লেখার শুরুতে আগে নিজের একটু ভণিতা করে নিই। তাহলে লেখাটা বুঝতে সুবিধে হবে।
১.
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। গ্রামের স্কুলে পড়তাম। আর্থিক কারণেই সব বইপত্র একার পক্ষে কেনা সম্ভব ছিল না। আমি আর আমার খুব কাছের এক বন্ধু ভাগাভাগি করে বই কিনতাম। দুজনে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা করতাম। তাতে আমাদের দুজনেরই লাভ হ’ত বলাই বাহুল্য। সে গল্পটা পরে কোনোদিন বলবো। আজ স্কুলের কথা বলি..
এখনকার ভাষায় ‘পাতি’ বাংলা মিডিয়াম। আমরা বড় পরীক্ষা বলতে মাধ্যমিক আর উচ্চ-মাধ্যমিক বুঝতাম। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল বরাবরই কিন্তু তার জন্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স নামক যে বৈতরণীটি পার হতে হয় সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল না। এসব স্কুল থেকে কালেভদ্রে এক-আধজন ওসব পরীক্ষা দিয়ে সফল হয়। বামন হয়ে চাঁদ ধরার মতো আর কী.. শহরের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত ছাত্রদের পক্ষে এসব কল্পনা করাও বোধহয় বেশ কঠিন।
মাধ্যমিক পাশ করলাম। রাজ্যে ২৬ তম স্থান। এবার আরও বড় লড়াই। মাধ্যমিকে মেকানিক্স ঐচ্ছিক বিষয় থাকার সুবাদে ফিজিক্সের অঙ্কগুলো মোটামুটি পারতাম। এমনিতেই বরাবরের ভালো লাগার বিষয় বাংলা আর ফিজিক্স।
তখন ক্লাস ইলেভেনের মাস চারেক পেরিয়েছে। সব বিষয়েই সাকুল্যে একটি করে টেক্সট বুক। একদিন ক্লাসের শেষে স্কুলের এবং এলাকার নামকরা ফিজিক্সের শিক্ষককে বললাম..
– স্যার, একটা অঙ্ক বুঝতে পারছি না। একটু বলে দেবেন?
– অঙ্ক? সে তো করে দেওয়া আছে..
– না মানে স্যার.. অনুশীলনীর একটা অঙ্ক..
– অনুশীলনীর অঙ্ক? কই দেখি?
– এইটা স্যার
– এটা তো জয়েন্টের অঙ্ক.. ওহো!! তোরা তো আবার জয়েন্ট-টয়েন্ট দিবি.. (তারপর বিশেষ রকম মুখভঙ্গি সহ) হেলে ধরতে পারে না, কেলে ধরার সখ!!
মুখ নিচু করে চলে এসেছিলাম। আর কোনোদিন ওই স্যারের কাছে পড়া বুঝতে চাইনি। এরকম আচরণ একজন ছাত্রের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। উচ্চ-মাধ্যমিকে (খুব সম্ভবত) রাজ্যে দ্বাদশ স্থান পেয়েছিলাম। ওই বছরই জয়েন্টে রাজ্যের এক নম্বর মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও যা র্যাঙ্ক ছিল রাজ্যের যে কোনও প্রথম সারির কলেজ পেতাম। জয়েন্টের রেজাল্টের পর স্যার কী বলেছিলেন শোনা হয়নি। এছাড়াও কিছু পেছন দরজা দিয়ে আসা শিক্ষক পেয়েছিলাম যাঁদের দেখে মনে হ’ত আমরাই এর চেয়ে ভালো পড়াতে পারি।
কিন্তু..
তার উল্টোদিকে অসংখ্য শিক্ষক পেয়েছিলাম যাঁরা হাতে ধরে পুরো ঠিকানা লিখতে শিখিয়েছেন, ত্রিভুজ-কিউমুলোনিম্বাস-সমাস-ভয়েস চেঞ্জ শিখিয়েছেন, নিখুঁতভাবে ভুলগুলো শুধরে দিয়েছেন বারবার, জয়েন্টের আগে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছেন, “ভয় পাবিনা সৌম্য। কাউকে দেখে হীনমন্যতায় ভুগবি না। তুই ভালো পড়েছিস। শুধু সিলি মিসটেকগুলো করিস না। দেখবি তুই পারবি। নিশ্চিত পারবি। আজ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোবি। শান্ত হয়ে পরীক্ষা দিস।”
তাঁদের কথা ভাবলে এমনিতেই পা ছুঁতে ইচ্ছে করে। এক-দুজন খারাপ মানুষের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজকে নিয়ে অপমানজনক কথা বলার মতো আহাম্মক আমি নই। শিক্ষকদের ছাড়া আমাদের কারোরই জীবনের পথচলা সম্ভব হ’ত না।
২.
