কিছু সমস্যার চটজলদি কোন সমাধান হয়না। তেমন সমাধান খুঁজতে যাওয়াটাও বৃথা। কিন্তু না আমাদের সরকার ফটকাবাজিতেই বিশ্বাস করেন এবং আস্থা রাখেন।
সরকার তাঁর মন্ত্রিসভার পাশাপাশি জনগণকেও এই ফটকাবাজিতে অভ্যস্ত করে তুলতে পেরেছেন। বাম আমলে রক্তের সংকট হতো গ্রীষ্মকালে তীব্র সংকট হতো। তারপর দেশে স্বেচ্ছা রক্তদান সংক্রান্ত আইন সংশোধন হলো। ধীরে ধীরে স্বেচ্ছা রক্তদান বাড়ছিল এবং গ্রীষ্মকালীন সংকট কমছিল। এমন সময় রাজ্যে পালাবদল ঘটলো। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে রক্তদান নিয়ে বিশেষ বার্তা দিলেন। স্বেচ্ছা রক্তদান রক্তদান উৎসবের রূপ নিল। এই পর্যন্ত সবটুকুই ঠিক ছিল ।
তারপর একদিন কোলকাতায় উড়ালপুল ভাঙলো শতাধিক মানুষ আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখন বাম ছাত্র যুবরা চটজলদি মানিকতলা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাংক অধুনা IBTM &IH এর সামনে একটি রক্তদান শিবির আয়োজন করলেন চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ব্যাস! সাথে সাথেই পুলিশ প্রশাসন শাসক দলের নেতাদের উদ্যোগে শিবির বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারণ স্টকে অফুরন্ত রক্ত নাকি রয়েছে। যদিও সেই দিনের ব্লাড স্টক স্টেটমেন্ট সেই কথা বলে না। অর্থাৎ “আমরা শাসক, আমাদের শাসনকালে তুমি মানুষের জীবন বাঁচানোর ক্রেডিট নেবে এ কক্ষণো হতে দেওয়া যায় না।” এই মনোভাবের সফল উদযাপন ঘটিয়ে সাধারণ কর্মী সমর্থক তথা প্রশাসন এবং সর্বোপরি জনগণের মধ্যে এই “বার্তাটি রটি গেল ক্রমে”।
কিছু সমস্যা ও তার সমাধান যে শুধুমাত্র আমাদের শিক্ষা, চেতনা, কর্তব্য ইত্যাদির মধ্যেই লুকিয়ে আছে তা ভুলিয়ে দেওয়া হলো। রক্তদান হলো সময়ে সময়ে উৎসব করে মাইক টাইক বাজিয়ে ‘থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের সাথে ভূপেন হাজারিকার পাঞ্চ’ দিয়ে তৈরি একটি বিনোদন। তাতে মন্ত্রী আসবেন, এম এল এ আসবেন, নয়তো কোন খেলোয়াড় কিংবা অভিনেতা অভিনেত্রী আসবেন। একটি হৈ চৈ ম্যাক্স প্রো লেবেলের কলতান মুখর আসরে হাতে একটি গিফটের প্যাকেট নিয়ে সেলফি তোলার ব্যাপার হয়ে গেল রক্তদান। (কোন সভ্য দেশে এইভাবে রক্তদান শিবির করে প্লাস্টিকের মাছের ট্রে করে কালেক্টেড ব্লাড নিয়ে যাওয়া হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে উদযাপনই মুখ্য বাকি টেকনিক্যাল ব্যাপার সবই গৌণ।)
এই রকম চলতে চলতেই কোভিড এলো। মহামারী নিয়ন্ত্রণ আইনে স্বাভাবিক ভাবেই এই মোচ্ছব বন্ধ হলো। ব্যাস আমাদেরও তো ততদিনে পাড়ার ইস্কুল ঘরে গ্লুকোজ জল খেয়ে রক্তদান করার অভ্যেস চলে গেছে। আমরা নিশ্চিন্তেই বাড়িতে থাকলাম। আমাদের অভ্যেস করানো হলো আরো বাস ট্যাক্সি ম্যাটাডোর ইত্যাদি বাড়ির বারান্দায় ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়িতে রক্তদান করানোর। অন্ততঃ কোলকাতার ক্ষেত্রে যেখানে বাড়ির থেকে ২/৩ কিলোমিটারের মধ্যে কোন না কোন ব্লাড ব্যাংক আছে সেখানে খুব সহজেই মানুষ গিয়ে রক্তদান করে আসতে পারেন। বরং এই সুবিধা প্রয়োজন ছিল জেলাগুলির ক্ষেত্রে। সেখানে ব্লাড ব্যাংকগুলিতে আসতে মানুষকে ৫০/৬০ কিলোমিটার যাতায়াত করতে হতো। কিন্তু আমরা দেখলাম ঠিক উল্টো ব্যবস্থা। এরই মধ্যে অসংখ্য রক্তদান শিবির বাতিল করা হয়েছে শুধুমাত্র কোন শাসক দলের নেতা তার আয়োজক ছিলেন না এই কারণে।
মানুষ বিপদে না পড়লে বুঝবেনও না এই অবস্থার কী ভয়ংকর পরিণতি। যাঁরা রক্তদান সম্পর্কিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন আপনাদের কাছে অনুরোধ, সর্বপ্রথম রক্তদান এবং রক্তসঞ্চালন এই সমগ্র বিষয়টি যথাযথ অনুশীলন করে ছাত্র ছাত্রী এবং সমগ্র স্তরের মানুষের কাছে তার বার্তাগুলি পৌঁছে দিতে হবে। একজনের প্রয়োজনে অন্য মানুষ রক্ত দেবেন এবং তার জন্য রক্তদাতা খুঁজবো এটা আসল সমাধান নয় ।
সুস্থ পুরুষ ও মহিলা নিয়মিত সময় অন্তর ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে রক্তদান করে আসবেন। ব্লাড ব্যাংকে সব গ্রুপের রক্ত সর্বদা যথেষ্ট পরিমাণে মজুত রাখতে হবে এটা আমাদেরই দায়িত্ব। এর জন্য কোন অনুষ্ঠান কোন উদযাপন জরুরি নয়, কাজটাই আমাদের নিজেদের তথা পরিবারের সুরক্ষার জন্য জরুরি এই কথাগুলো বোঝাতে হবে ।