বিক্ষোভ জমায়েতের পূর্ব ঘোষণা মত আমরা বাংলার নাগরিক থেকে নির্দিষ্ট সময় অনুসারে তিনটের আগেই শ্রদ্ধা, শমিতাদি, মন্দাক্রান্তা ও আমি হাজির হয়ে গেছিলাম। আজকের এই বিক্ষোভ ছিল প্রতিবাদী চিকিৎসক নেতাদের উপর ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কাউন্সিলের মিথ্যা এফ আই আর-এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে। নির্দিষ্ট সময়মতো সভা শুরু হয়েছিল, সভার সূচনা করলেন ডঃ পুণ্যব্রত গুণ।
তিনি শুরুতেই জানালেন যে এই যে ডাক্তারদের হেনস্তা করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ এই যে আশফাকুল্লার ক্ষেত্রে তার ডিগ্ৰিতে, কোথায় কে এম এস লিখেছে বলে, ওরা বলছে মিথ্যার ডিগ্রি লিখছে। এটা কোন ও যুক্তি হল!!! আশফাকুল্লা পরীক্ষা দিয়েছে, তার রেজাল্ট প্রকাশ হতে আর কয়েকটা দিন বাকি। তাও সে নিজের প্রেসক্রিপশনে বা কোথাও নিজের ডিগ্রীতে এম এস লেখেনি। তিনি সেই সঙ্গে জানান আমি একজন এমবিবিএস ডাক্তার এখন কেউ যদি আমাকে এমএস বা এফআরসিএস লিখে দেয়, তার দায়িত্ব আমার নয়। তিনি আরও বলেন যে আশফাকউল্লার কাকদ্বীপ গ্রামের বাড়িতে ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশ গিয়ে তার বাড়ি সার্চের নামে হামলা করে তছনছ করেছে। তিনি আরও বলেন, যে, সুবর্ণ গোস্বামী, মানস গুমটা, অধ্যাপক উৎপল বন্দোপাধ্যায় ও আই এম এ র অধ্যাপক রঞ্জন ভট্টাচার্য- এর বিরুদ্ধে পুলিশি ডায়েরি করা হয়েছে। তারা নাকি মেডিকেল কাউন্সিলের সামনে প্রতিবাদ জানিয়ে মেডিকেল কাউন্সিলের দৈনন্দিন কাজকর্মকে ব্যাহত করেছেন। এটা অবশ্য পরিষ্কার নয় যে, তারা এটা জেনারেল ডায়েরি করেছে না এফ আই আর করেছে। তিনি বলেন, যাই করা হোক না কেন আপনার কাছে প্রতিবাদ জানাতে আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি। আমরা জয়েন্ট প্লাটফর্ম এর পক্ষ থেকে বা অভয়া মঞ্চের পক্ষ থেকে, আমাদের এই আন্দোলনকে এভাবে রোখা যাবে না। বলে এক দল পুলিশের সামনেই তিনি এই ঘোষণা করেন। তিনি বলেন এই কথাগুলো বোঝাতেই আমরা আবার তাই আজ এই মেডিকেল কাউন্সিলের সামনে বিক্ষোভ জমায়েতে সামিল হয়েছি। আমাদের প্রতিবাদ সব সময় শান্তিপূর্ণ ছিল। আজও অন্যথা হবে না। এই বলে তিনি পরবর্তী বক্তা ডক্টর সুকান্ত চক্রবর্তীকে ডেকে নেন।
ডাক্তার সুকান্ত চক্রবর্তী ডঃ পুণ্যব্রত গুণের সুর অব্যাহত রেখে বলেন যে আমরা মেডিকেল কাউন্সিলের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে আসিনি। সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন অবশ্য যদি ধরে নেই ওনারা কাজ করেন তাহলে এই কথাটা ভ্যালিড হয়। তিনি বলেন মেডিকেল কাউন্সিল যে ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল তা একটা সম্পূর্ণ প্রহসন ছিল কারণ মেডিকেল কাউন্সিল শাসকের নয় ডাক্তারদের একটা সংগঠন। কিন্তু সেখানেও সরকারপন্থী বলে এক দল ভোট লড়তে নেমেছিল তাতেও কারুর আপত্তি ছিল না। কিন্তু যখন গণতন্ত্রের খুন হচ্ছিল, তখন তারা সরব হয়েছিলেন। আর মানস চক্রবর্তী নামের যে রেজিস্টার আছেন তার চাকরি ২০২১ সালে শেষ হলেও তিনি এখনও অবৈধভাবে সেই পদে বহাল রয়েছেন। অবৈধভাবে বহাল থাকার কথা জয়েন্ট প্লাটফর্ম থেকে বলা হচ্ছে, খোদ স্বাস্থ্য সচিব তাঁকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছেন যে তিনি এখনও কেন