সমাজে এমন কিছু নেই যা রাজনীতির বাইরে। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা এমনটাই জানিয়েছেন, তাঁদের নানা গবেষণাপত্রগুলোর মাধ্যমে। এখন অভয়া ধর্ষণ ও হত্যা ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বারেবারে সমাজের এমন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে অস্বীকার করতে চাইছে। তারই নজির প্রথম থেকে দেখা যায়। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়প্রাপ্ত ও দুর্নীতির প্রসাদপ্রাপ্ত নেতা এবং মন্ত্রীরা বারে বারে একজন অভিযুক্তের ফাঁসি চেয়ে আসছিলেন। কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইও তাই চেয়েছে।
অথচ তদন্ত প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। এর কারণ রাজ্য সরকারের তথ্য-প্রমাণ লোপাট না সিবিআই-এর অপদার্থতা না কি গোটা রাষ্ট্রশক্তির ব্যর্থতা, সেই আকচাআকচি ছেড়ে যদি আমরা নজর দিই — কেন রাষ্ট্র ফাঁসি দেয়? এই ফাঁসির মূলে কী কারোর রাজনৈতিক ক্ষতি ও লাভের অঙ্ক থাকে? ফাঁসি দ্বারা সমাজে ধর্ষণ বা অপরাধ আদেও কমে?
এই সমস্ত বিষয়ে উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় — প্রথমত, অতি ধনীকশ্রেনির রাষ্ট্র ফাঁসি দেয়, অন্যদিকে তার দ্বারা পরিচালিত সমাজে দুর্নীতি, বেনিয়ম, অসততা চূড়ায় উঠেছে। সেই চূড়ার উপরটাকে বাঁচাতে বা আড়াল করতে তলার কাউকে বলি হতে হয়। যাঁর উদাহরণ পাহাড় সমান, ইতিহাস থেকে বর্তমান। আবার এই রাজনৈতিক পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্র শান দেয় ফ্যাসিবাদী রাজনীতিতে, যে প্রক্রিয়ায় অতি ধনিকশ্রেণি রাষ্ট্র ধাপে ধাপে উত্তীর্ণ হয়। সাধারণ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে নানা ভয়ের মধ্য দিয়ে আদপে কেড়ে নিতে চায়।
দ্বিতীয়ত, অবশ্যই এই ধরনের ফাঁসির মূলে কারোর রাজনৈতিক ক্ষতি ও লাভের অংক থাকে। এটা থাকে বলেই রাজনৈতিক সরকারগুলো প্রথম থেকে ফাঁসি চায়। এই রাজনৈতিক সরকারের দলগুলো আবার যখন বিরোধি আসনে থাকেন, তখন তারাই অনেকে ফাঁসির বিরোধিতা করেন। যেমন করেছিলেন, খোদ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই, বামেদের আমলে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির সময়। আসলে ফাঁসি দেওয়া কিংবা এনকাউন্টার করবার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকার দেশের শ্রমজীবী জনগণের বিপুল রাগকে খানিক প্রশমিত করে এবং নিজেদের অক্ষমতাগুলোকে কাঁধ দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চায়। অথবা তা বিরোধীদের কাঁধে চাপায়। অভয়া ঘটনায় ঠিক এই রকমই করেছে, রাজ্য সরকার প্রথম থেকে। ১৪ই আগষ্ট রাতে আরজি কর হাসপাতালে ভাংচুরের দায় ও তথ্য-প্রমাণ লোপাট বিরোধিদের কাঁধে চাপানোর মাধ্যমে মাননীয়া আদপে অভয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাও বিরোধিদের কাঁধে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। সর্বোপরি, এসব রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতের মধ্যে ভবিষ্যতের তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্তব্ধতা বা সেটাকে ভুল পথে পরিচালনা করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। ফলে লাভবান হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারীরা। আর ক্ষতি হয় পরিবার, জনগণ ও সমাজের।
তৃতীয়ত, ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার। এমন উদাহরণ ইতিহাস থেকে বিদ্যমান। তাই সরকারি তথ্য মতে, ধর্ষণ আজও প্রতিদিন নব্বইটি-র বেশি ঘটছে যা কমবার বদলে সময় অনুসারে বাড়ছে বলা বাহুল্য। এই সমস্ত মূলেই রয়েছে দেশের সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগণের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অধিকারহীনতা। এগুলো সুনিশ্চিত না হলে অভয়া প্রকৃত বিচার যেমন হবে না। তেমন ধর্ষণ শ্রমজীবী মেয়েদের বিরুদ্ধে পিতৃতান্ত্রিক-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার তথা যুদ্ধ ঘোষণার স্বরূপ হয়েই বারেবারে ঘটবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা জানান, ধর্ষণ একটি যেমন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার। তেমন ফাঁসিও শাসকশ্রেণি রাজনীতির অংশ। এই দুইয়ের পারস্পরিকতার মধ্য দিয়ে সরকার তথা রাষ্টশক্তি দেশের জনগণের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে। গণতান্ত্রিক সমাজের বদলে ভয়ের সমাজ গঠন করতে চায়।