আমরা ‘নিও-ইম্পারিয়ালিজম’ নামে অভিহত করতে পারি। নতুন সাম্রাজ্যবাদের যুগে আধিপত্যকারীর ভূমিকা পালন করেছে কর্পোরেট পুঁজি। তবে আগের সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বিশ্বায়নের যুগে সৃষ্ট নতুন সাম্রাজ্যবাদের সামান্য পার্থক্য আছে। আগে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আধিপত্য স্থাপন করা হত কিন্তু বর্তমানে আমরা স্বেচ্ছায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আধিপত্য মেনে নিচ্ছি। ফলে আজ কর্পোরেট পুঁজি বলপ্রয়োগ ছাড়াই চিকিৎসকদের দলে টানতে সক্ষম হয়েছে। আর সেই কারণে সাধারণ মানুষ আজ ডাক্তারদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ তারা ভাবছে চিকিৎসক কর্পোরেট শক্তিরই প্রতিনিধি। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে এক রোগী অভিযোগ করে বলেন “হাসপাতালগুলো যা করছে, তা বলার নয়।… একবার ইনজেকশন পুশ করে তিনবার বিলে লেখা হয়। কিন্তু আমরা আসি, জেনেই আসি, কী করব, কোথায় যাব।”[79] এই বক্তব্যের অর্থ হল সাধারণ মানুষ জেনেশুনে কর্পোরেট সাম্রাজ্যের আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে অর্থাৎ তত্ত্বকথার বাস্তবিক প্রয়োগটা সহজেই আমরা বুঝে গেলাম।
কিন্তু এখনে প্রশ্ন উঠতে পারে আজ মানুষ যখন কলকাতার চিকিৎসকদের বিশ্বাস করতে পারছেন না তখন চেন্নাই বা ব্যাঙ্গালোরের চিকিৎসকদের বিশ্বাস করছেন কিভাবে? কেননা অনেকের মতে দক্ষিণ ভারতের চিকিৎসা পরিষেবার মধ্যে নাকি স্নেহ, মানবিকতা ও সেবার মানসিকতা আছে। পশ্চিমবঙ্গে এই জিনিসটির অভাব রয়েছে।[80] এমনকি Christian Medical College, Vellore দাবি করেছে ‘We believe in and are characterized by ethical, compassionate care, which translates into honest, trustworthy, and reliable service, irrespective of the patient’s caste, creed or socio-economic background.’[81]( আমরা রোগীর জাতি-বর্ণ, ধর্ম বা আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিচার না করে সততার সাথে বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য পরিষেবা প্রদান করি। কেননা আমরা নৈতিকতা ও সহানুভূতিশীলতায় বিশ্বাস করি। এটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য।)
তাহলে প্রশ্ন হল দক্ষিণ ভারতে কি কর্পোরেট হাসপাতাল জাল বিস্তার করতে পারেনি? আসলে বিষয়টি হচ্ছে মানুষের অবিশ্বাস এসেছে চিকিৎসকদের ব্যবহারের পার্থক্য দেখে। তাছাড়া কলকাতার চিকিৎসকদের কর্পোরেট শক্তি যতটা সহজে বশ করতে পেরেছে চেন্নাই বা ব্যঙ্গালোরের চিকিৎসকদের অতটা সহজে বশ করা সম্ভব হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি চিকিৎসকরা তো সেই ‘বাবু’ কালচারের ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। যে ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাটুকারিতা করে এবং নিম্নবর্গদের শোষণ করে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রসিয়ে রসিয়ে এই বাবুদের বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন— “…যিনি উৎসাবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতীপূজা করিবেন, এবং পাঁটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন তিনই বাবু। যাঁহার গমন বিচিত্র রথে, শয়ন সাধারণ গৃহে, পান দ্রাক্ষারস এবং আহার কদলী দগ্ধ তিনই বাবু। যিনি মহাদেবের তুল্য মাদকপ্রিয়, ব্রহ্মার তুল্য প্রজাসিসৃক্ষু এবং বিষ্ণুর তুল্য লীলা-পটু তিনই বাবু।”[82] বঙ্কিমচন্দ্র এই বাবুদের বিষ্ণুর মত দশ অবতার আছে বলে মনে করেছিলেন। এই দশ অবতারের মধ্যে একটি হল ডাক্তার অবতার। তিনি আরও বলেন “বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারা সকল অবতারেই অমিতবলপরাক্রম অসুরগণকে বধ করিবেন।…ডাক্তার অবতারে বধ্য রোগী…।”[83] বঙ্কিমচন্দ্র যেভাবে ‘বাবু’ শ্রেণীর চরিত্র ব্যাখ্যা করেছেন তাতে এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বিশ্বায়নের যুগে ভোগবাদ এদেরকে সহজেই গ্রাস করতে পারে।
