আপনারা কেউ ভূত বিশ্বাস করেন? ‘ভূত’ শব্দটা হয়ত আমার খুব সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়ে গেল। না হয় ‘আত্মা’ বলা যাক। আপনি কি আত্মায় বিশ্বাস করেন? একে প্রমাণ করা কঠিন যে সত্যিই আত্মা আছে কিনা। অনেকে অনেকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোনোটাকেই মেনে নেওয়া হয় নি। আমার তো নিজের মনে হয় কোনোদিনই হয়ত একে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা যাবে না আদৌ আত্মা বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা। তাই আপাতত এটিকে বিশ্বাসের এক্তিয়ারে রাখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তাহলে আবার সেই প্রশ্ন করি, আপনি কি আত্মায় বিশ্বাস করেন?
মেক্সিকান পরিচালক ইনারিতুর ডেথ ট্রিলজির ওপর একটা অনবদ্য সিনেমা আছে। ‘21 গ্রামস’। মনে করা হয় মৃত্যুর পরে আত্মা যখন দেহ থেকে বেরিয়ে আসে তখন মানব দেহের ওজন ২১ গ্রাম কমে যায়। তাই ধরা হয় আত্মার ওজন ২১ গ্রাম। অবধারিতভাবে এই সত্যকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ করা যায় নি, কিন্তু এই ধারনার ওপর ভিত্তি করে ইনারিতু তাঁর এই নান্দনিক সিনেমাটা তৈরি করেছেন। অসামান্য অভিনয় করেছেন শন পেন। আর্টের মূল উৎস মানুষের কল্পনা। কল্পনার বিস্তার অপার। একজন শিল্পী যে কোনো অভিজ্ঞতা থেকে, তা যতই অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক হোক না কেন, তাঁর শিল্পের রসদ সংগ্রহ করেন। এতে পাপ কিছু নেই। একজন শিল্পীর এই দৃষ্টি আপনার কাছে অবাস্তব মনে হতে পারে, তার প্রভাবকে নেতিবাচক ক্ষতিকারক মনে হতে পারে। কিন্তু একজন শিল্পীর তো কোনো দায় নেই যে তাঁকে সমাজসংস্কারক হতে হবে কিংবা মতবাদের যাথার্থ বিচার করার জন্য তাকে তার অনুভবকে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে। তাই তিনি তার দৃষ্টিকে আমার আপনার সাথে ভাগ করে নিয়ে আপনাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যান যেটা আপনি অনুভব করতে পারেন, স্পর্শ করতে পারেন না। পরীক্ষা নিরীক্ষা তো দূরের কথা।
এই নান্দনিক জগতের কেন্দ্রে যেহেতু রয়েছে আমাদের মন তাই তাকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের অনুভূতির দিকে ফিরে তাকাতে হবে। এই অনুভূতি অনেক সময় বড়ই অদ্ভুত। স্থান কাল পাত্র ভেদে এতই আলাদা যে তাকে যুক্তির ছাকনিতে চেলে নেওয়া কঠিন।
মনের গতিবিধি টের পাবার এক অসাধারণ মাধ্যম স্বপ্ন। সুমেরীয় কিউনিফর্মেও স্বপ্নের কথা লেখা আছে। আর মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক জুড়ে তো স্বপ্নের ও তার ব্যাখ্যার ছড়াছড়ি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে দুজন প্রথম মনোবৈজ্ঞানিকভাবে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে একজন ফ্রয়েড এবং অন্যজন তাঁরই শিষ্য ইয়ুং। যদিও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা হয়। বিজ্ঞানীরা প্রথমে ফ্রয়েডের তত্ত্বকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারপর বলেছেন ইয়ুং-এর তত্ত্বেরও কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। সুতরাং তারা সত্য নয়।
