১৮৯৩ এর এক শীতের সন্ধ্যা, সন্ধ্যা কেন রাত্রিই বলা চলে কারণ সময়টা রাত নটা। দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল প্রদেশের এক রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে বসে ভাবছেন এক তরুণ আইনজীবী। ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন কিন্তু সাহস হচ্ছে না সঙ্গে থাকা ব্যাগ এর ভেতর থেকে ওভারকোটটা বের করে গায়ে দেওয়ার। কারণ একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
সুধী পাঠক, চলুন, একটু আগে ফেরা যাক। ডারবান থেকে প্রিটোরিয়া যাচ্ছিলেন ওই যুবক মক্কেলের দেয়া টিকিটে ফার্স্ট ক্লাসের বগি চেপে। পিটারমারিটসবার্গ এর ওই স্টেশনে বগিতে আসেন এক শ্বেতাঙ্গ যাত্রী। বর্ণবিদ্বেষী ওই যাত্রী একই কামরায় ওই অস্বেতাঙ্গ ভারতীয় যুবকের সাথে সফর করতে রাজি হন নি। শুরু হয় বচসা। হাজির হয় রেল কর্মচারী। প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণের ছাড়পত্র হিসেবে টিকিটটি দেখিয়ে ওই যুবক উকিল ট্রেনের কামরা বদল করতে দৃঢ় ভাবে অস্বীকার করেন। ডাকা হয় পুলিশ কনস্টেবল। আইনের সেই ক্ষুদে শান্তিরক্ষকটি আইনের আদৌ তোয়াক্কা না করে প্রভুদের খুশি করার তাগিদে নিজের বোধবুদ্ধি বিবেক বিসর্জন দিয়ে ধাক্কা মেরে টেনে হিঁচড়ে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দেয় যুবকটিকে।
ওই যুবক পরবর্তী কালে নিজের আত্মজীবনী মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ এ ঘটনাটির বিবরণী দিলেও বলপ্রয়োগের বিস্তারিত কিছু লেখেন নি। সুধী পাঠক, আমরা আজও জানি না যে ও বলপ্রয়োগের মধ্যে যুবকটির বুকে পদাঘাত ছিল কি না। সত্যনিষ্ঠ হওয়ার তাগিদে তাই বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি প্রায় পদাঘাত এর সমান ধাক্কা লেগেছিল যুবকটির বুকে। ইংরেজ পরিচালিত আইনি শাসন এর রূপ সম্বন্ধে যে ধারণা যুবকটি সযত্নে লালিত করতেন সেটা ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল, বর্ণবিদ্বেষবাদ এর চেহারাটা নগ্ন হয়ে গিয়েছিল।
শীতে কাঁপতে থাকা ওই যুবকের এই বিচ্ছিন্ন ঘটনটা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কারণ ওই ঘটনার পর জন্ম নেয় শোষণ বঞ্চনার অন্যায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক নতুন স্বর কে। পরাধীন দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ঘটনাকে স্মরণ করে ঘটনায় একশ চার বছর বাদে ১৯৯৭ সালে স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকার নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা ওই পিটারমারিটসবার্গ স্টেশনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে কি বলেছিলেন তার এক ভগ্নাংশ সুধী পাঠক এর সামনে হাজির করছি, “Just as the incident we are commemorating fired Gandhi’s resistance to oppression, may today’s award inspire us all to join hands to realise our shared vision of a better life for all.”
সেদিন পুলিশের ধাক্কা খেয়ে কিম্বা লাথি খেয়ে প্ল্যাটফর্মে ছিটকে পড়েছিল এক সামান্য ভারতীয় প্রতিবাদী উকিল কিন্তু ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর অন্যতম প্রতিবাদী প্রতীক যার নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। সুধী পাঠক আমাদের জানা নেই সেদিন কসবা ডি আই অফিসে শান্তিরক্ষকদের ধাক্কা খেয়ে লাথি খেয়ে ঠিক কতজন প্রতিবাদী যুবক যুবতী মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি। আবার হয়তো দেখব। আবার হয়তো দেখব গায়ের ধুলো ঝেড়ে মনের ক্ষত নিয়েই উঠে দাঁড়াবেন কোনো প্রতিবাদী শিক্ষক আমাদের কাছে প্রবাদ প্রতিম উদাহরণ হিসেবে। হয়তো পিটারমারিটসবার্গ শহরে স্থাপিত গান্ধীর মূর্তির মতো কসবা ডিআই অফিসের মাটিতে স্থাপিত হবে তাঁর মূর্তি অন্যান্য প্রতিবাদীদের প্রেরণা জোগাতে। কারণ আমরা জানি অন্যায়কারীরা শেষ কথা বলে না। সেই শুভক্ষণে এর অপেক্ষায় থাকলাম যেদিন প্রতিবাদীরা প্রতিকার পাবেন তাদের প্রতি ঘটে যাওয়া চূড়ান্ত অন্যায় অবিচারের। কা’কে আমরা মনে রাখতে চাই সেটা সুধী পাঠক আপনিই ঠিক করবেন, লাথি কষানো সেই ক্ষুদে শান্তিরক্ষককে না কি যার বুকে লাথি পড়েছে সেই প্রতিবাদী শিক্ষককে। চয়েস আপনার।
দারুণ লেখা। জানা হলেও পড়ে ভালো লাগলো।
👍👍👍
দূর্দান্ত! মন ভরে গেলো।লেখাটা নিলাম। নিয়েছি কেমন…।❤️❤️🙏