সুধীর চক্রবর্তীর মাটি পৃথিবীর টানে থেকে নেওয়া
গ্রামের বাড়ি মানে একটা বটগাছ। হাইরাইজ নয়। ছড়ানো ছেটানো-চারিদিকে ঝুরি নামিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরা। মানুষগুলোও তাই- লতায়,পাতায়, শিকড়ে আকর্ষে সব মানুষকে জড়িয়ে ধরে বাঁচা। পুজোর সময়ে দেশ গ্রামে যাওয়া হয়। লাল মাটির দেশ। তাও সব বছর যাওয়া হয় না। উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো লালমাটিয়া জমি, ক্ষীণতোয়া ঝর্ণা। হাতির উচ্চকিত ডাক-ঝরে পড়া পাতা- এই সব ঠেলে ঠেলে পেট্রোল পাম্প আর শালী নদীর ব্রীজ পার হয়ে শাল বনের পাশে আমাদের গ্রাম। দূরে শালের বন, সামনে গাজনের মেলা, যামিনী রায়ের বাড়ি, ঠাকুর দালান, শ্রীধর দালান-সব পেরিয়ে আমাদের বাড়ি। দেওয়ালে অশত্থ, হরিণের স্টাফড মাথা-একটা ফ্রেমে বাঁধানো সপরিবার মিনি দুর্গা প্রতিমা।
দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আমি চায়ের দোকানে ক্লান্ত হয়ে বসি। চা সঙ্গে সিগারেটে সুখটান।
“হাঁ গো, তুমি অম্মলদার ব্যাটা না?”
“হ্যাঁ গো কাকা”
সিগারেটটা নিয়ে বড়ো দোটানায় পড়ি। এতো হাইরাইজ শহর নয়। এখানে দশতলার বারান্দা আর কুঁড়ে ঘরের ফারাক নেই। সমান ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা আত্মীয়। পথে যত জনের সঙ্গে দেখা, সবাই আমার পিতৃকুলের আত্মীয়।
ঘরে এসে তালা খুলে দিতেই আমাকে একটা পুরোনো গন্ধ গ্রাস করে নেয়। জুতোর তলায় জমে থাকা ধুলো, টিকটিকির পায়খানা আর মরা পোকামাকড় মাড়িয়ে ঢুকে ঘর সাফাই করে পেরেক বার করা, নড়বড়ে পুরোনো মেহগনি কাঠের চেয়ারে বসে হাঁফ ছাড়লাম।
“দরজা খোল্যাঁ ক্যানে? কে বট্যঁ গো ভেতরে?” বাইরে থেকে হাঁক শোনা যায়। তাকিয়ে দেখি ইসমাইল ফকির।
“তোমার খবর কী গো কাকা? চললে কোথায়?”
“ও অমলদার ব্যাটা? কত্তো দিন বাদে এল্যাঁ গো তুমি…”
কী আর করবো একটা অসহায় গোছের হাসি হেসে সামাল দিই।
“আমি আর কুথাকে যাবো গ্য? খোঁজে চলেছি”
পাশের বাড়ির কার্নিশে বাঁধা হাঁড়ির ভেতর থেকে পায়রাদের বকবকম শোনা যায়। হয়তো পদ্ম গোখরো ভাঙা পাঁচিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে বুকে হেঁটে পার হয়ে যায় বাঁশ বন। উড়ন্ত কবুতরের ডানার ঝটফটানি হাততালির শব্দের মতো পুরোনো ইঁট সুরকির দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খায়। ইসমাইল ফকির কিসের খোঁজে যাচ্ছে জানার আগেই ওর গান বেজে ওঠে। বুড়ো ফকির কোটরগত চোখ বন্ধ করে তারসপ্তকে গান ধরে। ওর তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর তারসপ্তকে বেজে ওঠে
“মানুষ মানুষ বলে সবাই
কে করে তার অন্বেষণ”
স্তব্ধ বসে থাকি। মানুষের জন্য অন্বেষণ এক অনন্ত সন্ধান।
ফকিরকাকা বলে “অমলদা-ভাবি-সব তো চল্যাঁ গেল.. ইবার তো আমাদের ডাকও আসবেক গ্য”
আমি চুপ করে থাকি। কথাটা বাস্তব।
“উঠ গ্য শহরের ভাইপো, ব্যালা হলো। গরীব ফকিরের ঘরে চল্যঁ। আজ দুকুরে আমার ঠেঙে দুটো ভাত খাও ক্যানে?”
