৮৬. রাজপথের লড়াই যেমন জনজাগরণের, তেমনি ন্যায়বিচারের লড়াইয়ের আসল যুদ্ধক্ষেত্র আদালত। আর সেখানে যে কারণেই হোক আমাদের তরফ থেকে গীতা লুথরা ম্যাডাম বিশেষ সুবিধা করতে পারছিলেন না। যেভাবেই হোক সুপ্রিম কোর্টেও যুক্তিতর্কের থেকে মানুষের ‘অরা’ বেশি ওজনদার হয়ে ওঠে- আর চোরের মেসিহা কপিল সিব্বলের কাছে সবাইকেই ম্লান লাগছিল। যুক্তি-তক্কো ইত্যাদি চলছে, সরকারের তদন্তে গাফিলতি প্রত্যেক মুহূর্তে সামনে আসছে। সিব্বল সেই নিয়ে কোনো মন্তব্য করছেন না, দেখছি দেখবো ইত্যাদি। তাঁর এতদিনের যুদ্ধের মূল উপজীব্য বিষয়বস্তু ছিল এই ডাক্তারদের কর্মবিরতি। আদালতও সেই পথেই চলেছে এবং বারবার ডাক্তারদের কাজে যোগ দিতে বলেছে।
আপাতভাবে এই দাবি রোগিস্বার্থে হলেও, আসলে এটা জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য। ডাক্তারি আন্দোলনের একটাই হাতিয়ার- কর্মবিরতি, তারা খড়্গ হস্তে রাস্তায় নামতে শেখেনি। তারা যেটুকু পারে, সেটা হলো কর্মবিরতি করে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে। সেটা উঠিয়ে দিতে পারলেই আন্দোলন দমিয়ে দেওয়া যায়- তারপর তাদের কাজে ব্যস্ত রাখতে ৩৬-৪৮-৭২ ঘন্টার ডিউটি তো আছেই। যে সরকারের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরতে পরতে দুর্নীতি, যারা মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে ওষুধপত্র সর্বত্র কালোবাজারি করেছে- তারা জনকল্যাণের বাণী শোনালে আশ্চর্য হই বই কি!!
৮৭. কিন্তু শীর্ষ আদালতে ইন্দিরা জয়সিংয়ের আগমন সিব্বলের আত্মবিশ্বাসের গোড়ায় আঘাত হেনেছে, সেটা পরিষ্কার হয় যখন হঠাৎ কেসের চতুর্থ দিন মমতার লাইনে হেঁটেই উনি লাইভ টেলিকাস্ট বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু এটা কালীঘাট নয়, এটা সুপ্রিম কোর্ট- এসব ‘বাল’খিল্য এখানে চলবেনা। লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছে এবং মূলত দু’জন- ইন্দিরা ম্যাডাম এবং সিনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি করুণা নন্দী সিব্বলকে শরশয্যায় শায়িত করে দেন। একের পর এক অকাট্য যুক্তিতে জর্জরিত সিব্বল আমতা আমতা করেই কাটিয়ে দিলেন। অবশেষে অসহায় সিব্বলের প্রশ্ন, কবে ডাক্তারেরা ডিউটিতে যোগ দেবেন? বিচারপতি বলেন, ডাক্তারেরা নিরাপদ বোধ না করায় ডিউটি করছে না, সরকার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক। ইন্দিরা ম্যাডাম দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, ডাক্তারেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং এর কোনো সময়সীমা তিনি বলতে পারবেন না।
৮৮. কী কী উঠে এলো আদালতে? সরকারি হাসপাতালে সুরক্ষায় যে সরকার শুধু প্রতিশ্রুতির বন্যা ছাড়া এক কানাকড়িও বিনিয়োগ করেনি, সেকথা উঠে এলো। আন্দোলনের জন্য রোগিমৃত্যুর যে ভয়ংকর মিথ্যা প্রচার সরকার চালিয়েছে- সেই মিথ্যার কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে। সরকারি হাসপাতাল ও কলেজগুলোতে যে ব্যাপক দুর্নীতি এবং ছাত্রছাত্রীদের উপর হুমকি সংস্কৃতির রমরমা চলছে, সেটাও পরিষ্কার হয়। সরকারি হাসপাতালে নিরাপত্তায় পুলিশের অভাব এবং অপ্রশিক্ষিত সিভিক ভলান্টিয়ার দিয়ে সেই কাজ চালানোর চেষ্টা চলছে- এই সত্যিটাও উঠে আসে। একজন সিভিক ভলান্টিয়ার এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই অপচেষ্টা যে কতটা দুশ্চিন্তার কারণ, সেটা প্রধান বিচারপতিও তুলে ধরেন। অভয়ার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত মানুষেরা এখনো হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছে- এটা স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার পরিপন্থী। সরকারের গালে আরো বড় থাপ্পড় পড়ে ‘রাতের সাথী’ প্রকল্প নিয়ে। যেভাবে মধ্যযুগীয় পন্থায় মহিলা ডাক্তারদের ডিউটির সময় ও নাইট ডিউটিতে কোপ পড়েছে তা সুপ্রিম কোর্ট হতবাক হয়ে শুনেছে, স্বগতোক্তির মতো চিফ জাস্টিস জিজ্ঞাসা করেছেন, “এরকম লেখা আছে নির্দেশনামায়!!” সিব্বল নিজমুখে স্বীকার করেছেন, “আসলে হাসপাতালে নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ থেকেই এই সিদ্ধান্ত”; বিচারপতি বলেছেন, “তাহলে আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন”।
সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হাসপাতালে নিরাপত্তা যে এখনো একটা কষ্টকল্পনা- সেটা আরো একবার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮৯. সুপ্রিম কোর্টে গালে গালে জুতো খেয়ে মুখ্য সচিব আলোচনায় বসতে চেয়েছেন চতুর্থ ও পঞ্চম দাবি নিয়ে। পাঁচ-ছয় ঘন্টার আলোচনায় ডাক্তার প্রতিনিধিরা অবাক হয়ে দেখে রাজ্যের মাথায় বসে থাকা আমলারা তাদের সুরক্ষা ও হাসপাতালের পরিকাঠামো সম্পর্কে কতটা উদাসীন ও অজ্ঞ। তারা একগুচ্ছ দাবি সামনে রাখে- চতুর্থ দাবিতে তারা কলেজ লেভেল টাস্ক ফোর্স গঠন করার কথা বলে, সমস্ত প্রতিনিধিদের সামনে রেখে। তারা ইন্টারনাল কমপ্লেইন কমিটি গঠন করার দাবি জানায়। পর্যাপ্ত পুলিশ নিয়োগ, পর্যাপ্ত ডিউটি রুম, ক্যান্টিন ও পানীয় জলের ব্যবস্থা, প্যানিক বাটন- এরকম অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবায়নযোগ্য পয়েন্ট তুলে ধরা হয়। রোগী পরিষেবায় রেফারের জন্য সেন্ট্রাল বেড ভ্যাকেন্সির তথ্য জানানোর দাবি রাখা হয়, যা দালালরাজ শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে পঞ্চম দাবিতে হুমকি সংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়। পাঁচ ঘণ্টা ধরে সব ক’টা কথা শুনে এবং প্রত্যেকটাই সঠিক দাবি মেনে মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়- কিন্তু আলোচনার মিনিটস চাইলে অদ্ভুতভাবে তা দেওয়া হয়না। বরং আলোচনা খুব ফলপ্রসূ হয়েছে এবং ডাক্তারদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে- এই মর্মে একটা পত্র স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। স্বভাবতই এই অবস্থায় আলোচনা ছেড়ে বেরিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
৯০. নির্বাচন- পাঁচ দফা দাবির সবচেয়ে কঠিন দাবি সরকারের কাছে। বাকি সব আপোস করে নিলেও সরকার এই দাবি কোনোদিন মানতে পারবে না। সব কলেজ থেকে নির্বাচন বন্ধ করে সরকারের নিজস্ব নির্বাচিত পেটোয়া লোকেদের দিয়ে সব নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে কলেজে গাছ হয়ে থাকা মানুষগুলো, অবশেষে যারা সরকারি দাক্ষিণ্যে পরীক্ষায় পাশ করেছে- তাদের দিয়ে সব কাজ হাসিল করে নিচ্ছে সরকার। কখনো এরা কলেজের স্থায়ী হাউসস্টাফ, কখনো কোভিড কোটার পিজিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। অত্যাচারিত নিপীড়িত স্টুডেন্টরা আজ নিজেদের দাবি তুলে ধরতে পারলে সরকারের এই দুর্নীতির আখড়া ভেঙে পড়বে। আজ আরজিকর থেকে যত সহজে মৃতদেহ বের করে আনলো সরকার সন্দীপবাহিনীর সাহায্যে- একটা ইউনিয়ন থাকলে সেটা হতো না, সেই ইউনিয়নের মাথা তৃণমূলী হলেও হতো না। বিরোধীশক্তির অভাবে যে সরকারি লুম্পেনরাজ দুর্নীতি গুণ্ডাগিরি চলছে- তার একটাই গণতন্ত্র প্রতিকার সম্ভব- নির্বাচন। কিন্তু আজ মেডিক্যাল কলেজে নির্বাচন হলে কাল জেনারেল কলেজও দাবি জানাবে, সব কলেজে দুর্নীতিতে রাশ টানলে সরকার চলবে কেমন করে!! এতদিনের ব্যবসা, এত পেটোয়া চটিভোজী লোকজনের অন্নসংস্থান- এর ভবিষ্যতের কী হবে!!!