নীটের রেজাল্ট বেরিয়েছে। নীট ইউজি। একঝাঁক নতুন ছেলেমেয়ে আসবে কলেজে কলেজে ডাক্তারি পড়তে। চোখে তাদের স্বপ্ন, আশা, তারা ‘সেবা’ করতে চায়, মানুষকে ভালো রাখতে চায়। তাদের কেউ কেউ ভাবে, ভারতবর্ষের মানুষরা স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় আছে, তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাজ করবো। হয়তো অনেকেই ভাবে।
এই ছেলেমেয়েগুলো যখন তাদের ইচ্ছের কথা, আশার কথা, স্বপ্নের কথা বলে আমাদের কাছে, সমাজের কাছে, তখন আমরা হেসে উঠি। আমরা, যারা একসময় ওদের মতোই ছিলাম, আর এখন সেবা শব্দের ওপর কোটেশন দিয়ে থাকি, তারা হেসে উঠি মুচকি মুচকি। কেউ কেউ আরো জোরে হেসে ওঠে, বিদ্রূপ করে। সেবা করবে, সেবা! জানে না বোকা, অবোধ ছেলেমেয়েগুলো, সেবা করতে আসছে মেডিক্যাল কলেজে! আমাদের মুখ দিয়ে কোনো উৎসাহ বেরোয় না, আশার কথা বেরোয় না, প্রশস্তিবাক্য বেরোয় না, প্রশ্রয় বেরোয় না — আমরা শুধু নিজেদের মধ্যে খ্যাখ্যা করে হেসে উঠি! কোথায় সেবা, কোথায় মানুষের ভালো, কোথায় জীবনযাত্রার উন্নতি! আমাদের হতাশা-নিরাশায় ঘষে যাওয়া কাঁচ দিয়ে আমরা সেই সময়টাকে আর দেখতেই পাই না, যে সময় আমরাও স্বপ্ন দেখতে জানতাম, ভাবতাম পাল্টে দেবো এই দেশের স্বাস্থ্যের অবস্থা, যারা রোগে ভুগে অসুখে হাসপাতাল-ডাক্তার-ওষুধ পায় না, তাদের কাছে পৌঁছে দেবো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যের ছোঁয়া — এই নতুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেই অপূর্ণ স্বপ্নগুলোর ছায়া দেখে আমরা ভাবি, এ কী দুঃসাহস!
কিন্তু? কিন্তু স্বপ্ন দেখা তো খারাপ নয়। কোন বেওকুফ ডাক্তার বলে মানুষের জন্য স্বাস্থ্য, সমাজের জন্য স্বাস্থ্যের স্বপ্ন দেখে কিছু হয় না! সে কি শোনেনি নর্মান বেথুনের নাম? সে কি জানে চে গেভারা ছিলেন একজন ডাক্তার? সে জানে ড. কোটনিসের নাম? শুনেছে দিলীপ মহলানবিশ আর ওআরএস আবিষ্কারের কথা? তার মনে পড়ে জোনাস সকের পোলিও ভ্যাক্সিনের কথা?
কীভাবে এই পেশায়, এই লাইনে সমাজ রাজনীতি দুর্নীতি লালফিতে দাদাগিরির উপরে উঠেও মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে দেওয়া যায়, সে মনে রাখতে পারেনি? সেই ডাক্তার জানে, পুণ্যব্রত গুণ আর শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের কথা? জানে শহীদ হাসপাতালের কথা? ‘রোগ সারাতে গেলে আগে দারিদ্র দূর করতে হবে। দারিদ্রই মূল কারণ।’ শুধু ট্রিটমেন্ট করে লাভ নেই। ‘রুটে’ যেতে না পারলে হবে না। নর্মান বেথুনের এই কথা তার মনে আছে?
হ্যাঁ, নতুন ছেলেমেয়েগুলো অবাক হয়ে দেখবে, সব সত্যি। ট্রিটমেন্ট সত্যি। ওষুধ সত্যি। হয়রানি সত্যি। রাতের পর রাত মেডিক্যালের ফুটপাথে প্লাস্টিকের ঘরবাঁধা সত্যি। সিকিউরিটির মুখঝামটা সত্যি। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে তাড়া খেয়ে বেড়ানো সত্যি। ভেলোর সত্যি। ‘স্রেফ’ এমবিবিএস’ সত্যি। নীট পিজির ইঁদুরদৌড় সত্যি। এমআর এর গিফট সত্যি। কেতাদুরস্ত কর্পোরেটের টাকা সত্যি। জমি বেচে চিকিৎসা সত্যি। স্বাস্থ্যভবনের নোংরা পাঁক সত্যি। সব সত্যি। সত্যি।
আর আমরা তাহলে কী দেবো ওদের? কোন সত্যিগুলো আমরা শেখাবো? আমরা শেখাবো, মরে যাওয়া যেমন সত্যি, তেমনই পেশেন্টের পাশে বাঘের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সত্যি। তাতে মৃত্যুও ভয় পায়। শেখাবো পরিকাঠামো আর লোকবলের অভাব যেমন সত্যি, লোকজন নিয়ে সুপারের অফিসে ঝামেলাও সেরকম সত্যি। স্বাস্থ্যভবনও যেমন সত্যি, স্বাস্থ্য আন্দোলনও তেমন সত্যি। শেখাবো ব্যক্তি ডাক্তারের উদাসীনতা যেমন সত্যি, তেমনই রোগের সঙ্গে দাঁত চেপে লড়াইটাও সত্যি। সেটায় ঘাম ঝরানো কতোটা আনন্দের, রোগ এবং রোগীরা কতোটা ফিরিয়ে দেয় ডাক্তারকে, কতোটা পথ হাঁটা বাকি আমাদের এখনো। আমরা বলবো উইলিয়াম অসলারের কথা, আমরা অবাক হয়ে যাবো মৃতপ্রায় রোগীর জীবনে ফিরে আসা দেখে, অবাক হতে শেখাবো তাদের। আমরা তাদের জানিয়ে দেব, প্রোটোকল-অসহায়তা-গতানুগতিকতার বাইরে গিয়েও ‘ম্যাজিক’ হয়, কখনো মেডিক্যাল সায়েন্সের হাত ধরে, কখনো বা ডাক্তারের হাত ধরে। আমরা তাদের হাত ধরে ফিরে যাবো মানুষের কাছে, বলবো রোগীর থেকে বড় শিক্ষক আমাদের আর কেউ নেই।
হাসি পেতেই পারে। বিদ্রূপও। জিভ চুকচুক করবেন কেউ, এই লেখা পড়ে। এবং নতুন ডাক্তারি পড়তে আসা বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে। তারপরেও, কেউ না কেউ বলে উঠবে ঠিক: