অন্ততঃ গত বছর দশেক ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন মেট্রপলিটান শহরে, গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে – এক কথায় সম্ভাব্য প্রতিটি ভৌগলিক স্থানে – চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হয়েছেন রোগি বা তাদের সঙ্গে আসা লোকজনের হাতে। একাধিক চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ চিকিৎসক মারমুখী জনতার কাছে করজোড়ে মিনতি করেছেন। পুজোর প্রাক্কালে ডেবরাতে বিষ্ঠালেপিতও হয়েছেন চিকিৎসক। আপাতত উল্লেখযোগ্য সর্বশেষ সংযোজন কলকাতার একটি বেসরকারি নামী ও দামী হাসপাতালে দক্ষিণ ভারতীয় এক চিকিৎসক যিনি এখানে কর্মসূত্রে এসেছেন সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাদবপুর থানার ওসি পুলক দত্তের হাতে বিরাশি সিক্কার চড় খেয়ে আহত হয়েছেন। সেই পুলিস অফিসার নাকি বলেছেন, অ্যাপ্রন না পরে থাকায় ডাক্তার হিসেবে চিনতে পারেননি। ফার্মাসির লোক হিসেবে ভুল করেছিলেন! (ফার্মাসির লোককে পুলিস ইচ্ছেমতো মারধোর করতে পারে কিনা সে প্রশ্ন নাহয় এখন উহ্যই থাক!)
ভারতে চিকিৎসকদের ওপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে। Lancet, PLoS, British Medical Journal (BMJ), Journal of Royal Society of Medicine (JRSM)-র মতো সুপরিচিত মেডিক্যাল জার্নালগুলোতে বহুলসংখ্যক প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রবন্ধের শিরোনাম এরকম – “Rising violence against health workers in India (Lancet, April 29, 2017); “Structural Violence and Clinical Medicine (PLoS, 2006); “Violence against Doctors: The Class Wars (Indian Heart Journal, 2015); “Violence against doctors: a review (Journal of Royal Society of Medicine, February 1996)। এবং সামগ্রিকভাবে আজ স্বাস্থ্যের জগতে হিংসার প্রভাব এরকম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ২০০২ সালে WHO-কে World Report on Violence and Health প্রকাশ করতে হয়। ১৬০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ ৩ বছর ধরে আফ্রিকা, দুই আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ৭০টির বেশি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে এ রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়েছিল। এ রিপোর্টে বলা হল ভায়োলেন্স তাকে বলা যাবে যা শারীরিক ক্ষত তৈরি করে বা মৃত্যু ঘটায় অথবা মানসিক জগতে ক্ষতি (harm) করে কিংবা ব্যতিচারী বিকাশ (mal-development) বা বঞ্চনা (deprivation) সৃষ্টি করে।
ল্যান্সেটে প্রকাশিত Rising violence against health workers in India প্রবন্ধে হিসেব দেওয়া হল ২০১৬-র একটি সমীক্ষায় (দিল্লির একটি “tertiary care” হাসপাতালে) দেখা গেছে বিগত ১২ মাসে ৪০%-এর বেশি রেসিডেন্ট ডাক্তার তাদের কর্মক্ষেত্রে হিংসার সম্মুখীন হয়েছে। IMA (Indian Medical Association)-র ২০১৭-র রিপোর্ট অনুযায়ী ৭৫% ডাক্তার তাদের কর্মজীবনে হয় দৈহিক কিংবা মৌখিকভাবে হিংসার আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন। এর কারণ হিসেবে IMA-র রিপোর্ট জানিয়েছে, আর্ত এবং জরুরী রোগীদের প্রথম মুখোমুখি হতে হয় জুনিয়র এবং রেসিডেন্ট ডাক্তারদের। এজন্য আক্রমণের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন এরা। পুণের Pune Citizen-Doctor Forum সহ-প্রতিষ্ঠাতা অরুণ গাডড়ে এর কারণ হিসেবে মনে করেন, “জনস্বাস্থ্য খাতে ক্রমাগত ব্য-সংকোচন ঘটছে এবং সরকারের নীতি pro-private হবার ফলে passive privatization অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে।” ভারতে প্রাইভেট সেক্টর এই মুহূর্তে এমন অবস্থায় আছে যেখানে বহির্বিভাগের রোগীর ৮০% এবং ভর্তি হওয়া রোগীর ৬০%-এর পরিষেবা দেয় প্রাইভেট সেক্টর। এদেশে বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে (সরকারি) ব্যয় জিডিপির ১.১৫%, কিন্তু স্বাস্থ্যের খরচ মেটাতে (যা একটি দরিদ্র পরিবারের আয়ের ২৫%) প্রতিবছর প্রায় ৬.৫ কোটির বেশি মানুষ (সংশোধিত হিসেবে প্রায় ৫.৫ কোটি) দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাচ্ছে। এর গালভরা নাম “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ” বা মেডিসিনের দারিদ্র্য-ফাঁদ। এ হিসেব কেন্দ্রীয় সরকারের (National Health Policy, 2017)।
পল ফার্মারের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক একে ধরতে চেয়েছেন স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স (structural violence) বা কাঠামোগত হিংসা হিসেবে। আরেকজন মান্য গবেষক মাইকেল মার্মট (Michael Marmot) একটু ভিন্ন চোখে বিষয়টিকে দেখেন। যাহোক, কি এই স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স? বৃহৎ পরিসরে, পরিব্যাপ্ত ক্ষেত্রে জাত, ধর্ম, লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য, রাজনৈতিক হিংসা, যুদ্ধ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য, সাংস্কৃতিক বিভাজন ইত্যাদি সমস্ত কিছুই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ধারণ করে কে কে অসুস্থ হয়ে পড়বে, তার suffering বা ক্লিষ্টতা কতটা এবং “access to care” বা স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবার কতটা অধিকার থাকবে বা স্বাস্থ্য পরিষেবার কাছে কতটা পৌঁছুতে পারবে।
PLoS-এ ২০১০ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল – Nuclear Weapons and Neglected Diseases: The “Ten-Thousand-to-One-Gap”. এ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে কতকগুলো রূঢ় ববাস্তবের পরিসংখ্যান – (১) ১১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে অস্ত্র তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণে, (২) সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিবছর ৮০ কোটির বেশি মানুষ গোল কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয় তাদের অধিকাংশই মধ্য- বা নিম্ন-আয়ের পারমাণবিক শক্তিধর দেশের – যেমন, ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ কোটি, চিন ৮.৬ কোটি ইত্যাদি, (৩) “neglected disease control” এবং R&D-র জন্য মোট খরচ ১ বিলিয়ন ডলারের কম অর্থাৎ ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারের ১/১০,০০০ভাগেরও কম। Lancet-এ ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল “Neglected tropical diseases – beyond the tipping point?”। সে প্রবন্ধে দেখানো হল overseas development assistance-এর মাত্র ০.৬% বরাদ্দ আছে “tropical neglected disease”-এর জন্য।
এরকম আর্থিক অসাম্য এবং সামাজিক বৈষম্যকে এপিডেমিওলজির অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করে মাইকেল মার্মট জানান – “স্বাস্থ্য হল দীর্ঘ সামাজিক প্রক্রিয়ার পরিণতি ও ফলাফল।” শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রসঙ্গ তুলে মার্মট অসাম্য ও বৈষম্যের জন্য natural justice বা স্বাভাবিক/প্রাকৃতিক ন্যায়ের প্রসঙ্গও বিবেচনায় রাখেন।
Structural violence-এর এক অসহনীয়, মারাত্মক উদাহরণ হল যে সমস্ত অঞ্চলে ক্রমাগত সন্ত্রাস চলছে বা দুটি বিবাদমান গোষ্ঠীর মধ্যে চলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ কিংবা রাষ্ট্র এবং জঙ্গীগোষ্ঠীর মধ্যে নিরন্তর বন্দুক, গ্রেনেড, মর্টারের লড়াই চলছে। এই ক্রস-ফায়ারিং-এর মাঝে পড়ছে সাধারণ মানুষ যাদের এতে কোন ভূমিকা নেই, ভাষ্য নেই, অবস্থিতি নেই। মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে বছরের পর বছর ধরে এ ঘটনা ঘটে চলেছে। আমাদের দেশে এর সর্বোচ্চ উদাহরণ হোল কাশ্মীর। দেখা গেছে লাগাতার হিংসাত্মক কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে জনজীবনের এক বড়ো অংশের মধ্যে বিভিন্ন চরিত্রের মানসিক রোগ হয়, যেমন উদ্বেগ এবং অবসাদ। আরেকটি নির্দিষ্ট রোগের নাম হল PTSD (Post-Traumatic Stress Disorder)। Medicins Sans Frontieres (Doctors without Borders)-এর তরফে ২০১৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে একটি ১০৪ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে বলা হয়েছে – ১৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক কাশ্মিরী (জনসংখ্যার ৪৫%) মানসিক রোগের শিকার, ১৯% PTSD-র। এ রিপোর্টে আরো বিপজ্জনক তথ্য হল – “By 2012, approximately 70,000 Kashmiris had lost their lives in the conflict and 10,000 people had been reported missing.” আরেকটি multi-centric study যা ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল “Prevalence of anxiety, depression and post-traumatic stress disorder in the Kashmir Valley” শিরোনামে, সেখানেও একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এসব রিপোর্টে নজর করার মতো হল যে অসহনীয় হিংসা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিঃসহায়, আর্ত মানুষ বেশি বেশি করে দরগা, পীর বা ঈশ্বর/আল্লা-নির্ভর নিরাময়ের দিকে ঝুঁকছে। আধুনিক মেডিসিনের ওপরে নির্ভরতা কমছে।
(এক দরগায় মানসিক রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। Getty Images)