সমাজ বদলেছে, ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক বদলেছে তার সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুতেও বদল এসেছে। এই পরিবর্তিত সমাজের চিত্র তুলে ধরেছে চলচ্চিত্র বা উপন্যাস। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘অলীক সুখ’[84] উপন্যাসে দেখা যায় ডাঃ কিংশুক গুহ একজন নামকরা গাইনোকলজিস্ট সার্জেন। তাঁরই অধীনে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কবিতা। কিন্তু মেডিক্যাল নেগলেজেন্সির জন্য কবিতার মৃত্যু হয়। যার পরিণতিতে রোগীর পরিবারের লোকজন হাসপাতাল ভাঙচুর করেন এমনকি চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলেন। সিনেমার পর্দায় বাস্তব পরিস্থিতি যেন হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। আসলে ডাক্তার কিংশুক খুব ব্যস্ত মানুষ কারণ তাকে দিনে পাঁচটা চেম্বার, তিনটে অপারেশন ও পঞ্চাশটা রোগী অ্যাটেন্ড করতে হয়। রোগীর পিছনে বেশি সময় ব্যয় করার মত সময় তাঁর হাতে নেয়। হিপোক্রেটিসের শপথের কথা ভুলে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন অর্থ উপার্জনকারী চিকিৎসক। তাঁর কাছে রোগী হলেন শুধু একটা ‘কেস’ এবং রোগীর আত্মীয়রা হলেন ‘পেশেন্ট পার্টি’। অর্থাৎ সবকিছুই যেন বাণিজ্যিক। আর তাই মরতে হয়েছিল কবিতার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীকে। এই সিনেমা একদিকে যেমন ডাক্তার রোগী মধ্যে অদৃশ্য দেওয়ালকে আমাদের সামনে দৃশ্যায়িত করছে অন্য দিকে দেখিয়েছে যে ভোগবাদ কিভাবে পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারে।
তবে কিংশুক গুহ চরিত্রের পাশাপাশি আরেক চিকিৎসকের কথাও বলা হয়েছে উপন্যাসে। তিনি হলেন কিংশুকের শিক্ষক দেবশঙ্কর মিত্র। তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে “দেবশঙ্কর মিত্রের গোটা জীবনটাই কাটল ছাত্র পড়িয়ে আর সরকারি হাসপাতালে রুগি ঘেঁটে। জীবনে কোনওদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেনি, লাখ টাকা দিলেও কোনও ভি আই পি পেশেন্টকে আলাদা ভাবে দেখবে না দেবশঙ্কর। …স্ত্রীরোগ আর ধাত্রীবিদ্যার জগতে দেবশঙ্কর মিত্র এক উজ্জ্বল নাম, লোকটার বাড়িতে ঢুকে তা কি টের পাওয়া যায়? গাড়ি নেই, মিনিবাসে হাসপাতালে যায় দেবশঙ্কর, বড় জোর শেয়ার ট্যাক্সিতে। …”[85] কবিতা (কিংশুকের পেশেন্ট) মৃত্যু কেসের তদন্ত দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন দেবশঙ্কর। কিংশুক ভেবেছিল স্যার তাঁর পক্ষে কথা বলবেন। তাই বোধহয় সে স্যারকে ‘তেল মারতে গিয়েছিল’। কিন্তু দেবশঙ্কর অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। অগ্নীশ্বর চরিত্রের সঙ্গে যার অনেকটাই মিল পাই আমরা। সাধারণ মানুষ এই দেবশঙ্করের মত চিকিৎসকদেরই পছন্দ করেন।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখার্জীর পরিচালনায় ২০১৩ সালে মুক্তি পায় ‘অলীক সুখ’[86] নামে সিনেমাটি। তবে একটা বিষয় বলতে হয় সিনেমাটি বড় একমাত্রিক অর্থাৎ চিকিৎসককেই শুধু দোষারোপ করা হয়েছে।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকে যখন চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ তার গতি বাড়াতে শুরু করে তখনও চিকিৎসকে এইভাবে দোষারোপ করা হয় নি। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সন্দীপ রায়ের ‘উত্তরণ’[87] সিনেমায় চিকিৎসক সেনগুপ্ত উচ্চশ্রেণীর মানুষের চিকিৎসা করলেও দেখা যায় গরিবের স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন নি। রাস্তায় পড়ে থাকা গরিব রোগীর চিকিৎসা করেন তিনি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ২০ বছরের উন্নতি নিয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ তিনি শেষে পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। কারণ তিনই বুঝতে পেরেছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি হলেও গরিবরা তা থেকে বঞ্চিতই থাকবেন। শুধু বাংলা চলচ্চিত্র নয় হিন্দি সিনেমাতেও চিকিৎসক রোগীর সম্পর্কের পরিবর্তন বিষয়টি স্থান পেয়েছে। ২০০৩ সালে রাজকুমার হিরানির ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’[88] চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে কেমন আন্তরিকতা হওয়া দরকার সেটা তিনি দেখিয়েছেন। কিন্তু এক দশক পরেই ‘গব্বর ইজ ব্যাক’[89] সিনেমা চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে।
যাইহোক দীর্ঘ আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পারলাম কিভাবে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের পিছনে কোন কোন উপাদানগুলি কাজ করেছে সেটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু লেখা শেষ করার আগে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, আর তা না হলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের এটা মনে করা ঠিক হবে না যে সত্তর-আশির দশকের আগে সব চিকিৎসকই অগ্নীশ্বর, সদাশিব ডাক্তার বা নীলরতন সরকার, বিধান রায় ছিলেন এবং এখন সব ডাক্তারই কিংশুক গুহ হয়ে গিয়েছেন। বর্তমানেও আছেন পুণ্যব্রত গুণ, জয়ন্ত ভট্টাচার্যের মত চিকিৎসকেরা, যাঁরা মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। পুণ্যব্রতবাবু কোনও দিন সরকারি-বেসরকারি চাকরি বা প্রাইভেট প্র্যাকটিসের চেষ্টা করেন নি। তিনি মাত্র ১০০০ টাকা ভাতায় কাজ শুরু করেছিলেন শহিদ হাসপাতালে।[90] তিনি হিপোক্রেটিসের শপথ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন। তিনি যেন সাক্ষাৎ ‘দেবশঙ্কর মিত্র’। এছাড়া আরেকজন চিকিৎসকের নাম এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি হলেন অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত। যিনি ডাক্তারি পাশ করার পর দক্ষিণ ২৪ পরগণার বেলপুকুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন এবং সমস্ত প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে দরিদ্র জনগণের সেবা করেছেন। তিনি প্রতিকূলতাকে কিভাবে জয় করেছিলেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা ‘এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প’[91] নামক বইটিতে। যে বইটি পড়লে একজন ডাক্তারের প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে যায়।
এই ধরণের চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেছেন চিকিৎসক-রোগীর মধ্যেকার ভুল ধারণা দূর করতে। তাই ‘ডাক্তার ডায়ালগ’ এর মত পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে। যেখানে রোগী-চিকিৎসক খোলাখুলি কথা বলতে পারবেন। আর আমরা আশা করছি এই মহৎ উদ্যোগ সফল হলে চিকিৎসক-রোগীর সুসম্পর্ক আবার ফিরবে।
উৎসঃ
[1] মুক্তি (সাপ্তাহিক পত্রিক), পুরুলিয়া, ২৩শ বর্ষ; ৩১শ সংখ্যা, ১৩ আগস্ট ১৯৬২, পৃপৃ. ১-২।
[2] আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩০ আগস্ট ২০১৭, পৃ. ৫।
[3] আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৭ অক্টোবর ২০১৭, পৃ. ৩।
[4] এই সময়, কলকাতা, ১২ জুন ২০১৯, পৃ. ১।
[5] আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, পৃ. ১৪।
[6] R, D. Lele, Ayurveda and Modern Medicine, Bharatiya Vtdya Bhavan, Bombay, 1986, pp. 18-19.