ওই পদে বহাল রয়েছেন। উত্তরে মানস বাবু নাকি তাকে জানিয়েছেন যে, তিনি অসুস্থ তাই কাগজপত্র এখন দিতে পারছেন না। সেই মানসবাবুর নেতৃত্বে প্রায় ডাকাতি করে ভোটে সরকারপক্ষের দলকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এরপর প্রলয় বসু মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন আমি বেশী কিছু বলবো না। কারণ এই লড়াই শুধু ডাক্তারদের নয় এ লড়াই আপনাদেরও। তিনি ডাক্তারদের ভয় করেন না, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠকে ভয় পান। তিনি ভোটকে ভয় পান। নিজের ভোটার হিসেবে ডাক্তার কজন!!? কিন্তু আপনারা অনেক। আপনারা আওয়াজ তুলছেন বলেই তিনি ভয় পাচ্ছেন। আর ভয় পাচ্ছেন বলেই এভাবে ধরে ধরে ডাক্তারদের হেনস্থা করছেন। ডক্টর প্রলয় বসু গলার জন্য কথা বলতে পারছিলেন না। তার গলায় ব্যথা এবং কাশির জন্য তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তাও শরীর তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি তার মত করে সুদৃঢ় বক্তব্য আমাদের সামনে পেশ করেছেন।
এরপর প্রতিবাদী গান গাইলেন ডক্টর তরুণ কর তাঁকে যখন মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেয়া হল। তিনি অসহায় ভাবে বললেন আমাকে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিল। তখন রব উঠল গান হোক। তিনি প্রতিবাদী গান গাইলেন। সেই গানটা ছিল “ওরা ভয় পেয়েছে রব সন, আমাদের কুচকাওয়াজ ভয় পেয়েছে… ওরা বিপ্লবের ডম্বরুকে ভয় পেয়েছে। ”
তারপর ডক্টর আশফাকুল্লা নাইয়াকে ডাকা হয়েছিল। তিনি প্রথমে এসেই অভীক দে এবং বিরুপাক্ষ বিশ্বাসের ছবি দিয়ে লেখা একটা পোস্টার এই চোর ডাকাতেদের বাঁচায় কে? নিচে লেখা চৌদ্দ তলার বাঁড়ু্জ্জে। সেই পোস্টার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন এসব ছাগল পাগলদের নিয়ে পোস্টার লিখে লাভ নেই। এটা কোনও ব্যক্তি কেন্দ্রিক আন্দোলন নয়, এটা একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই। তাই এসব পোস্টার একদম রাখবেন না পোস্টার সরানো হলে তিনি সবিনয়ে জানান–আমাকে ভুল বুঝবেন না। এই অভীক বিরুপাক্ষ আশীষ পান্ডে এরা সব কিন্তু পড়াশোনা করতে এসেছিল। ওদের এই সিস্টেম নষ্ট করেছে। এখন না আটকালে এরকম আরও সন্দীপ অভীক আশীষরা আসবে। সেটা এদের দোষ নয়, পুরো দোষ সিস্টেমের। ব্যক্তিটি হল প্রভাবের প্রতিফলন। সন্দীপ ঘোষ একজন মেধাবী অর্থপেডিক ছিলেন।কিন্তু তার কাছে যেখান থেকে গুড মর্নিং, বা শুভনন্দন আসত দোষ সেই সিস্টেমের। তাই আমরা এই সন্দীপ ঘোষ বা আশীষ পাণ্ডেকে দেখতে পাচ্ছি। এজন্য নতুন সিস্টেম বানাতে হবে। যেখানে এই সন্দীপ ঘোষ বা আশীষ তৈরি হবে না। তিনি বলেন এই সিস্টেমে পুলিশও অসহায়। নাহলে পুরুলিয়ার সাব ইন্সপেক্টরের মেয়ের ধর্ষণ ও মৃত্যু হওয়ার পর মেয়েটির মৃতদেহ পচা ডোবার মধ্যে পাওয়া যেত না।
এরপর মন্দাক্রান্তা সেন বললেন কেমন আছেন আপনারা? সবাই যখন জানালো, ভাল নেই। তিনি বললেন এখন ভালো থাকাটাই কু ইঙ্গিত। আমরা কেউ ভাল নেই। একথা বলে তিনি একটি তাঁর স্বরচিত কবিতা পাঠ করলেন। কবিতার নাম স্পর্ধা।
শাসক তোমার নেই তো চোখের পর্দা,
প্রতিবাদীদের আটকাবে এত স্পর্ধা…