কলেজে ফোর্থ ইয়ার। নায্য দাবীতে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর রাতের অন্ধকারে, আলো নিভিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুলিশ। লাঠি চালিয়ে, চুলের মুঠি ধরে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। শাসকের নির্লজ্জ পদলেহন..
প্রকাশ্য রাস্তায় ঘুষ নিতে দেখেছি পুলিশকে।
কিন্তু..
তার উল্টোদিকে পুলিশের শত শত মানবিক মুখ দেখেছি। শৃঙ্খলারক্ষায় তাঁদের অক্লান্ত শ্রম, দুপুরের কড়া রোদে ট্রাফিক সামলানো, কপর্দকহীন পরিবারে দু-মুঠো খাবার তুলে দেওয়া.. দু-একটা খারাপ ঘটনার জন্য এত ভালোর আয়োজন ভুলি কী করে?
৩.
বেশ সুবেশী দক্ষিণ-ফেরত ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা বছর ছয়েকের বাচ্চাকে নিয়ে চেম্বারে..
– মানে ডক্টর, ওকে তো আমরা *-এ দেখাই। এই দেখুন, পুরো ডকুমেন্টস সব আছে..
– বাচ্চার সমস্যা কী?
– হ্যাঁ। সেটাই তো বলছি। ওর তো এই ওষুধটা চলতো.. লাস্ট IgE রিপোর্টটা দেখুন..
– আমি আপনার রিপোর্ট, ওষুধ সব পরে দেখবো। আগে বাচ্চার অসুবিধে কী হয় সেটা বলুন।
– IgE রিপোর্ট..
– বাচ্চার কষ্টটা কী?
প্রায় মিনিট দশেক কথা বলার পর বুঝতে পেরেছিলাম বাচ্চা চাইল্ডহুড অ্যাজমায় ভোগে। ইনহেলার নেয়। দক্ষিণ-ফেরত কাগজপত্র নিয়ে একে বঙ্গদেশ, তায় ছোট-ডাক্তারকে নতুন করে রোগের ইতিহাস বলার প্রয়োজন হতে পারে সেটা তাঁদের ধারণার বাইরে ছিল। সমস্ত কাগজপত্র দেখে প্রেসক্রিপশন করার পর ভদ্রলোক শান্তভাবে হেসে বলেছিলেন..
– থ্যাঙ্কিউ ডক্টর। গাড়িতে ব্যাগটা ফেলে এসেছি। আপনার ভিজিটটা এসে দিয়ে যাচ্ছি।
সেই যে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোকের আর দেখা পাইনি। ছোট ডাক্তার প্রায় মিনিট কুড়ি নিজের শ্রম আর সময়ের দাম পেল না।
আবার হতদরিদ্র বাবা বাড়ির প্রথম ফসল-সব্জী পনেরো কিলোমিটার বয়ে ডাক্তারের জন্য পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
কোনটা মনে রাখি?
৪.
বিচ্ছিরি গরম পড়েছে। আউটডোরে বসার আগে ভর্তি থাকা খারাপ রোগীদের একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি। দরজার কাছে এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন। আমি জিজ্ঞাসাসূচক চোখ নিয়ে তাকাতে খুব নিচু স্বরে বললেন..
– ডাক্তারবাবু..
– হুঁ..
– আমাদের পরবে একটু সেদ্ধ রান্না হয়। আপনি খাবেন?
– হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। সে আর বলতে?
– না.. মানে..
– মানে কী?
– শুধু সেদ্ধ। মশলাপাতি নেই। আপনি খেতে পারবেন?