এটা গেল রোগির অবস্থান থেকে দেখা। আবার এই মুহূর্তের পশ্চিমবাংলার ডাক্তারদের অবস্থান থেকে যদি দেখি তাহলে তাদের ওপরে যে হিংসা ক্রমাগত নেমে আসছে সেখানে তাদের, ভিন্ন অর্থে, “access to care” কোথায়? যখন প্রতি সাড়ে ৩দিনে “জাগো বাংলা”-য় ১জন ডাক্তার নিগৃহীত, রক্তাক্ত বা বিষ্ঠাশোভিত হচ্ছেন তখন কোথায় পাবে বিচার? কে নেবে ডাক্তার সমাজের ক্লিষ্টতার দায়ভার? কিভাবে? পল ফার্মার দেখিয়েছেন কত ঘনিষ্ঠভাবে এবং কতদূর structural violence যুক্ত হয়ে আছে সামাজিক অন্যায় এবং নিপীড়নের social machinery-র সাথে। পশ্চিমবাংলার নির্দিষ্টতায় হতাশ্বাস ডাক্তারদের অবস্থান থেকে এর সাথে বিশেষভাবে যুক্ত করতে হবে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিভিন্ন প্রকাশকে, ্যে প্রকাশগুলো ডাক্তার সমাজের ওপরে ভয়ংকর ক্রোধ এবং আক্রমণ হিসেবে উদ্গীর্ণ হচ্ছে।
হিংসা তথা ভায়োলেন্সের একটি ভিন্ন হিসেব দেখা যাক। Medline চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ সার্চ ইঞ্জিন। Medline সার্চে ১৯৭০-এ “ভায়োলেন্স” এই keyword দিয়ে পাওয়া ফলের সংখ্যা ছিল ২৭১১। ১৯৯০-এর দশকে এ সংখ্যা ৮০০০-এর মতো। আর ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মোট সংখ্যা ১,০৪,৬৩২। এবং suffering বা ক্লিষ্টতা নিয়ে সার্চ রেজাল্টের সংখ্যা ২,৬৬,১৫২। এ থেকে অনুমান করা যায় গত ২৫-৩০ বছরে কি তীব্র গতিতে ভায়োলেন্স সংক্রান্ত রিসার্চ পেপার তৈরি হচ্ছে। হিংসার উৎস কোথায়? ল্যান্সেটে প্রকাশিত (নভেম্বর ৩, ২০০১) “Violence and medicine: the necessary politics of public health” প্রবন্ধে বলা হল – “These triggering factors have political as well as social dimensions … Violence is also part of the debate about globalization.” এর সাথে যুদ্ধে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোর প্রশ্নও জড়িয়ে আছে, একথা উল্লেখ করা হল। এখানে অনুসন্ধানী পাঠকের মনে পড়বে ঠিক ৩০ বছর আলমা-আটা-র ঐতিহাসিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংক্রান্ত ঘোষণায় “independence, peace, détente and disarmament”-এর ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল যাতে স্বাস্থ্যের জন্য আরো বেশি সম্পদ তৈরি করা যায়।
চিকিৎসকের ওপরে আক্রমণ বর্তমান সময়ে পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। আমেরিকাতে প্রধানত বন্দুকের ব্যবহার চলে। কিন্তু এ রাজ্যে এবং আমাদের দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে যেরকম নৃশংসভাবে ডাক্তাররা বারংবার আক্রান্ত হচ্ছে তা যথেষ্ট বিরল এবং এর তুল্য উদাহরণ বেশি নেই। কেন ঘটছে? এর কোন একমাত্রিক, সরলরৈখিক উত্তর নেই। আমরা আমাদের আলোচনার শেষে এ নিয়ে আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা করবো। তার আগে মেডিসিনের আভ্যন্তরীন, অন্তর্লীন সংকট নিয়ে কিছু বিষয় দেখা যাক।
মেডিসিনের অন্তর্গত হিংসার বিভিন্ন রূপ
মেডিসিনের ঐতিহাসিক বিকাশ ও বিবর্তনের মাঝে তীব্র অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব এবং টানাপোড়েন রয়েছে। একদিকে মেডিসিন “art of healing”, অন্যদিকে রোগের হন্তারক। দুক্ষেত্রেই মেডিসিনের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। দেরিদা তাঁর “Plato’s Pharmacy” রচনায় দেখিয়েছেন pharmacon শব্দটি একদিকে বিষ, অন্যদিকে অমৃত বা নিরাময়কারী – দুটো অর্থই বহন করতে পারে। মেডিসিনের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
আমরা রোগকে বুঝি বায়োলজির দৃষ্টিকোণ থেকে। বুনিয়াদি বিজ্ঞানে গবেষণা যত অগ্রসর হয় চিকিৎসা তত আধুনিক, লক্ষ্যভেদী এবং ফলপ্রদ হয়। কিন্তু বায়োলজির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার মাঝে একটা বিপজ্জনক গলদ আছে, আবার অনেকক্ষেত্রে না দেখেও উপায় নেই। একজন ডাক্তারের কাছে হার্ট অ্যাটাকের রোগী এলে তার হার্টে রক্ত চলাচলের অবস্থা, রক্তে বিভিন্ন বায়োকেমিক্যাল মার্কারের পরিমাণ মাপা ইত্যাদি আমাদের প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায় চিকিৎসার স্বার্থে, অনিবার্যভাবেই। কিন্তু রোগী হিসেবে যে আসে সেতো শুধু একটি রোগাক্রান্ত দেহ নয়, একজন মানুষ। অর্থাৎ, আমি একজন biological organism-কে দেখছিনা, দেখছি biosocial একজন person বা ব্যক্তিকে। যখন বায়োসোশ্যাল থেকে শুধু বায়োলজিকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে তখনই একধরনের হ্রস্বীকরণ (reductionism) শুরু হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসাবিদ্যার সমগ্র শিক্ষাক্রম জুড়ে এভাবেই শিক্ষার্থীরা শেখে, চিকিৎসার ধরনও এভাবে তৈরি হয়।