আপনি সাইকোঅ্যানালিসিস বা মনোবিকলনকে বিজ্ঞান নাই বলতে পারেন কিন্তু আপনার চেতনার জগতে তার একটা বিশেষ মূল্য আছে বলে আমি মনে করি। বিজ্ঞান এখন চেতনার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারে নি। তাই ফ্রয়েড বা ইয়ুং স্বপ্ন নিয়ে মূল যা বলে গেছেন তাকে আমি অবহেলায় বাতিল কাগজের বালতিতে ফেলে দিতে পারছি না।
আমার সামান্য যেটুকু পড়াশুনো তাতে আমি বুঝেছি খুব সরল করে বললে ফ্রয়েড ও ইয়ুং-এর মতবাদের মূল পার্থক্য হল ফ্রয়েড আলোচনা করেছেন আমাদের অবচেতনা বা সাবকনশাস নিয়ে। ইয়ুং আলোচনা করেছেন আমাদের আনকনশাস বা অচেতন মানসিক স্তর নিয়ে। আমি অন্য আলোচনায় যাব না। আমি এখানে শুধুমাত্র স্বপ্নের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। ফ্রয়েডের মতে স্বপ্নে সেই অবচেতনা আমাদের কাছে ভেসে ওঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অবদমিত যৌনতা। ফ্রয়েড সবসময় এই অবদমিত যৌনতা দিয়ে স্বপ্নদের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। আপনি স্বপ্নের মধ্যে দেখছেন আপনি পালাচ্ছেন এবং বিরাট এক হলঘরের দরজা একটার পর একটা খুলে যাচ্ছে। কিন্তু আপনি কিছুতেই পালাতে পারছেন না। ফ্রয়েড বলবেন এটা একটা যৌনস্বপ্ন। দরজা এখানে নারীর ভ্যাজাইনাকে বোঝাচ্ছে। স্বপ্ন তাই এক অর্থে যৌনতার অবদমনকে বা যৌনভীতিকে আমাদের সামনে খোলাখুলি নিয়ে আসে।
ইয়ুং আবার সব স্বপ্নের মধ্যে যৌনতার এই বাড়াবাড়িকে মেনে নেন না। তার মতে স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের আনকনশাস বা অচেতন স্তর সচেতন মনের সাথে সংযোগ করে। এক অর্থে এটাই তাদের একমাত্র যোগাযোগের উপায়। এ ছাড়া সাধারণের পক্ষে আর অন্য কোনো উপায়ে সেই জগতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। তাই প্রত্যেক স্বপ্নে আমরা যেসব দেখি যেমন ব্যাগ, কুকুর, বিড়াল, বন্দুক, দেবী, তরোয়াল, নদী, প্রেমিকা তারা সবাই একেকটা চিহ্ন। এই চিহ্নগুলোর মাধ্যমে আমাদের অচেতন মনকে বোঝা সম্ভব। কিন্তু এই চিহ্নগুলোর কোনো সার্বজনীন অর্থ নেই। মানুষ ভেদে তাদের অর্থ আলাদা। ইয়ুং এদের বলেছেন আর্কিটাইপ। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো প্রাচীন, আদিম। তার কথা মেনে নিলে প্রজাতির যেমন শারীরিক বৈশিষ্টের বিবর্তন লেখা আছে জিনে, তার মনের বিবর্তনের ইতিহাস লেখা আছে তার জিনে। সেই সব স্মৃতি ডুবে গেছে অতল অচেতনায়। একমাত্র স্বপ্নের মাধ্যমেই তারা আমাদের কাছে ধরা দেয়।
তিনি আরও বলেছেন স্বপ্নের চিহ্নগুলোকে সঠিকভাবে অনুধাবন করে কোনো মানুষের পক্ষে তার বাইরের মনের সাথে গহীন মনের একরকম বোঝাপড়া করা সম্ভব। যিনি এই বোঝাপড়া করতে পারেন। তিনি মানসিক সুস্থিতি লাভ করতে পারেন। এই মতবাদ অনেক ক্ষেত্রেই অধ্যাত্মবাদের দিকে আমাদের ঠেলে দেয়। তা দিক। আমরা আজ অবৈজ্ঞানিক আলোচনায় অংশ নিয়েছি। আমাদের সত্য মিথ্যে নিয়ে মাথাব্যাথা নেই।
