আর জি কর ধর্ষণ-খুন কান্ডের পর এক মাসের ওপর হলো, আমরা “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”, “জাস্টিস ফর আর জি কর”, “জাস্টিস ফর অভয়া”, “উই ডিম্যান্ড জাস্টিস” ইত্যাদি স্লোগান শুনছি, দিচ্ছি – লাগাতার। তা’ জাস্টিস বলতে ঠিক কি বুঝি আমরা? কার কাছে চাইছি জাস্টিস? কে দিতে পারে জাস্টিস, বা দেবে জাস্টিস, বলে মনে করছি আমরা?
জাস্টিস তো ইংরেজি শব্দ। এর সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ কী? ন্যায়? বিচার? না কি, ন্যায় বিচার? ন্যায় আর বিচার কথা দুটি কি সমার্থক? নাকি এদের মধ্যে কোন আপাতবিরোধ আছে? সব বিচার কি ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত? …… আবার জাস্টিস বলতে তো আমরা আদালতের বিচারককে ও বোঝাই – যিনি কিনা জাস্টিস বা বিচার দেন। আদালতের মামলার নিষ্পত্তিতে। তা’ আদালতের সে বিচার যতটা তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক, ততটা কি ন্যায়ের ওপর সর্বদা? আবার শুধু তথ্য-প্রমাণ থাকলেই হবে না। যথাসময়ে, যথাযথভাবে সেই তথ্য-প্রমাণ জাস্টিস অর্থাৎ বিচারকের সামনে যুক্তিসহ পেশ করতে হবে। বিচারক নির্মোহ ও নিরপেক্ষ ভাবে বাদী ও বিবাদী পক্ষকে শুনবেন, যাকে বলে শুনানি বা হিয়ারিং। তারপর তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে তাঁর সুচিন্তিত রায় বা বিচার দেবেন। কিংবা তথ্য-প্রমাণ এর অভাবে বিচার অধরা থাকবে। কিন্তু অপরাধ সংঘটিত হবার পর তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও আদালতের কাছে পেশ করা – এসব দায়িত্ব কার? এই সব প্রশ্নের আলোচনায় একটু পরে আবার আসছি।
আপাতত ভাবা যাক, জাস্টিস কার কাছে চাইছে জুনিয়র ডাক্তাররা? বা সাধারণ মানুষ? জাস্টিস দেবার এক্তিয়ার, দায়, দায়িত্ব বা ক্ষমতা কি কেবল আদালতেরই? সরকারের নেই?
যে কোন সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, ন্যায়ের শাসন সুনিশ্চিত করা। কোনও সামাজিক অন্যায় বা অবিচার ঘটলে দ্রুততার সঙ্গে তার কারণ অনুসন্ধান করে নাগরিকের সুবিচার পাওয়ার অধিকার সুরক্ষিত করা।
কখন আমরা জাস্টিস এর প্রশ্নে সরকারের দিকে আঙুল তুলবো? আর তখন কোন জাস্টিসের কথা বলছি আমরা? তখন আমরা মূলতঃ সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছি। তখন আমরা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সরকারের দায়বদ্ধতার বিচ্যুতির বিরুদ্ধে কথা বলছি। নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কথা বলছি। সামাজিক বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার দূরীকরণে সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কথা বলছি। আর রক্ষক যখন ভক্ষক হয়? নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সরকারের ভূমিকা যখন সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়ায়? ন্যায় প্রতিষ্ঠা যার করার কথা সেই সরকার নিজেই যখন সরাসরি ভাবে অন্যায় কাজকর্মে লিপ্ত হয়? নাগরিক তখন যায় কোথায়? দুর্ভাগ্যজনক হলেও নাগরিক সেই সরকারের কাছেই দাবী জানাবে – “উই ডিম্যান্ড জাস্টিস”। অর্থাৎ নাগরিক চাইছে, সরকার সার্বিক অন্যায়ের সঙ্গে লিপ্ত থাকার প্রবণতা ত্যাগ করে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মন দিক, নাগরিক-অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হোক। মানুষের বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করুক।
সরকারি সংস্থায় সংঘটিত যে কোনও অপরাধের পর বিচার সুনিশ্চিত করার প্রাথমিক দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের – সরকারী আধিকারিক, পুলিশ, আমলার মাধ্যমে। যাদের প্রাথমিক কাজ অপরাধের তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ইত্যাদি। যদি দেখা যায় বা সন্দেহ হয়, পরিবর্তে তারা তথ্য প্রমাণ লোপাট করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তা হলে সরকার তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। সরকারও তখন পরোক্ষ ভাবে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। নাগরিকের কাছে তখন সে বড় দুঃসময়। তাও তার জাস্টিসের দাবিতে স্লোগানে উচ্চকিত হওয়া ছাড়া আর কিই বা করার থাকে? সেই সরকারের কাছেই দাবি জানানো।
তৃতীয়তঃ, আদালত বা সরকার ছাড়াও সমাজে জাস্টিস সুনিশ্চিত করার দায় ও দায়িত্ব সমাজের নিজেরও কম নয়। অর্থাৎ আমরা যারা জাস্টিস এর স্লোগান তুলছি, তাদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশীদারিত্বে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্যায়, অপরাধ, অবিচার নির্মূল হতে পারে। নৈতিকতা ও ন্যায়ের চর্চা ও ব্যবহারিক প্রয়োগ বা তার বিচ্যুতি শুরু হয় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্তরে। তা জারিত হয় স্কুলে, কলেজে, পাড়ায়, ক্লাবে, অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে, বিনোদন ক্ষেত্রে – সর্বত্র। সুতরাং “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” সেই অর্থে হয়ে দাঁড়ায় “উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর আওয়ারসেলভস, ফ্রম আওয়ারসেলভস”। এক অর্থে প্রতিটি অপরাধ, সামাজিক বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার এর দায়ভাগ প্রাথমিক ভাবে আমাদের নিজেদের। প্রতিনিয়ত আমরা সচেতন ভাবে বা অসচেতন ভাবে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, ভয়ে বা ভক্তিতে, আমরা আমাদের আশেপাশে ঘটে চলা এইসব অন্যায় ছোট-মাঝারি-বড়ো অন্যায়গুলোকে বাড়তে দিয়েছি – দেখেও দেখিনা, শুনেও শুনিনা, প্রতিবাদ করিনা। তাই সময় এসেছে আত্ম-বিশ্লেষণেরও। নিজেদের অবস্থান ও ভূমিকার বদলেরও।
অভয়ার ঘটনা আমাদের নাগরিক জীবনে সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে কতটা অনুঘটকের কাজ করতে পারবে, তার উত্তর ভবিষ্যত দেবে।