এর মাঝে আরেকটি কথা আছে। স্বাস্থ্যের দুটি ধরনের মধ্যে ফারাক আছে। আমরা সাধারণভাবে সরকারি হাসপাতালে, নার্সিং হোমে, ক্লিনিকে বা পাঁচতারা-সাততারা কর্পোরেট হাসপাতালে যে রোগীদের দেখি তাদেরকে ক্লিনিক্যালি বা ব্যক্তি রোগী হিসেবে দেখা হয়, যাকে আমরা বলতে পারি clinical health – যেখানে একক ব্যক্তিরোগী প্রাথমিক গুরুত্বসম্পন্ন। আবার জনস্বাস্থ্যের এলাকাতে, স্যানিটেশন, হাইজিন, টীকাকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রোগ্রামে যে রোগীদের আমরা দেখি তাদের দেখি public health-এর দৃষ্টিকোণ থেকে – এখানে একক ব্যক্তিরোগীর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তার কমিউনিটি, চারপাশের বান্ধব পরিবেষ্টিত পরিবেশ, যে বিশেষ সামাজিক অবস্থানে সে স্থিত সে প্রসঙ্গগুলো। উভয়ক্ষেত্রেই যদি desocialization প্রক্রিয়া সমানভাবে কার্যকরী থাকে তাহলে clinical health-এর ক্ষেত্রে হারিয়ে যায় ক্লিষ্টতা, আর public health-এর ক্ষেত্রে মেডিসিনের তরফে structural violence-এর বিস্তৃত পটভূমি জন্ম নেয়।
এর মাঝে যে সরাসরি কোন হিংসা আছে তা মোটেও নয়। কিন্তু যে বিযুক্তিকরণ আছে তা dehumanization-এর দিকে নিয়ে যায়। এ বিষয়টি যদি মেডিসিনের বোধে না থাকে তাহলে হিংসার বিভিন্ন রূপে তা প্রকাশ পেতে পারে – যেমন, কথা বলায় বা verbal, আমাদের হাবেভাবে বা attitudinal। এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয় – যেখানে রোগী একটি অবব্জেক্ট, অনিবার্যভাবেই ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ঝুঁকে আছে ডাক্তারের দিকে। এখানে একটি প্রশ্ন আসবে সমাজে যে মানুষটি person, মেডিসিনের দুনিয়ায় প্রবেশ করা মাত্র সে হয়ে ব্যক্তি-সত্তারহিত (depersonalized) একজন রোগী। ৩৫ বছর আগে এরিক ক্যাসেল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন – “The Relief of Suffering”। এ প্রবন্ধে তিনি একজন ব্যক্তির যে চারিত্র্য সে বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। তাঁর বয়ানে – “includes personality and character; the lived past; the family’s past; associations and relationship with family and others, culture, and society; the person’s work and social roles; body image; the unconscious mind; political affiliations; the secret life (which everyone has, whether in reality or in dreams); the perceived future; and the transcendent or spiritual dimension…”। আমরা সমগ্র আলোচনাটিকে অনুধাবন করার জন্য একথাগুলো স্মরণে রাখবো।
রোগাক্রান্ত হওয়া এমন একটা অবস্থা যা মানবসত্তার অনেককিছুকে তছনছ করে দেয়। ব্যক্তির সমগ্রতা বা নিজস্ব অস্তিত্বের কাঠামোকে ভেঙ্গেচুরে suffering বা ক্লিষ্টতার জন্ম দেয়। আবার, এই ক্লিষ্টতাকে বোঝার ও ধারণ করার ক্ষমতা আধুনিক মেডিসিনের নেই।
মেডিসিনের সবচেয়ে মান্য পুস্তক সুবিশাল Harrison’s Principles of Internal Medicine-এ (19th edn.) আধুনিক হাসপাতালের পরিবেশ সম্পর্কে লেখা হচ্ছে – “The hospital is an intimidating environment for most individuals. Hospitalized patients find themselves surrounded by air jets, buttons, and glaring lights; invaded by tubes and wires; and beset by the numerous members of the health care team – hospitalists, specialists, nurses, nurses’ aides, physician’s assistants, social workers, technologists, physical therapists, medical students, house officers, attending and consulting physicians, and many others.” পরিণতি? ওখানেই বলা হচ্ছে – “It is little wonder that a patient’s sense of reality may be compromised.” হ্যারিসনের পুস্তকে যা “সেন্স অফ রিয়্যালিটি” তাইতো প্রকৃত অর্থে রোগীর person বা ব্যক্তিময়তা। সেটাই হারিয়ে গেলো। সাথে হারিয়ে গেলো suffering-কে বোঝার ক্ষমতা ও চেতনা। রোগী যে নিজস্ব জগৎ হারিয়ে ফেলে হাসপাতালে এসে সে হারিয়ে-ফেলা জগৎ এবং হাসপাতালের নৈর্বক্তিক, কেস নম্বর দিয়ে সাজানো জগতের tenuous link হল একজন ডাক্তার এবং তার person বা ব্যক্তিময়তা।
বায়রন গুড তাঁর Medicine, rationality, and experience: An anthropological perspective গ্রন্থে দেখিয়েছেন কিভাবে হার্ভার্ড সহ বিভিন্ন মেডিক্যাল স্কুলে মেডিসিনের নতুন ল্যাংগোয়েজ বা ভাষার শিক্ষায় শুধু নতুন শব্দ শেখা হয়না “but the construction of a new world altogether”। একজন শিক্ষার্থীর দেখার “visual metaphor” রূপান্তরিত হয়ে যায়। অ্যানাটমির ক্লাসে ত্বক (যা এতদিন অনুভূতির অঙ্গ ছিল) কেবলমাত্র আরেকটি শিক্ষার সামগ্রী মাত্র। আলাদা করে কেটে, মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলে বোঝার অবজেক্ট হয়ে যায়। এরকম সংখ্যাতীত উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, সবমিলিয়ে মেডিসিন শিক্ষা চিকিৎসককে যে বিপুল জ্ঞানসম্ভার দেয় তাতে রোগীর নিজের দেহ ও অস্তিত্ব নিয়ে একধরনের হীনমন্যতাবোধ বা epistemological hypochondria যাকে বলে জন্ম নেয়। এ তো অতি নমনীয় এবং সহনীয় হিংসারই আরেক শীলিত রূপ।