[7] Ibid, p. 1.
[8] John G. Robertson, Robertson’s Words for a Modern Age: A Cross Reference of Latin and Greek Combining Elements, Senior Scribe Publications, Germany, 1991, p. 183.
[9] Ibid,
(The art has three factors, the disease, the patient, the physician. The physician is the servant of art. The patient must co-operate with the physician in combating the disease.)
[10] Shireen Moosvi, A Sixteenth-Century Code for Physicians, in Disease & Medicine in India: A Historical Overview, Deepak Kumar (ed.), Tulika, New Delhi, first published 2001, reprint 2012, pp. 66-70.
[11] Professional Conduct, Etiquette and Ethics Regulations, 2002; Amended upto 8th October 2016, Indian Medical Council, New Delhi.
[12] সুমন্ত ঘোষ মৌলিক ও তাজুদ্দিন আহমেদ, রোগীকে বোঝা আর বোঝানো, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১১ জুলাই ২০১৮, পৃ. ৪।
[13] তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আরোগ্য নিকেতন, প্রকাশক ভবন, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ।
[14] তদেব, পৃ. ১।
[15] তদেব, পৃ. ২১।
[16] তদেব, পৃ. ৩২।
[17] তদেব, পৃ. ২৩।
[18] বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), অগ্নীশ্বর, ডি.এম লাইব্রেরী, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ, ব্যবহৃত দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ।
[19] বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), হাটে বাজারে, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ ১৮৮২ শকাব্দ।
[20] তদেব, পৃ. ৯৯।
[21] তদেব, পৃপৃ. ৬৮-৬৯।
[22] S. Ali Nadeem Rezavi, ‘Physician as Professionals in Medieval India’, in Disease & Medicine in India: A Historical Overview, Deepak Kumar (ed.), Tulika, New Delhi, first published 2001, reprint 2012, pp. 40-65.
[23] অঞ্জলি বসু (সম্পা.) সংসদ বাঙালী চরিতাবিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৬০, পৃপৃ. ৭৫-৭৬।
[24] আরোগ্য নিকেতন, বিজয় বসু (পরিচালক), ১৯৬৯।
[25] অগ্নীশ্বর, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় (পরিচালক), ১৯৭৫।
[26] হাটে বাজারে, তপন সিংহ (পরিচালক), ১৯৬৭।
[27] অশোককুমার মুখপাধ্যায়, অবিরাম জ্বরের রূপকথা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৮।
[28] তদেব, পৃ. ৩০।
[29] তদেব।
[30] তদেব।
[31] প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, ‘নীলরতন সসরকার’, ডাঃ নীলরতন সরকার, দীপককুমার দাঁ (সম্পা), বিবেকানন্দ বুক সেন্টার, কলকাতা, ০০০০, পৃপৃ. ৭০-৭৯।
[32] নন্দলাল ভট্টাচার্য, কর্মযোগী বিধানচন্দ্র, গ্রন্থতীর্থ, কলকাতা, ২০০৪, পৃপৃ. ৭৩-৭৪।
[33] অন্তরা চৌধুরী, ‘অগ্নীশ্বররা কোথায় গেলেন? এক ফোনে বিরিয়ানি আসে, কিন্তু ডাক্তার আসে না’, উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৮ অক্টোবর ২০১৯।
[34] সমর সেন, বাবু বৃত্তান্ত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৮, ব্যবহৃত তৃতীয় সংস্করণ ১৯৯১, পৃ. ১১।
[35] তাপস ভট্টাচার্য, রোগী-চিকিতসক সম্পর্ক ভালো করার উপায়, স্বাস্থ্য বীক্ষণ, যুগ্ম সংখ্যা (সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয়-তৃতীয় সংখ্যা), এপ্রিল-জুন; জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০০১, পৃপৃ. ৩৫-৩৯।
[36] সুকান্ত সরকার, ‘বাড়ির ডাক্তারবাবু’র দিন গিয়াছে, উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, এই সময়, কলকাতা, ৩১ জুলাই ২০১৮, পৃ.৮।
[37] তদেব।
[38] দেবাশিস ভট্টাচার্য, কেউ খুঁজে পেলেন টিপুর সিংহাসন, কেউ রইলেন টিনের ঘরে, রাজ্যপালদের অবাক করা গল্প, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার, কলকাতা, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯।
[39] তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩।
[40] আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, পৃ. ১৩।
[41] Siddhartha P Kar, Addressing underlying causes of violence against doctors in India, The Lancet, Vol. 389 May 20, 2017, pp. 1979-80.
