দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২০
কে একটা বলেছিলেন, জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড আর আমাদের বিশ্বকবি লিখেছিলেন, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। এদিকে চন্দ্রবিন্দু গেয়ে গিয়েছেন, আমাদের ছাদে কে বসে বসে কাঁদে/ দেখেছিল ঘুঘু আহা পড়ে গেছে ফাঁদে।
ডাক্তারির পোস্ট-গ্রাজুয়েট ভর্তি পরীক্ষা (নিট-পিজি এন্ট্রান্স), তা বারকয়েক পিছিয়ে যাওয়া – পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পর সেই তালিকা অনুসারে ভর্তির জন্য কাউন্সেলিং, সেও পিছিয়ে যাওয়া – সেই নিয়ে পরীক্ষায় সফল ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ – এই সবকিছু বুঝতে গেলে আগের অনুচ্ছেদের কথা তিনটি বুঝলেই চলবে।
অতিমারি যে বিশেষ সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সে নিয়ে তো তর্কের অবকাশ নেই। বিশেষত সঙ্কট এমন গভীর, যেখানে উৎসব-পার্বণ মায় কুম্ভমেলা অবাধে চলতে পারে – গণতন্ত্রের “উৎসব” তো চালাতেই হবে, ভোট, ভোটের প্রচার, বিজয়োল্লাস সবকিছু মিলিয়েই সে অপরিহার্য ব্যাপার – কিন্তু পরীক্ষা-টরীক্ষা বাদ রাখা বাদে উপায় নেই।
এই বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও ইন্টারেস্টিং, কেননা পরীক্ষা যাঁরা দেবেন, তাঁরা সকলেই ডাক্তারি পাস করে গিয়েছেন। সঙ্কটকালে তাঁদের অতিমারি-মোকাবিলার স্বার্থে বাড়তি ডিউটি করতে হয়েছে। এমতাবস্থায় হাসপাতালে ডিউটি করার চাইতে দূরে দূরে বসানো কম্পিউটারের সামনে বসে পরীক্ষা দিতে গিয়ে তাঁদের সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি – এমনটা ভাবার জন্যে কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয়। তবে একথা অনস্বীকার্য, সরকারবাহাদুরের কাছে আর যারই অভাব থাক, ওই বস্তুটির কমতি নেই। কল্পনাশক্তির।
সে যা-ই হোক, বারদুয়েক পিছিয়ে যাওয়ার পর শেষমেশ পরীক্ষা হল। সেপ্টেম্বর মাসে। ফলও প্রকাশিত হল।
জুলাই মাস থেকেই অবশ্য সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলছিল। কেননা সরকারবাহাদুর এ বছরেই ডাক্তারির পোস্ট-গ্রাজুয়েট আসনে নতুন সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে চান। চালু ব্যবস্থা যা ছিল, তার উপর সাতাশ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ এবং দশ শতাংশ আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়াদের জন্য (ইকোনমিকালি উইকার সেকশন, সংক্ষেপে ইডব্লিউএস)।
শতাংশ ব্যবস্থার মুশকিল হল, সন্ধিবিচ্ছেদ করলে সেটি দাঁড়ায় (এক)শত এবং অংশ। অর্থাৎ আপনি মনের মতো জুড়ে যেতে চাইলেও সেটি একশোর বেশি হওয়া চাপ। এক্ষেত্রে আবার আরও মুশকিল, সুপ্রিম কোর্ট কবে একটা রায় দিয়ে বসে আছেন, সংরক্ষণ হোক, কিন্তু মোট আসনের আদ্ধেকের বেশি যেন না হয়। এদিকে নতুন সংরক্ষণ ব্যবস্থায় ওবিসি ইডব্লিউএস জুড়লে পঞ্চাশ শতাংশ ছাপিয়ে একেবারে দুই-তৃতীয়াংশে পৌঁছে যাচ্ছে। অতএব, বেশ কয়েকখানা পিটিশন দাখিল হল এবং মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত সেই সব আবেদন মন দিয়ে শুনতে শুরু করলেন। আর এদেশে আদালতের নামে যে বদনামই দিন না কেন, তাঁরা রায় দেওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করেন, এমনটি বলতে পারবেন না।