তিন দশক আগে আর্থার ক্লিনম্যান তাঁর Illness Narrative বইয়ে জানিয়েছিলেন যে চিকিৎসকদের শিক্ষাক্রমে এই বিশ্বাস জন্মানো হয় যে রোগ (disease) অসুস্থতার (illness) চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিণতিতে চিকিৎসকদের যে জ্ঞান প্রয়োজন সে জ্ঞান “about biology, not knowledge about the psychosocial and cultural aspects of illness.” আমরা নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারবো যে অসুস্থ অবস্থা মানে জীবন একাধিক অর্থ (meaning) নিয়ে হাজির হয় একজন মানুষের কাছে। সমস্ত অর্থকে (meaning) আমরা যদি বায়োমেডিক্যাল মডেলের মধ্যে ধরার চেষ্টা করি তাহলে একটি সুবিশাল গহ্বর বা ফাঁক তৈরি হয় – বায়োমেডিক্যাল আরোগ্যের যে অবয়ব অর্থাৎ “dehumanized disease process” এবং অন্যান্য উৎস থেকে একজন রোগি যে ভরসা এবং জীবনরস সংগ্রহ করে রোগাক্রান্ত জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য, সে দুটির মাঝে। আমরা আরেকবার suffering এবং social suffering নিয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় এলাম। কারণ মেডিসিনের কেন্দ্রে, প্রান্তে, পরিধিতে – যেদিকেই তাকাইনা কেন রয়েছে মানুষ, তার সমস্ত আকাংখা, অপ্রাপ্তি, চাহিদা এবং স্তরায়িত অসাম্য এবং সামাজিক বিভাজন নিয়ে।
২০০৭ সালে ক্লিনম্যান একটি লেকচারে খুব প্রাঞ্জল্ভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলেন – Social suffering is a term employed to break down the barriers across the separate fields of social and health policy, and to picture health (and medicine) as part of the large-scale political, economic, and cultural changes of our era that have widened the gap between rich and poor, contributed to emerging infectious diseases, worsened social and mental health problems, and at the very same time rocked health services and shaken health financing. Social suffering emphasizes the importance of poverty and health disparities across populations. It also draws attention to the fact that some problems are actually worsened by social and health policies.
যুদ্ধের মেটাফর – মেডিসিনের মেটাফর – মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স
১৯৮০ সালে মান্য মেডিক্যাল জার্নাল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর তৎকালীন সম্পাদক আর্নল্ড রেলম্যান একটি সাড়াজাগানো প্রবন্ধ লিখেছিলেন ঐ জার্নালের ২৩ অক্টোবর সংখ্যায়। শিরোনাম – The New Medical-Industrial Complex। সে প্রবন্ধে তিনি পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এটা একেবারে অভূতপূর্ব এক ঘটনা এবং “troubling implications for the future of our medical-care system”-এর ক্ষমতা এর মাঝে রয়েছে। আমরা পরবর্তী সময়ে একথার অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলন দেখেছি এই মুহূর্তের ১১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্য ক্ষমতাসম্পন্ন হেলথ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে। কারা নিয়ন্ত্রণ করে এই ইন্ডাস্ট্রি? কে আবার? দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এখনকার পরিস্থিতিতে একে আমরা বায়োটেকনোলজিকাল মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-ও বলতে পারি। এদের বড্ডো প্রয়োজন টাকে চুল গজানোর কিংবা পৌরুষ জাগ্রত করার (ভায়াগ্রা) মতো ওষুধের। এসমস্ত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ (!) বিলিয়ন ডলারের মুনাফা দেয়। কিন্তু টিবি বা ফাইলেরিয়াসিস বা কৃমির জন্য ওষুধ প্রায় তৈরিই হয়না। মুনাফা সামান্য। এরা orphan drugs-এর দলে পড়ে।
আরেকটি ভীষণ লাভজনক ক্ষেত্র হচ্ছে ক্যানসারের ওষুধ। ক্যানসার-আক্রান্ত রোগী, পরিবার এবং স্বজনদের অসহায়তা সর্বোচ্চ মুনাফা তৈরি করে। মানুষ মেটাফর ব্যবহার করে কেন? একটি বিষয়ের বোধগম্যতা, ব্যঞ্জনা এবং আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার জন্য আমরা একটি শব্দ, শব্দবন্ধ বা রূপকল্প দিয়ে আরেকটি বিষয়ের সাহায্য নিই, অবতারণা করি। যবে থেকে (প্রায় ১৫০ বছর হবে) অ্যান্টিবায়োটিকের আদিরূপ আবিষ্কার হয়েছে তখন থেকে মেডিসিনে তার নাম হয়ে গেছে “ম্যাজিক বুলেট”। আমরা খেয়াল করবো বুলেট শব্দটি ব্যবহারের মাঝে সামরিক মেটাফরের প্রতিচ্ছবি। আরো আগের থেকে, গবেষকেরা দেখিয়েছেন হোমারের সময় থেকে (ভারতে সুশ্রুত), মেডিসিনে যুদ্ধের মেটাফর বারেবারে এসেছে। ১৯০০ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্যানসারের সাথে “যুদ্ধ” ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সাথে এক করে দেখা হত। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ক্যানসারকে “নৈরাজ্যবাদী” হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। ক্যানসার কোশগুলোকে বলা হয়েছে “বলশেভিক” কোশ। (Ornella Moscucci, “Gender and Cancer in Britain, 1860-1910: The Emergence of Cancer as a Public Health Concern”, American Journal of Public health, August 2005)
