আমার বাড়ির পাশেই পাড়ার ক্লাবঘর। ছোটবেলা থেকেই তার সদস্যদের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল। ক্রমে সেই সখ্য ক্যারম খেলা থেকে একত্রে সুরাপানের স্তরে উপনীত হলো। তারপর কালের নিয়মে সেই সদস্যদের পেরিয়ে মদ্যপানই আমার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠলো। মদ জিনিসটা আমার কাছে জীবনের মতোই বৈচিত্র্যময় বলে প্রতীয়মান হতো, কখনো দুঃখে- কখনো বা আনন্দে- জীবনের প্রত্যেক ভাঁজে, প্রত্যেক পরতে মদ জড়িয়ে ছিল। কিন্তু এই যে প্রবহমান সুরাধারা এর উৎস কোথায়! বারোমাসে একশ উনসত্তরবার মদ খাওয়ার আয় আমার কোনোকালেই ছিল না, কিন্তু তা জোগাড় ঠিক হয়ে যেত। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে যখন বোতলের দিকে তাকিয়ে জিগেস করতাম, “কোথা হতে আসিয়াছ সুরা?” সে বলতো, “তোর বাপের পকেট থেকে”। আমি এই উত্তরটাকে কোনোদিন লিটারেলি নিই নি, ভাবতাম সে কথার কথা বলে। একদিন আরো নেশায় তাকে চেপে ধরলাম, “কোথা হতে আসিয়াছ সুরা?” সে রাগত বললো, “একবার বলেছি, বারবার বলবোনা- তোর বাপের পকেট থেকে”।
কথায় আছে, নেশা নাকি মদে থাকেনা, থাকলে বোতলেও মাতলামি করতো। কিন্তু আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে উঠেছিল, শালা মদও সস্তার নেশা করে। কারণ আর যাইহোক মদের টাকা আমার পিতাশ্রীর পকেট থেকে গলবে না। তিনি নেহাতই সজ্জন লোক। রাস্তার ভিখারিকেও টাকা দিয়ে থাকেন। কিন্তু যেদিন থেকে শুনেছেন আমি মদ খাই, আমাকে এক পয়সা ঠেকান না। শুধু আমি না, আমার ক্লাবের বন্ধুবান্ধবেরাও ওনার থেকে সসম্ভ্রম দূরত্ব বজায় রাখে। সেই মহামানবের পকেট থেকে আমার গুড ফ্রাইডের ফিস ফ্রাই আর হুইস্কির পয়সা আসবে, এ আমি মাতাল অবস্থাতেও কল্পনা করতে পারিনা।
মনটা খারাপ হয়ে যায়। যে মদকে বন্ধু ভেবেছি, যাকে জড়িয়ে ধরে বেঁচেছি, সেই এরকম মিথ্যা কথা বলে!! স্থির করি, আর মদ খাবোনা।
একদিন ক্লাবে বসে রাম খেতে খেতে কীভাবে মদ ছাড়া যায় ভাবছি। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে খোদ মদ-দেবতা হাজির। প্রবীণ এক সন্ন্যাসীর বেশ, চোখে রয়্যাল স্ট্যাগ সানগ্লাস, হাতে এক পেগ সোমরস।
স্বগতোক্তির মতো বলে ফেললাম, “আপনি কে নরোত্তম?”
উত্তর এলো, “আজ বহুকাল অবধি আমার সহিত তোমার সখ্য। পুরাতনের মধ্যে কেবল আমি! বাল্যকাল হইতে এ পর্য্যন্ত আমি তোমার জীবন বেষ্টন করিয়া আছি, তোমার জীবনের এক অংশ হইয়া গিয়াছি; কিন্তু আমি কোথা হইতে আসিয়াছি, তুমি জানো না এবং তুমি এতই কর্মবিমুখ অর্থাৎ ল্যাদখোর যে তাহা জানিবার প্রয়োজনও বোধ করো না। এক্ষণে আমাকে চিনিতেও পারিতেছ না!!”
অভিমানের সঙ্গে বললাম, “জিগেস তো করেছি অনেকবার, আপনি তো ভুলভাল উত্তর দেন। মহাদেবের জটা বললেও না হয় কষ্টেসৃষ্টে যাওয়া যায়, এখন তো বিশেষ কষ্টও হয়না ওপাড়ায় যেতে। কিন্তু বাবার পকেট বললে কি আর ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়!”
মদ-অন দেব বললেন, “মহাদেবের জটায় যেমন সৃষ্টির রহস্য নিহিত রহিয়াছে, তোমার পিতার পকেটেও জীবনের বহু অজ্ঞাত রহস্য লুক্কায়িত রহিয়াছে। তাহা খুঁজিলেই বহু প্রশ্নের উত্তর পাইবে।” এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন।
ঘুম আর নেশা- দুই কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম। চুপিচুপি বাবার ঘরে ঢুকে দেখি বাবা নিদ্রা গেছেন। পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে একখানা ওয়ালেট পেলাম, তুলে নিজের ঘরে এলাম। টাকাপয়সা বিশেষ নেই, কোনোকালেই থাকতোনা ব্যাগে। দু’চারটে কাগজ পাওয়া গেলো, একটা ওষুধের স্ট্রিপ। আমি এতটাই উদাসীন ছিলাম বাড়ির খুঁটিনাটি বিষয়ে যে বাবার ওষুধের বিষয়েও অবগত ছিলাম না। ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে একটু মন খারাপ করা উচিত, কিন্তু তাতে আমার মদের উৎস সন্ধানে বিলম্ব হয়ে যেত। তাই আমি সব চিন্তা ছেড়ে ওয়ালেট হাতড়াতে শুরু করলাম। কয়েকটা মানি রিসিট পেলাম। নাহ, আর কিছু নেই। তাহলে রহস্যটা কোথায়! রহস্যের সন্ধান করতে করতে ব্যর্থ হয়ে আবার ঘুম এসে গেল। আবার স্বপ্নে উনি এলেন, এবার সন্ন্যাসী নয়, টিচারের বেশে।
“কী বৎস, কুলকিনারা পাচ্ছোনা?”