– খুব পারবো। দিন, দিন।
তেল-মশলা ছাড়া আদিবাসী-পরবের সেই ডাল-ছোলা-মটর-আলু-কুমড়ো-কচুসেদ্ধ আমার কাছে অমৃত। যে কোনও দিন আর্সালানের বিরিয়ানি আর বার্বিকিউ নেশনের মাংস-পোড়া ছেড়ে আমি ওই সেদ্ধ খেতে রাজি। ওর সাথে অন্য আর একরকম মশলা ছিল। যাকে শ্রদ্ধা বলে, বিশ্বাস বলে, ভালোবাসা বলে। তার পাশে কোথায় লাগে দামী রেস্তোরাঁর শেফ?
…
সেদিনই রাত আন্দাজ বারোটা।
ইমার্জেন্সি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জেনারেল ফিজিশিয়ান ডাক্তারবাবু শিশু-বিভাগে একটি এগারো মাসের বাচ্চাকে ভর্তি করেছেন। ভর্তি হওয়ার সাত-আট মিনিটের মাথায় আমি বাচ্চাকে দেখছি। হঠাৎ, বাইরে শোরগোল। খান চারেক লোক হুড়মুড়িয়ে ওয়ার্ডে ঢুকে এল। তাদের মধ্যে নেতাগোছের একটি লোক মদ্যপ অবস্থায় আমার দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে শুরু করলো..
– বাচ্চাকে ভোত্তি কোয়েছি, কেউ দেকছে না ক্যানো? ডাক্তার কই?
– আপনি কে?
– আমি লোকাল * পার্টির পঞ্চায়েত ছদস্য।
– বাচ্চার কে হন?
– বাচ্চার.. মানে, পাড়ার কাকা। বাচ্চাকে ডাক্তার দেকছে না ক্যানো? হসপিতালে ডাক্তার নেই?
– আমি ডাক্তার। বাচ্চার বাবা-মা আছেন?
– বাবা-মা ভালো বলতে পায়বে না.. আমি..
– আপনি ওই পেছনটায় গিয়ে দাঁড়ান। আপনি পঞ্চায়েত সদস্য হোন আর যেই হোন, সরে দাঁড়ান। আগে বাচ্চার মা-বাবার সাথে কথা বলবো। তারপর পাড়ার কাকা-জেঠার কথা ভাবা যাবে। বাবা-মা কে?
মদ্যপ মাঝবয়েসী এরকমটা আশা করেনি বোধহয়। ততক্ষণে অস্পষ্টভাবে একটি নারীকন্ঠ শোনা যায়..
– আমি মা..
– হ্যাঁ, তো আপনি সামনে আসুন। বাচ্চার অসুবিধে বলুন। এতক্ষণ পাড়ার কাকার হম্বিতম্বি শুনতে গিয়ে তো বাচ্চার চিকিৎসার দেরি হচ্ছে। বলুন, বাচ্চার কী হয়েছে?
বাচ্চার চিকিৎসার দিকটা সামলে-সুমলে আবার মদ্যপ লোকটার দিকে ঘুরলাম..
– এবার বলুন, আপনি কী বলতে চান?
– বাচ্চাকে এতক্ষণ কেউ দেখেনি কেন?
– বাচ্চা হাসপাতালে আসার আধ ঘন্টার মধ্যে দু’জন ডাক্তার দেখেছেন। ভর্তি করার সময় একজন ডাক্তার দেখে ভর্তি করেছেন।
– কে ডাক্তার? কী নাম?
– সেটা আপনার জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাচ্চা এখন আমার আন্ডারে আছে। আপনার যা বক্তব্য আমাকে বলুন।
– আমি কিন্তু …. পার্টির পঞ্চায়েত ছদস্য.. বাচ্চার টিটম্যান ভালো না হলে..
– বাচ্চার চিকিৎসা যেমন হওয়ার তেমনটাই হবে। সে আপনি যেই হোন। আপনি বললেও হবে, না বললেও হবে।
– আমি কিন্তু কাল সকালে আবার আসবো..
– আচ্ছা। আসুন।
…
পরে জেনেছিলাম বাচ্চার বাবার মাংসের দোকান। পাড়ার নেতাদের মদ-মাংসের মজলিসে বিনে-পয়সায় মাংস দিতে হয়। লোকাল নেতা বাবাকে বুঝিয়ে এনেছে, সরকারি হাসপাতালে কিচ্ছু চিকিৎসা হয় না। নেতার হুমকিতে যদি কিছু হয়..