খোলা মনে ভেবে দেখলে বোঝা যায়, ক্যানসার বা অন্য কোন রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মেটাফর সাধারণ মেটাফরের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একদিকে, রোগকে দেহ থেকে বিযুক্ত করে ফেলা যায় এবং সেটা করা হয়। ফলে রোগীর দেহের চাইতে অধিকতর বা একমাত্র গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে ওঠে রোগ। আগে যেটা বলেছি, এরকম পরিস্থিতিতে রোগীর সাফারিং বা ক্লিষ্টতা কোন আলোচ্য প্রসঙ্গ হিসেবে মেডিসিনের ডিসকোর্সে স্থান পায়না। ময়দানে নেমে পড়ে বায়োটেকনোলজিকাল মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স এদের সমস্ত “সামরিক সম্ভার” নিয়ে। অন্যদিকে, যখন যুদ্ধের মেটাফর বারংবার ব্যবহৃত হতে থাকে মেডিসিনের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জগতে চিকিৎসকদের হাত ধরে তখন যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের কুহকী চেতনায় ঢাকা পড়ে যায় চিন্তার স্বচ্ছতা, স্বাভাবিক বিচারের যুক্তি কাঠামো এবং, সর্বোপরি, ঢাকা পড়ে যায় এর পেছনে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিকে ভেবে দেখার ক্ষমতা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করবো আমেরিকান জার্নাল অফ বায়োএথিক্স-এর ২০১৬ সালের একটি সংখ্যার বিষয়বস্তু ছিল কেবলমাত্র মেডিসিনে যুদ্ধের মেটাফরের ব্যবহার নিয়ে। প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো ছিল – “War Metaphors in Health Care: What Are They Good For?”; “Healing Without Waging War: Beyond Military Metaphors in Medicine and HIV Cure Research”; “Military Metaphors in Health Care: Who Are We Actually Trying to Help?”; “Military Metaphors and Their Contribution to the Problems of Overdignosis and Overtreatment in the “War” Against Cnacer”; ইত্যাদি।
তাহলে আমরা দেখলাম কেবলমাত্র ক্যানসারের ক্ষেত্রেই নয় এইডস-এর মতো রোগের ক্ষেত্রেও সামরিক উপমা ও ব্যঞ্জনা একইভাবে কাজ করে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দুটো রোগই আন্তর্জাতিক মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে সমান কার্যকরী। সমস্ত সামরিক মেটাফর প্রধানত ব্যবহৃত হচ্ছে high-end যে সমস্ত রোগ যেমন ক্যানসার, HIV, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি ধরনের অসুখ নিয়ে। ক্রনিক ইলনেস বলতে যা বোঝায় যেমন হাঁপানি ইত্যাদি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথা কম। অথচ এধরনের রোগে রোগীর সত্তা, জীবনের অর্থ আরো গভীরভাবে বদলে যায়। সাফারিং পড়ে থাকে নিজের একান্ত জগতে।
মেডিসিনের এই গ্লোবাল শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিকিৎসকেরা অজ্ঞানে কিংবা সজ্ঞানে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং বাহক হয়ে যায়। হিংসার এ এক নতুন চেহারা। ভাবলে একটু বিস্মিত হতে হয় বৈকি যে দেহকে এমনকি জাতি-রাষ্ট্রের সাথেও তুলনা করা হয়েছে – “Towards an Anthropology of Immunology: The Body as Nation State” (Emily Martin). দেহকে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভাবলে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাও জমে যায়!
মৃত্যুর দূত, মৃত্যুর কারবারি – মেডিসিন
আমরা নাৎসী অত্যাচারের কথা জানি। ডাক্তারদের একাংশ কিভাবে মানুষকে নানান ধারার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পেত সেকথাও আমাদের বহুপঠিত, বহুশ্রুত। কিন্তু বর্তমান সময়ে ইরাকের আবু ঘ্রাইব বা গুয়ান্তানামো-তে যে পর্যায়ের নারকীয়, পৈশাচিক অত্যাচার চলে এবং তারপরে ডাক্তাররা আবার “ফিট” সার্টিফিকেট দিয়ে আরেকপ্রস্থ অত্যাচারের জন্য প্রস্তুত করে দেয় সে খবর আমরা কম রাখি। কয়েকটি প্রবন্ধের উল্লেখ করব – “Abu Ghraib: its legacy for military medicine” (Lancet, August 21, 2004); “Without Conscience” (New England Journal of Medicine, April 14, 2005); “When Doctors Go to War” (NEJM, January 6, 2005).