আমি তাই প্রবল উৎসাহ নিয়ে আমার স্বপ্নদের দিকে চেয়ে থাকি। প্রতীক্ষা করি তাদের জন্য। স্বপ্নের মাধ্যমেই আমার অচেতন অবচেতন জগৎ আমার সামনে দেখা দেয়। আমি তাদের মোকাবিলা করি। স্বপ্নের মাধ্যমেই আত্মারা আমার জগতে নেমে আসে। মৃত্যুর পরবর্তী জগতের সাথে আমার দেখা হয়। আপনি ভাবছেন আমি হয়ত নতুন নতুন পানাহার শুরু করেছি। নয়ত ডাক্তারি সম্পর্কীত বিষয়ের ওপর লিখতে গিয়ে কেন এসব কথা বলছি। আসলে আমার এই প্রিয় কোলামটি এক অর্থে নিজেকেও দেখা। এ অন্য অর্থে আমার আত্মজীবনীও বটে। তাই এ দীঘিতে তো নিজের ছায়া পড়বেই। আরেকটু সহ্য করুন।
সেদিন মালদায় কোয়ার্টারে একা আছি। সাততলায় আমাদের কোয়ার্টার যেখানে সেখানে তিনটে শোবার ঘর, একটা বড় হলঘর। সেদিন অন্য কেউ নেই। রাতে খুব গরম। দরজা খুলে শুয়ে আছি। সেদিন পূর্ণিমা। চাঁদের আলো ভেসে যাচ্ছে। ঢেউয়ের মত আলো ঘরে ঢুকছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার বিছানার পাশে রাখা চেয়ারটিতে এক শিশু বসে আছে। মেয়েই হবে। কি বিষণ্ণ মুখ! আমি কিছুটা দেখতে পাচ্ছি। সে বাইরে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্নার দিকে। এত বিষণ্ণ কোনো শিশুর মুখ আমি সারা জীবনে দেখি নি। কতক্ষণ চলেছে খেয়াল নেই। চেতনা এলে দেখলাম চেয়ার ফাঁকা। স্বপ্নও এমন হয়! এত স্পষ্ট, এত কাব্যিক! আলো-ছায়ার যে খেলা তা যেন রেমব্রান্টের কোনো ছবি। আমি যদি শিল্পী হতাম তাহলে সেই ছবি আমি হয়ত আঁকতে পারতাম। আমি কবি হলে তাকে প্রকাশ করতে পারতাম। গদ্যের ভাষায় তাকে ধরে রাখা, ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব।
কতদিন হয়ে গেছে সেই ছবি এখনও আমার মনে টাটকা। সবসময় আমার মনে হয় সেই শিশুটিকে যেন আমি আবার যে কোনো দিন দেখতে পাব। আমাদের সব স্বপ্নই আসে রেম স্লিপের সময়। সেই স্বপ্নকে আবার সহজেই ভুলে যাই আমরা। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ঘুমের সময় আমাদের শরীরে নরঅ্যাড্রিনালিন ও সেরোটোনিন নামে দুটি রাসায়নিক কমে যায়। এ দুটোই আমাদের স্মৃতিতে সাহায্য করে। এই ভুলে যাওয়াও এক অর্থে আশীর্বাদ। কারণ ভুলে গেলে আমরা আমাদের মনের ক্ষতচিহ্নগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে পারি। মা যে সন্তানের শোকও ভুলে যায় ধীরে ধীরে সেটা এক অর্থে এই ঘুমের জন্যই।
আমি এখনও সেই শিশুটিকে ভুলি নি। চোখ বুজলে আমি স্পষ্ট তাকে দেখতে পাই। যে কোনো সময়। আমার এই দৃষ্টির কি ব্যাখ্যা হতে পারে আমার জানা নেই। সেই স্মৃতি আমি সঙ্গে নিয়ে চলি। আমার মত এমন কোনো স্মৃতি নিশ্চই আপনারাও বহন করে চলেন যা কখনও সময়ের সাথে পাতলা হয় না। সে কুয়াশার মত মৃদু হলেও জড়িয়ে রাখে। চেপে রাখে। এই দৃষ্টিকে নিয়ে আমি সবসময় ভাবতে থাকি। স্বপ্নদের নিয়েই আমার ভাবনা। আই অ্যাম আ ড্রিমার।
(চলবে)
আজ রাতে মৃতেরা ফিরে আসুক
শ্বাসরোধ করে দিক
কোলবালিশের পেশি
চুরি করে একবার দেখে আসি
হাওয়ামোরগের মন
উৎকন্ঠার সিলিং ফ্যানে
বাচাল ছায়ারা
ফিসফিসিয়ে ওঠে
তাদের তুলোট দেহ
ঘন শিশিরের ভার
চেয়ারে বসা শিশুটি
জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে
তার মুখের রং কী
আর কতক্ষণ চাঁদ দেখবে ও
দারুন দারুন।