[42] Tavistock Group, A shared statement of ethical principles fort those who shape and give healthcare, British Medical Journal, 1999, 318; 249-51.
[43] জয়ন্ত ভট্টাচার্য, বায়ো-মেডিসিন থেকে নজরদারি মেডিসিন: ক্লিনিক্যাল মেডিসিন, ফুকো এবং তারপর, হাওয়াকল, কলকাতা, ২০১৭, পৃ. ৫৫।
[44] সাক্ষাৎকার, চিকিৎসক শঙ্করকুমার নাথ, ৩০.১১.২০১৯।
[45] Edward Shorter, The History of the Doctor-Patient Relationship, in Companion Encylopedia of the History of Medicine, W.F Bynun and Roy Porter (eds.), volume 1 & 2, Routledge, London & New York, first published 1993, reprinted 1994, pp. 783-800.
[46] Ibid.
[47] Michel Foucault, The Birth of the Clinic: An Archaeology of Medical Perception (Translated from the French by A.M. Sheridan), Routledge, first published 1973, 2003.
[48] জয়ন্ত ভট্টাচার্য, প্রাগুক্ত, পৃপৃ. ৯৬-১০৪।
[49] Michel Foucault, Discipline and Punish: The Birth of the Prison (Translated from the French by Alan Sheridan), Vintage Books, New York, Second edition 1995, pp. 195-228.
[50] David Arnold, The rise of western medicine in India, Lancet, Vol. 348, 19 October 1996, pp. 1075–78.
[51] Monu Kotari, ‘Violence in Modern Medicine’, in Science, Hegemony and Violence: A Requiem for Modernity, Ashis Nandy (ed.), Oxford Press, India, 1990, pp. 167-210.
[52] সাক্ষাৎকার, চিকিৎসক শঙ্করকুমার নাথ, ৩০.১১.২০১৯।
[53] BMJ, vol 326, issue 7400, 31 May 2003.
[54] তাপস ভট্টাচার্য, রোগী-চিকিতসক সম্পর্ক ভালো করার উপায়, স্বাস্থ্য বীক্ষণ, যুগ্ম সংখ্যা (সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয়-তৃতীয় সংখ্যা), এপ্রিল-জুন; জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০০১, পৃপৃ. ৩৫-৩৯।
[55] ইন্দ্রনীল সেন, পারিবারিক চিকিৎসক একটি লুপ্তপ্রায় জীবিকা, News Letter, April 2019, Association of Health Service Doctors’, West Bengal, পৃপৃ. ৭-৮।
[56] তদেব।
[57] Internet Usage Stats and Telecommunications Market Report, Internet World Stats, https://www.internetworldstats.com/asia/in.htm, retrieved on 06.01.2020.
[58] এই সময়, কলকাতা, ১০ জুলাই ২০১৮, পৃ. ৪।
[59] সুমন্ত ঘোষ মৌলিক ও তাজুদ্দিন আহমেদ, প্রাগুক্ত।
[60] অভিজিৎ চৌধুরীর, মেধা থাকলেই ভাল ডাক্তার হয় না, আনন্দবাজার পত্রিকা, উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, কলকাতা, ১৬ জুন ২০১৫, পৃ. ৪।
[61] সুজিত কুমার দাশ, বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও মানবিক মূল্যাবোধ, স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন, শারদ সংখ্যা, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৩০।
বিস্তারিত জানতে দেখুন
Amrita Bagchi, Health Care in Crisis: The Changing Pattern of Private Health Care in Post Independence Kolkata, unpublished Ph.D. thesis, department of history, Jadavpur University, 2010.
[62] অমিতাভ ভট্টশালী, কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে এত অভিযোগ, ২ মার্চ ২০১৭, https://www.bbc.com/bengali/news-39137688
[63] Pradeep Kumar Choudhury, Role of Private Sector in Medical Education and Human Resource Development for Health in India, Institute for Studies in Industrial Development, New Delhi, 2014, p. 1.