এদিকে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া নিয়েও বিস্তর ক্যাঁচাল। প্রবলভাবে মেধাপন্থী হয়েও যাঁরা দেশের বিবিধ অসাম্য ও তজ্জনিত সামাজিক বঞ্চনা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন, তাঁরাও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়াদের জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেন না। সরকারবাহাদুরও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে ভাবতে বসলেন। বললেন, মাসে পঁচাত্তর হাজার টাকার নিচে (বার্ষিক আট লাখ) যাঁদের আয়, তাঁরা একেবারে হতদরিদ্র – তাঁদের জন্য সংরক্ষণ জরুরি। (একটু অপ্রাসঙ্গিকভাবেই মনে করানো যাক, সরকারি হিসেব-নিকেশ ধরলে, গ্রামাঞ্চলে মাসে মোটামুটি হাজারখানেক আর শহরাঞ্চলে চোদ্দশ টাকার মতো আয় করতে পারলেই তিনি আর তেমন সরকারি খাতার গরীব নন এবং এই সংজ্ঞা গত এক দশকে বদলানোর কথা কেউ ভাবেননি)
এমতাবস্থায় মাসিক পঁচাত্তর হাজার অঙ্কটি ভাববিহ্বল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যথারীতি সে নিয়েও আদালতে পিটিশন দাখিল হলো। বিচারপতিরা জানতে চাইলেন, ঠিক কোন হিসেবে এই পঁচাত্তর হাজার আয়কে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়ার মাপকাঠি ধরা গেল। প্রাথমিক তানাবানার পর সরকারপক্ষের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল জানালেন, নাহ্, তাড়াহুড়ো ভালো দেখায় না, একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে উত্তর দেওয়া যাবে’খন। মাসখানেক ভাবাভাবির পর উত্তর দেওয়া হবে। এর আগেই অক্টোবরের শেষাশেষি যে কাউন্সেলিং শুরু হওয়ার কথা, তা স্থগিত হয়ে গিয়েছে। নভেম্বরে সলিসিটর জেনারেলের এমন সময় খাওয়া উত্তরের চোটে পুরোটা ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল। কেননা, সরকার মাসখানেক সময় চাইলে আদালতে তারিখ-পে-তারিখ-এর খেলায় সেটা দু’মাসে দাঁড়ায় (এক্ষেত্রে নভেম্বরের শুরুর দিকে কথাবার্তার পরবর্তী শুনানির তারিখ দাঁড়িয়েছে জানুয়ারির ছয় তারিখ)।
প্রত্যাশিতভাবেই পরীক্ষায় সফল হয়ে যাঁরা ভর্তির জন্যে উদগ্রীব, তাঁরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়লেন। শুরু হল অবস্থান বিক্ষোভ। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, দুদিন আগেই যে সরকার আদালতে জানালেন, আদালতের সিদ্ধান্ত ছাড়া কাউন্সেলিং শুরু করাটা পরবর্তী ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, সেই সরকারই ছাত্রছাত্রীদের বললেন, তাঁরা যত দ্রুত সম্ভব কাউন্সেলিং শুরু করবেন, অবস্থান বিক্ষোভ যেন তুলে নেওয়া হয়। সরকারের বড় বালাই, কেননা ভর্তির অপেক্ষায় থাকা ছাত্রছাত্রীরা এতদিন কোনও না কোনও হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার বা হাউসস্টাফ ছিলেন, তাঁদের অনুপস্থিতিতে পরিষেবা চালু রাখাটা সহজ নয়। সে যা-ই হোক, সরকারের প্রতিশ্রুতি শুনে অবস্থান তুলে নেওয়াও হয়েছিল, কিন্তু অচিরেই বোঝা যায়, সরকারবাহাদুর ভারতীয় রাজনীতির ঘরাণা অনুসারী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন মাত্র। অতএব অবস্থান বিক্ষোভ পুনরায় শুরু হয়।
এ তো গেল যাঁরা ভর্তি হতে পারেননি, তাঁদের কথা। মুদ্রার উল্টো পিঠের গল্পটাও জেনে নেওয়া যাক।