আমরা যারা ফুকোর Discipline and Punish বইটি পড়েছি তারা ঐ বইয়ের প্রথম দুটি অধ্যায়ে দেখেছি প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দানের গ্রাফিক বর্ণনা। গা শিউড়ে ওঠা, দেহের প্রতিটি অনুভূতিকে অবশ করে দেওয়া সে বিবরণে আমরা জেনেছি দেহের ওপরে রাষ্ট্রের, রাজনীতির এবং দণ্ডনীতির কি ভয়াবহ পরিণামচিহ্ন এঁকে দেওয়া যেতে পারে – “After two or three attempts, the executioner Samson and he who had used the pincers each drew out a knife from his pocket and cut the body at the thighs instead of severing the legs at the joints; the four horses gave a tug and carried off the two thighs after them, namely, that of the right side first, the other following … When the four limbs had been pulled away, the confessors came to speak to him …” (p. 5) এরকম বীভৎস, বিবমিষা উদ্রেককারী বর্ণনার বাংলা করার প্রয়োজন দেখছিনা।
এলেইন স্কারি তাঁর অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ The Body in Pain-এ যন্ত্রণা এবং ব্যথা নির্দিষ্টভাবে কি করে বোঝাতে গিয়ে বলছেন, দৈহিক যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষাকে শুধু রোধ করেনা, একে সক্রিয়ভাবে ধ্বংস করে “bringing about an immediate reversion to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makes before language is learned.” (p. 4) আমাদের আশ্বস্ত হবার অন্য কারণ আছে। হার্ভার্ড এবং আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে cognitive neuroscience নিয়ে বিপুল উদ্যমে গবেষণা ও চর্চা চলছে। এ গবেষণার একটি অভিমুখ হল যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অর্থাৎ হার্ডকোর টেররিস্ট তারা দৈহিক এবং মানসিক অত্যাচারের ঠিক কোন পর্যায়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে (to the sounds and cries a human being makes before language is learned) তার ব্রেইন ম্যাপিং করা এবং মস্তিস্কের অ্যানাটমিতে কিরকম বায়োকেমিকাল পরিবর্তন হয় সেগুলোকে পরিমাপ করা। দেহ-রাজনীতির এ অন্য এক অধ্যায়। মেডিসিন এর অন্তরঙ্গ সাথী হয়ে যায়।
কিন্তু রাষ্ট্র দেহ-শাস্তি-রাজনীতি-ক্ষমতা এই ন্যারেটিভকে বদলাতে চাইল। সমগ্র ঘটনাই ঘটবে, কিন্তু অন্তরালে – “the disappearance of punishment as spectacle.” চমকপ্রদ ভাষায় ফুকো ব্যাখ্যা করেন – “From being an art of unbearable sensations punishment has become an economy of suspended rights.” এখানে ডাক্তারের ভূমিকা কি? একজন ডাক্তার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে মৃত্যুর সমস্ত প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। একজন “agent of welfare” হিসেবে ডাক্তার দেখবে মৃত্যু প্রক্রিয়াটি যেন যন্ত্রণা ছাড়া শান্তিময় হয়ে ওঠে। কিন্তু নিয়তির বা মেডিসিনের বা রাষ্ট্রের এমনই পরিহাস চিকিৎসকের রাষ্ট্র–নির্ধারিত দায়িত্ব হচ্ছে একজন মানুষের জীবনকে মৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে পার করে দেওয়া।
দেহের ওপরে রাষ্ট্রের কর্তৃ্ত্ব খুব প্রকট হয়ে ওঠে মৃত্যুদণ্ড দেবার সময়, যেমন ফুকোর বর্ণনায় আমরা দেখলাম। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও এর খুব তীক্ষ্ণ, নির্মম এবং অভ্রান্ত চেহারা দেখা যাবে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ডের বিবর্তনের মাঝে। এর পূর্ণাঙ্গ চেহারা ধরা পড়ে স্টুয়ার্ট ব্যানারের The Death Penalty : An American History-তে।
১৯৭৬ অবধি আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত “death by firing squad” দিয়ে। কিন্তু সময়ের সাথে বিচারব্যবস্থা দেখলো এধরনের মৃত্যু “too bloody and uncontrolled”। একাধিক মানুষকে গুলি করার পরেও তক্ষণাৎ মৃত্যু হয়নি। এ কেমনতরো কথা? গণতান্ত্রিক দেশে একজন “অপরাধীকে” মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে অথচ সে একবারে মারা যাচ্ছেনা। সমাজের চোখে খারাপ দেখানোর চাইতেও, আমার বিচারে, রাষ্ট্রের অভ্রান্ততা প্রশ্নের মুখে পড়ছে এরকম মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিতে এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
এরপরে এল ফাঁসী। কিন্তু এটাও “came to be regarded as still more inhumane”। তারপরে এলো নাৎসী হিটলারের মতো গ্যাস চেম্বারের মৃত্যু। কিন্তু ১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা রাজ্যে ডোনাল্ড হার্ডিং-এর মৃত্যু ঘটতে ১১ মিনিট সময় লেগেছিলো। ১৯৭৬ থেকে আজ অব্দি ২ জন বন্দীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়েছে, ৩ জনকে ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়ে এবং ১২ জনকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইলেক্ট্রিক শক (২৬০০ ভোল্ট) দিয়ে মারার পদ্ধতি চালু হল এবং এখানে এসে আবার একটি গোল বাঁধলো। ১৯৭৯-তে এক বন্দীকে ২৬০০ ভোল্টের শক পরপর দুবার দেবার পরেও ২০ মিনিট ধরে তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখ নিয়ে বেঁচে ছিল। রাষ্ট্রের অসম্পূর্ণতা, অকার্যকারিতা আরেকবার প্রমাণিত হল। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের রাজনীতি পূর্ণত প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও “মুক্তচিন্তার” রাষ্ট্র কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারছেনা। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের সাফল্যের ক্ষেত্রে এক বড়োসড়ো প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে একে হজম করা সম্ভব নয়। তখন ডাক পড়ে মেডিসিনের।