এসে যখন দেখা গেল, নেতার হুমকি ছাড়াই চিকিৎসা সুষ্ঠুভাবে হয়ে গেল.. সেটি লোকাল গুন্ডার পক্ষে হজম করা কঠিন ছিল।
বাচ্চার বাবা পরে হাতে ধরে বলেছিলেন, “কিছু মনে করবেন না ডাক্তারবাবু। ওকে আমরা কেউ ডাকিনি। ও নিজে এসে আপনাদের সাথে এরকম করবে বুঝতে পারিনি।”
৫.
নিজের পেশাতেই বেশ কিছু ‘ইয়ে’র মুখোমুখি হয়েছি কয়েকবার। ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার আগে, পড়ার সময় এবং পাশ করার পরেও। তাদের কথা ভাবলে এখনও গলার কাছে যেগুলো উঠে আসে, সেটা খুব শ্রুতিমধুর নয়।
কিন্তু..
তার চেয়ে বহুগুণ বেশি রোগী-অন্তপ্রাণ ডাক্তার দেখেছি। তাঁদের রাতজাগা দেখেছি। রোগীর জন্য জান ঢেলে কাজ করতে দেখেছি। তাঁদের দেখলে আমি খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো বেমালুম ভুলে যাই।
****
আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যে কোনও পেশায় আজও ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। ভালোর জোর, আলোর জোর বেশি বলেই সভ্যতার চাকা গড়ায়। আবার ভালো-খারাপ এত একমাত্রিকও নয়। ভীড় ঠাসা বাসে ফোনে অশ্রাব্য গালিগালাজ আর জানলায় মুখ বাড়িয়ে পুচ পুচ করে পানের পিক ফেলা ছেলেটার অশীতিপর বৃদ্ধকে সিট ছেড়ে দিতে দেখেছি। পাশে তথাকথিত ভদ্রলোকেরা তখনও নির্বিকার। সাদা-কালো এবং তার মধ্যে অগুনতি ধূসরের পোঁচে পৃথিবীর ক্যানভাস ভরে ওঠে।
তাই, কোনও বিশেষ পেশার মানুষকে ‘খারাপ/অসৎ/অসুর’ বলে দেগে দেওয়া শুধু মিথ্যে নয়। রীতিমতো অশ্লীল।
চোখের সামনে নোংরা পর্দা মেলে রাখলে বাইরের পৃথিবীর সবকিছুই নোংরা লাগে। পর্দার ওপারের পৃথিবীর কথা আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এক চৈনিক দার্শনিক বলে গেছেন..
“Everything has beauty, but not everyone sees it”
ভদ্রলোকের নাম কনফুসিয়াস।
নোংরা পর্দাটা ছিঁড়ে ফেলুন। আলো-আঁধারির খেলায় পৃথিবীটা আজও সুন্দর!!
(ছবিটা ২০১৮ সালের পয়লা জুলাই, ডক্টরস’ ডের দিন। স্থানীয় থানা থেকে ডাক্তারদের সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল। তখনও জানতাম না আর ঘন্টা কয়েক বাদে তিন ঘন্টার খিঁচুনি নিয়ে অচৈতন্য ও মৃতপ্রায় অবস্থায় আরাধ্যা হাসপাতালে আসবে। তারপর সবার চেষ্টায় বেঁচেও যাবে। পাঁচ-ছ’টা খবরের কাগজ গোটা গোটা করে ছাপবে আমাদের সম্মিলিত যুদ্ধজয়ের গল্প।)
অসাধারন লেখা, শেয়ার অপশান থাকলে দিন ।
Ami ak samanya pry teacher. Porasunote bhaloi chhilum. Kintu bhagyer porihase asustha babar dekhasoner janna anektai jiboner hariechhi. Kintu tarjanna dukkho nei. Kartabya kore gechhi. Ajj amar anek bandhui khub baro doctor. Kintu tara chintei chai na. Kono poorman dakhate nie gele lajjer matha kheye visit nie nai. Amidiedi. Kintu apner katha jene lekha pore doctor ermane palte gelo. Dakat ho lo na. Amar anek pran bhara bhalobasa neben.