এই আমন্ত্রণে না বলার জায়গা নেই। এই ভালবাসাকে অপমান করার সাহসও নেই।
দরমা আর মাটির বাড়ি। ওপরে তালপাতা আর টিনের চাল। একটুখানি নিকানো উঠোন-সেখানে নেবুগাছ।
“ফতিমা দ্যাখো ক্যানে- কাকে এনেছি”
ফতিমাকাকি বেরিয়ে আসে। “ওম্মা কবে এলি রে?এই অবেলায়… যা শিঘ্রি চান করে আয়… ওগো শুনছো বট্যেঁ ওকে পুকুরের রাস্তাট্যঁ দেখিয়ে দাও…”
ফকিরকাকা হাসে “রাস্তা কী দিঁখানো যায় গ্য? রাস্তা চিন্যে লিঁতে হয়”
কাকিমার ঘামস্নিগ্ধ মুখটা কুঞ্চিত হয় “ঢং দ্যাখো ক্যানে”
চান সেরে ফিরতেই ফতিমাকাকি ভাত দ্যায় কাণা উঁচু সানকিতে। “আগে জান্তম না। কী বা ঘরে থাকে বলো দিনি?” ফতিমাকাকি ভাঙা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করে। নিজের ভেজা ভেজা আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ডাক আসে।আমি জিজ্ঞাসু চোখে ফকিরকাকার মুখের দিকে তাকালাম।
ফকিরকাকা ভাতের গরাস মুখেই গান ধরে।
“নামাজ আমার হৈলো না আদায়
নামাজ আমি পড়তে পারলাম না
দারুণ খান্নাতের লায়।(খান্নাত মানে অভাব)
এয়েষার নামাজের কালে
বিবি বলে চাল ফুরাইছে
ছেলে মেয়ের কান্দন শুনি
কান্দে পাগল দূরবীন শা’য়।”
“খেতে খেতে গান করছ্যঁ? আবার? কতোদিন বুল্যা করেছি… পাগল একটা” ফতিমাকাকির ভাঁজ পড়া মুখ থেকে গর্ব চুঁইয়ে পড়ে।
“এটা হঁল্যো ভাতছানা। পান্তা ভাত শুকনো কর্যেঁ নিংড়ে তাতে নুন লঙ্কা পেঁয়াজ মেখ্যাঁ…”
কাকিমা বলে “আজ আমি চ্যাং মাছ ধ্যরলম, উটো ডালে দিঁয়্যে”
দুপুরে সামনের উঠোনে নিমগাছের ছায়ায় বসে আছি। লেবুগাছে বুলবুলি দম্পতি কলর বলর করছে। চালের ওপর ঘাড় বেঁকিয়ে বসে মাঝে মাঝে ডাকছে। নিস্তব্ধ দুপুর। দূরে শ্যালো পাম্পের ভটভটানি। শালিকের ডাক। ফকিরকাকা পাশে বসে বিড়ি টানে।
“আচ্ছা কাকা আমি যে হঠাৎ করে এলাম… তুমি আমাকে খেতে ডাকলে… আমি…এভাবে এসে কি অসুবিধে করলাম? কাকিমা দেখলাম লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে জলমুড়ি খাচ্ছে..”
“কিছুই ত্য করল্যম না ভাইপো… অতিথ মানুষ বচ্ছরে একবার আসে… হ্যাঁ একবার এল্যেঁ য্যানো মনে রাখে”
“আমার মনে থাকবে কাকা। দোকানে মোকানে খাই। এ্যাতো ভালবাসা তো ওখানে থাকে না। রোজ রোজ ডাল আলুভাজা ডিম… আজ….শহরে কেউ এ্যামন করে কাউকে বাড়িতে কেউ ডাকে না কেন?”
ফকিরকাকা গান ধরে “গুরুবীজ পুঁতলে পাষাণে
অঙ্কুর হবে ক্যানে?অর্থ বুঝলে ভাইপো?”
আমি ঘাড় নাড়লাম।”না বুঝিনি”
“ভালো বীজ পুঁতলেই বৃক্ষ হবে ক্যানে? গোড়া যদি মাটি যদি না পায়? হবেক নাই গ্য বৃক্ষ।
শহরে মাটি নাই গ্য ভাইপো তাই বৃক্ষে প্রাণ নেই”
বুঝতে পারি সমস্ত বিবাদ বিসম্বাদের পরেও চাষী বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাণ- তার মাটি। মাটিই তাদের প্রাণ।
‘ও পুকুরের মাছ
ও ধান,ও মুরগী ছানা
তাড়াতাড়ি বড়ো হও তোমরা
ও নারঙ্গ, ও ঝুলন্ত জাম্বুরা
তাড়াতাড়ি পেকে ওঠো।
এক জীবন ধরে ধিকিয়ে ধিকিয়ে জীবনযাপন
তার সময় কই।’ (শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়)
মনে পড়ে নৃসিংহ মুরারি দে’র কবিতাংশ
‘আপনার বাড়িতে ফ্রিজ আছে।
আপনার বাড়িতে রঙিন টিভি আছে
এবং এন্তার ভিডিও ক্যাসেট আছে।
আপনার অনেক লকার আছে, ভল্ট আছে-
সাপের চামড়ার জুতো আছে।
……
……..
আচ্ছা বেশ তো
আপনি কোথায় আছেন আপনার বাড়িতে?’