[64] অরুণালোক ভট্টাচার্য, চিকিৎসক-রুগীর সুসম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ, উৎস মানুষ, জানুয়ারি-মার্চ ২০২০, পৃপৃ. ১৬-১৯।
[65] India facing shortage of 600,000 doctors, 2 million nurses: Study, The Economic Times, https://economictimes.indiatimes.com/industry/healthcare/biotech/healthcare/india-facing-shortage-of-600000-doctors-2-million-nurses-study/articleshow/68875822.cms?from=mdr, consulted on 27.02.2020.
[66] সিদ্ধার্থ গুপ্ত, চিকিৎসক রোগীর সংঘর্ষের উৎস সন্ধানে (অনীক পত্রিকায় প্রকাশিত চারটি প্রবন্ধের সমষ্টি), কলকাতা, ২০১৯, পৃপৃ. ৩-২৩।
[67] Arun Gadre & Abhay Shukla (ed.), Dissenting Diagnosis,Penguin Books, India, 2016.
[68] সিদ্ধার্থ গুপ্ত, প্রাগুক্ত।
[69] Barbara Starfield, ‘Is US Health Really the Best in the World?’ Journal of American Medical Association, vol.284; No.4, 26 July 2000, pp.483-485.
[70] India’s medical error deaths, nearly 5 mn a year, can be cut by 50%: Expert, https://www.business-standard.com/article/current-affairs/india-s-medical-error-deaths-nearly-5-mn-a-year-can-be-cut-by-50-expert-118102800193_1.html, retrieved on 06.01.2020.
[71] সুজিত কুমার দাশ, ডাক্তার বনাম রোগী: ভোক্তা সুরক্ষা আইন ১৯৮৬, ড্রাগ অ্যাকশন ফরাম, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃপৃ. ১-২২।
[72] তদেব।
[73] ‘The West Bengal Clinical Establishments (Registration, Regulation And Transparency) Act, 2017’, the Kolkata Gazette, Government of West Bengal, 17 March 2017.
[74] সিদ্ধার্থ গুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য আইন ২০১৭: বিশল্যকরণীর সন্ধানে, স্বাস্থ্য অব্যবস্থা, পুণ্যব্রত গুণ (সম্পা), গুরুচণ্ডা,কলকাতা, পৃপৃ. ১১-২১।
[75] বিতর্ক সভা, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, ২০১৭।
[76] Frantz Fanon, A Dying Colonialism (Translated from the French by Haakon Chevalier), Grove Press, New York, 1965, pp. 121-133.
[77] অরবিন্দ সামন্ত, রোগ রোগী রাষ্ট্র: উনিশ শতকের বাংলা, প্রগ্রেসিভ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০৪, পৃ. ৪০।
[78] দীপেশ চক্রবর্তী, “শরীর সমাজ ও রাষ্ট্র: ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি”, নিম্নবর্গের ইতিহাস, গৌতম ভদ্র (সম্পাদিত), প্রতিভাস, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃপৃ. ১৬৫-১৬৬।
[79] অমিতাভ ভট্টশালী, প্রাগুক্ত।
[80] সম্পাদক সমীপেষু, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৭ অক্টোবর ২০১১, পৃ. ৪।
[81] Christian Medical College, Vellore, https://www.cmch-vellore.edu
[82] বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বাবু’, বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৬১ বঙ্গাব্দ, পৃপৃ. ১০-১২।
[83] তদেব।
[84] সুচিত্রা ভট্টাচার্য, অলীক সুখ, আনন্দ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০২, পৃপৃ. ৯-১১৩।
[85] তদেব,পৃ. ৮৭।
[86] অলীক সুখ, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখার্জী (পরিচালক), ২০১৩।
[87] উত্তরণ, সন্দীপ রায় (পরিচালক), ১৯৯৪।
[88] মুন্নাভাই এমবিবিএস, রাজকুমার হিরানি (পরিচালক), ২০০৩।
[89] গব্বর ইজ ব্যাক, কৃষ (পরিচালক), ২০১৫।
[90] সাক্ষাৎকার, পুণ্যব্রত গুণ (জন্ম ১৯৬০), ৩১.০১.২০২০।
[91] অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত, এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প, গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনা, কলকাতা, ২০১৯।
বর্তমান সময়ে অগ্নীশ্বর’এর মতো ডাক্তারবাবুদের সন্ধান পেতে একটি উচ্চমানের মাইক্রোস্কোপ দরকার!