সকলের জ্ঞাতার্থে জানানো যাক, বিশেষজ্ঞ হওয়ার শিক্ষার যে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডাক্তারি ডিগ্রি – এমডি বা এমএস – তার সময়কাল তিন বছর। এই তিনটি বছর – ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার এবং থার্ড ইয়ার – তিন বছরে সংশ্লিষ্ট ছাত্র/ছাত্রীর কাজের ধাঁচ আলাদা। শুরুর দিকে রুটিন কাজ বেশি, শেষের দিকের কাজ অনেকখানিই বিষয় অনুসারী। নতুন ছাত্রছাত্রীরা না আসায় যাঁদের ইতোমধ্যে সেকেন্ড ইয়ার হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তাঁদের ফার্স্ট ইয়ার দশা কাটতে পারছে না। থার্ড ইয়ার, যাঁদের এই দুর্বিপাকে সেকেন্ড ইয়ার হিসেবেই ভাবা উচিত, তাঁরা ফাইনাল পরীক্ষায় বসবেন মাসতিনেক বাদে। জানুয়ারির শুরুতে শুনানি হয়ে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত হাতেগরম রায় দিলেও কাউন্সেলিং সম্পূর্ণ হয়ে নতুন ব্যাচের ছাত্রছাত্রী খুব তাড়াতাড়ি এসে উঠতে পারবেন না। পরিস্থিতি এমন, আগামী মাসদুয়েকের মধ্যে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পোস্ট-গ্রাজুয়েট ছাত্রছাত্রী বলতে থাকবেন শুধুই সেকেন্ড ইয়ার, যাঁদের আপনি ফার্স্ট ইয়ার বলেও ডাকতে পারেন।
এদেশের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অব্যবস্থার পেছনে চিকিৎসকের ঘাটতি একটি বড় কারণ। সরকার এবং আদালত, দুইয়ের গতিমন্থরতার কারণে প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার চিকিৎসক হাসপাতালে যোগদান করতে পারছেন না, যাঁদের অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রীরই আগামী তিন বছরের জন্যে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় থাকার কথা ছিল। এমন নয় যে এঁরা নতুন ম্যানপাওয়ার। পোস্ট-গ্রাজুয়েট এই আসনগুলি সংখ্যায় নির্দিষ্ট এবং পূর্বনির্ধারিত – এঁদের অনুপস্থিতিটা ঘাটতির মধ্যেও বাড়তি ঘাটতি। অতএব এক অপ্রতুল স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে এঁদের ভর্তি হতে না পারাটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের সামিল।
এই বিক্ষোভ অবস্থানের কোনও খবরই আপনি রাখেননি।
সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এই বিক্ষোভের উপর দিল্লি পুলিশের সহৃদয় লাঠি চালানোর খবরও আপনি রাখেননি, যদিও শতাধিক ডাক্তারি ছাত্রছাত্রী কমবেশি আহত।
হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তাররা – এই টালবাহানার চোটে যাঁরা প্রায় ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত – পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে তাঁরা কর্মবিরতি শুরু করেছেন। জানেন কিনা, জানি না।
সরকারবাহাদুর পুলিশ পাঠাতে যতখানি পারঙ্গম, সমস্যার সমাধানে ততখানি নন।
এমতাবস্থায় আপনি কী ভাববেন? আদৌ কিছু ভাববেন কি??
সঙ্গের ছবি – সরকারি সমাধান। (ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান-বিক্ষোভের মানবিক সমাধানে তৎপর দিল্লি পুলিশ)
গোটা ঘটনাটির উন্মোচন খুব পরিস্কারভাবেই হয়েছে। সাধারণ পাঠকের বুঝতে কোনও অসুবিধা হবে না। পিজি মুখী ডাক্তারদের এই দূরাবস্থার পিছনে সরকার তো অবশ্যই দায়ী সেই সঙ্গে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়বদ্ধশীল প্রতিষ্ঠান আদালতের ভূমিকাও এক্ষেত্রে নিন্দনীয়। এক্ষেত্রে প্রতিবাদ আন্দোলন ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকাও যথাযথ দেখা যাচ্ছে না। IMA সহ অন্যান্য পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে সক্রিয় ভূমিকা কাম্য।