বললাম, “না, আমি কোনো রহস্যের গন্ধই পাচ্ছিনা, করোনা হওয়ার পর থেকে এমনিই গন্ধ কম পাই”
“এই মানি রিসিটটা দেখো। দু’লাখ টাকার। বছরটা চিনতে পারছো?”
“২০১০, সে বছর আমি কলেজে ঢুকি”
“তোমার পড়াশোনার জন্য টাকা জোগাড় করতে একটা কোম্পানিতে বেশি রিটার্ণ পাওয়ার আশায় টাকা রাখেন তোমার বাবা। বড় বড় নেতারা সেই কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাই বিশ্বাসের জায়গা ছিল একটা। এই কোম্পানি দু’দিন পর লাল বাতি জ্বেলে বন্ধ হয়ে যায়। পরের বছর ভোটে এই দু’লাখ টাকার কিছু অংশ মদ তুমি গিলেছো ক্লাবের ফান্ড থেকে। টাকা তোমার শিক্ষায় লাগেনি তো কী! তোমার পেটে তো গেছে!”
কথাটা শুনে কেমন বমি পেলো…
উনি বলে চললেন, “এই ওষুধটা দেখো, একেকটা ট্যাবলেটে ২৩ টাকা দাম, বানাতে খরচ ৫ টাকা। তোমার বাবা খান, রোজ একখান করে। এত টাকা কোথায় যাচ্ছে!”
বললাম, “ডাক্তারের কমিশনে আর কি!”
“ঠিক কথা… তোমাদের নেতা বিদেশে গিয়েও এটা বলে এসেছেন বটে! এখন এই নম্বরটা পড়ো দেখি…”
১৩ অংকের নম্বরে ঠিক কত কোটি হয় ভাবার আগেই উনি বললেন, “এই টাকাটা তোমার এই ওষুধের কোম্পানি দান করেছে, তোমাদের সেই নেতার দলকে। আগামী ভোটের প্রচারে। এই ওষুধের দামে বকলমে তোমার মদের পয়সাও তোমার বাবাই যোগাচ্ছেন- ফিস ফ্রাইটা হজম হলো?”
একটা টক ঢেঁকুর উঠে মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে গেছে…
“আরো রহস্য উদঘাটন করতে চাও? এই দেখ তিনশ’ টাকার জাল রশিদ। তোমার বাবা একদিন ভুল করে লেডিস স্পেশাল ট্রেনে চেপে পড়েছিলেন তার ফাইন। এর আদায়কারীরাই ওই ট্রেনে কিন্নররা তোলাবাজি করলে চোখ বন্ধ করে রাখে। সাইবার ক্রাইমের এফআইআর নেয় না, অথচ সারাদিন টিভিতে নিজেদের ঢাক পেটাচ্ছে। এরাই আবার বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে মিম বানাচ্ছে, আর সরকারের বিরুদ্ধে কেউ মিম বানালে জেলে ধরে নিয়ে শুঁটিয়ে লাল করছে। এদেরই একজন তোমাদের ক্লাবের প্রধান।
তোমার মা যেদিন গত হলেন সেদিনের কথা মনে পড়ে? কলকাতার চারটে সরকারি হাসপাতাল থেকে অবলীলায় বেড নেই বলে দেওয়ার পর বাধ্য হয়ে কর্পোরেট হাসপাতালে যাওয়া। স্পেশ্যালিস্ট ডাক্তারের নামে সদ্য ইন্টার্ন হওয়া আরএমও যখন শেষরক্ষা করতে পারলেন না, সেই দিনের কথা তোমার হয়তো মনে নেই, তোমার বাবা প্রতিনিয়ত সেই স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচেন। আবার সেই হাসপাতালের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন কেস লড়ে গেলেন যে উকিল, যিনি জানতেন কর্পোরেট স্বাস্থ্যদৈত্যের সাথে এই যুদ্ধের কোনো শেষ নেই। এই সব সব মানুষেরা তোমার বাবার মতো আরো শত শত মানুষের পকেট ফাঁকা করছেন, যার কিয়দংশ এ-পার্টি সে-পার্টির হাত ধরে তোমার ক্লাবে এসেই যায়।
তোমার সমাজে একটা পেশাও আর সৎ নেই। কেউ যদি এটা অস্বীকার করেন, তবে বুঝবে হয় তিনি নিজেকে ঠকাচ্ছেন, নয়তো তোমাকে। তোমাদের গোটা সমাজটাই এখন ঠগ-জোচ্চরের। তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে মদ খেয়ে পড়ে থাকা, অন্তত সেই সময়টুকু তোমরা কাউকে ঠকাও না, কারো সর্বনাশ করো না। কিন্তু এখন তুমি সেই কাজটাও মন দিয়ে করতে চাইছ না। সরকারের রেভিনিউ আসবে কোথা থেকে? ভোট আসছে, রাস্তা সারাতে হবেনা? কী হবেনা? কী রে ওঠ…”
ঘুম ভেঙে গেল… মাঝরাত… ঘড়ির কাঁটা চলছে কিচ কিচ করে… ফ্রিজ খুলে বিয়ার নিয়ে বসলাম।
জিগেস করলাম, “কোথা হতে আসিয়াছ সুরা?”, উত্তর এলো, “তোর বাপের পকেট থেকে”…