ফুকোর গবেষণার এক নতুন চিত্রনাট্য যেন দেখতে পাচ্ছি একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায়। গ্যাস চেম্বার পরবর্তী পদ্ধতি হল “lethal injection”। কি দিয়ে তৈরি এ ইঞ্জেকশন? ২৫০০-৫০০০ মাইক্রোগ্রাম সোডিয়াম থায়োপেন্টাল (জীবিত দেহে অপারেশনের সময়ে এর সর্বাধিক ডোজ ২৫০ মাইক্রোগ্রাম), ৬০-১০০ মিলিগ্রাম pancurium বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ যা সবকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ করে দেয় এবং এই ডোজ স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। এরপরেও দেওয়া হয় ১২০-২৪০ মি.ইকুইভ্যালেন্ট পটাশিয়াম। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে মান্য পত্রিকা নিঊ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর নিবন্ধে একটি মন্তব্য করা হল – “Officials liked the method”, কারণ মৃত্যু ঘটানোর জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলো অ্যানাস্থেসিয়াতে ব্যবহৃত হয়। আরেকটি বড়ো কারণও ছিল – “The Eighth Amendment to the U.S. Constitution prohibits punishment that is “cruel and unusual.” The central question before the Court in Baze is whether the use of sodium thiopental, pancuronium bromide, and potassium chloride violates that constitutional prohibition.” (Gregory D. Curfman, NEJM, “Physicians and Execution”)
রাষ্ট্র-নির্ধারিত মৃত্যু, ব্যক্তি দেহের মৃত্যু, যাতে নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক না হয় সেজন্য রাষ্ট্র চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সাথী করে। রাষ্ট্রের কি গভীর “মানবিক” অনুভব! নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর উদ্যোগে ২০০৮ সালে একটি প্যানেল ডিসকাশন হয়েছিল – “Discussion of Lethal Injection” শিরোনামে। সে আলোচনায় আইনের পরিচিত অধ্যাপক ডেবোরা ডেনো খুব মিহি করে জানিয়েছিলেন – The Eighth Amendment has never said, nor have the petitioners ever argued, that executions are to be pain-free. The question is whether or not that pain is unnecessary, whether there are alternatives. কিন্তু “pancuronium bromide is used in order to enhance the dignity of the inmate who’s dying, because without pancuronium, there might be some jerking or involuntary movements that would disturb some of the witnesses.” যে মানুষটির legalized killing হচ্ছে তার “dignity” ত্বরাণ্বিত করার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে ১০গুণ বেশি ডোজে দেওয়া হচ্ছে pancuronium!
অথচ রাষ্ট্রের তরফে সজোরে এবং সগর্বে প্রকাশ করা এ যুক্তিকে অস্বীকারও করা যাবেনা। কারণ আমরা অর্থাৎ সামাজিক মানুষ ও নাগরিক আগেই এর পূর্ববর্তী স্তর – দেহের ওপরে অত্যাচার ও মৃত্যুদণ্ড কায়েম করার নৈতিক, আইনী ও সাংবিধানিক অধিকার – মেনে নিয়েছি। সাধারণভাবে সামাজিক মান্যতা পেয়েছে রাষ্ট্রের operating techniques, রাষ্ট্র উৎপাদিত জ্ঞান বা logos, রাষ্ট্রের বিভিন্ন sign ও signifier। এর পেছনে রাষ্ট্র উদ্ভাবিত কারণ হল – “it made execution like familiar medical procedures rather than the grisly, backlash-inducing spectacle it had become. (মিসৌরিতে এমনকি হাসপাতালের ঘরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।)” (অতুল গাওয়ান্ডে, “When Law and Ethics Collide – Why Physicians Participate in Executions?”) গাওয়ান্ডে তাঁর Better পুস্তকে একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন – “Medicine is being made an instrument of punishment.”
এরকম সংকট মুহূর্তে আবার একবার ভেবে দেখি।
(১) চিকিৎসার দর্শন নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। আধুনিক মেডিসিন বা বায়োমেডিসিনের কোন বিকল্প নেই। এর চেয়ে উন্নত কোন ব্যবস্থাও নেই চিকিৎসার জগতে। কিন্তু বায়োমেডিসিনের জন্মলগ্ন থেকেই এর মাঝে হিংসা বা ভায়োলেন্সের বীজ উপ্ত হয়ে আছে – জীবনানন্দের ভাষায় “আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর”-এর মতো। উইলিয়াম হান্টার বলেছিলেন “necessary inhumanity”.
(২) আমাদের প্রাত্যহিক যাপনে, মেডিসিনের জগতে, একটি বিশেষ স্থান নিয়ে আছে ভাষার সহিংসতা – ভায়োলেন্স অব ল্যাংগুয়েজ। এটা পশ্চিমী দর্শনের একটি বড়ো সমস্যা।
মানুষ কি দর্শন বাদ দিয়ে চলতে বা ভাবতে পারে? সেতো অদৃশ্য, অধরা, অনির্ণেয় এই ঊর্ণজালেরর মাঝেই রয়েছে। অনেকটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা সম্পর্কের মতো। আমরা রাষ্ট্রের ক্ষমতার মাঝে অবগাহন করে আছি – capillaries of power – তা সে তাবড় রাজনৈতিক বড়দা হোক, পাড়ার লুম্পেন বা সাংস্কৃতিক “পতঞ্জলি” হোক বা বাড়ির পুরুষ হোক।
আমাদের ভাবতে তো হবেই। আমরা আলোকসন্ধানী। জীবক বা আভিসেনা ( Avicenna) তুলনায় আসতে পারেন। কিন্তু নিজেদের জীবনীশক্তি, প্রচণ্ড ক্ষমতা শুধু অন্ধকার ঘেঁটে অপচয় করা যাবে না।
Very nice