এরপর অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী ও নাট্য ব্যক্তিত্ব বিমল চক্রবর্তী তাদের মতামত জানান, তাদের বক্তব্যও এই সিস্টেমের লোকদের বিরুদ্ধে ছিল। এরপর গোপা মুখোপাধ্যায় বক্তব্য পেশ করেন তিনি বলেন অভীক দে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ। তাতেও তারা ডাক্তার দিদির গলায় যে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে সেগুলো পরীক্ষা করলেন না। কেন?? সেটা কী ইচ্ছে করে? যাতে মূল অভিযুক্ত তাদের লোক বলে প্রমাণিত না হয়।!? তাই তারা ইচ্ছে করে ই ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেননি। এরপর এসডিএফ- এর ডঃ স্বপন বিশ্বাস বক্তব্য রাখেন, যা আগের বক্তব্যগুলির প্রতিধ্বনি ছিল।
এর মধ্যে আমাদের শমিতা দির গলায় “আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়” এত সুন্দর করে গাইছিলেন, দিদি যেন আমাদের মধ্যে একটা উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিয়েছিল। ঋতুপর্ণা ম্যাডামের কথাও আমার খুব ভালো লেগেছে, তিনি বলেছিলেন একটা টিভির আলোচনা মঞ্চে বলা হয় “পশ্চিমবঙ্গ বলে এরা আন্দোলন করতে পারছে। উত্তরপ্রদেশ হলে করতে পারত!!? “ এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে ঋতুপর্ণা ম্যাডাম জানান আরে বাবা তুলনা মানুষ কার সঙ্গে করে? ভালদের সঙ্গে করে, যোগীর সঙ্গে তুলনা একটা তুলনা হল!!? তাছাড়া ওরা আন্দোলনকে এত ভয় পাচ্ছেন কেন!? ম্যাডাম তো আন্দোলন করেই উঠে এসেছেন। তখন তো তাকে এ ধরনের কথা কেউ বলেনি।
এর মধ্যে স্বপন মন্ডল, আইনজীবী দিবাকর ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে প্রণব রায়, ডক্টর বিপ্লব চন্দ্র অনেকেই বক্তৃতা করেছেন। তবে ডক্টর তমোনাশ চৌধুরী স্যরের বক্তৃতা থেকে আমরা জানতে পারি যে মেডিকেল কাউন্সিল থেকে যে অভিযোগ জানানো হয়েছে, সেদিন প্রতিবাদের রাতদখল হয়েছিল। সেই রাতে কাউন্সিলের অফিসে নাকি দুজন নেতা এসে থেকেছিলেন। তাদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে, প্রতিবাদীদের স্লোগানে। তাই তারা এই আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আচ্ছা বলুন তো মাইক ছাড়া রাত দখলের স্লোগান কতদূর যেতে পারে!!?? সত্যি এদের থ্রেট কালচার এক হাস্যকর অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এরপর বক্তৃতা দিতে এলেন অনুরাগ মৈত্রেয়ী। তিনি বললেন, বক্তারা বক্তব্য রেখে সব দিক তুলে ধরেছেন তাই তিনি বলতে চান,
ওরা বোধহয় মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়,
কথায় কথায় শিকল পরায়,
মোদের হাতে পায়
এখানে আমরা মানে কোনও বিশেষ দল নয়। এখানে প্রতিটি নাগরিককে বলা হচ্ছে। তিনি এখানে প্রসঙ্গন্তরে ট্রাম্পের কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন চটি চাটারা যেন সংখ্যা দিয়ে আন্দোলনের জনরোষ বিচার না করে।
প্রতিটি বক্তৃতার শেষে স্লোগান দিচ্ছিল নব্য প্রজন্ম। তাই শেষ লগ্নেও নানা স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ জমায়েত শেষ হল। পোস্টার নিয়ে কয়েকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। যাতে বাস যাত্রীদের চোখে পড়ে। এখনও যেন আমার কানে ভেসে আসছে “এই লড়াই লড়বে কে, তুমি আমি আবার কে?… “
এতো সুন্দর করে বর্ণনা দিলেন দিদিভাই…..আমি গতকাল উপস্থিত না থাকলেও আপনার এই লেখা পড়ে আমাদের প্রতিবাদের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেয়ে যেতাম।