আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে নারী-নাগরিকের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের দাস্তান বড়ই অর্বাচীন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সুইডেনের কিছু অংশে আর আরো পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার কোনো কোনো জায়গায় নারীদের ভোটাধিকার চালু ছিল। তাও যে নারীরা করদাত্রী ছিলেন বা কিছু ভূসম্পত্তির অধিকারিণী ছিলেন, তাঁরাই দিতে পারতেন ভোট। অতএব ক্ষমতার সঙ্গে আর্থিক মজবুতির যোগটা বিশ্বায়নের বহু আগে থেকেই বেশ পোক্ত ছিল, এ কথা ভাবা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে (১৮৭০ নাগাদ) আমেরিকার উটা প্রদেশে মহিলাদের ভোটাধিকার চালু হয়, আরো কিছু বছর পরে চালু হয় নিউইয়র্কেও। তারও পরে তা খাপছাড়া ভাবে আরম্ভ হয় ইউরোপের কিছু কিছু অঞ্চলেও। তবে, একটি স্বাধীন দেশের পুরোদস্তুর সাধারণ নির্বাচনে সমস্ত মহিলা নাগরিকের যোগদানের অধিকার প্রথম দেয় নিউজিল্যান্ড, সালটা ১৮৯৩।
ব্রিটিশ রাজের অন্তর্গত ভারতে প্রথম মহিলা ভোটাধিকার পায় ম্যাড্রাস প্রভিন্স, ১৯২১ সাল নাগাদ। তারপর ধীরে ধীরে বম্বে প্রভিন্স, আগ্রা ও অওধ প্রভিন্স, বর্মা ও আসাম প্রভিন্স, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি সহ অন্যান্য রাজ্যেও আসে মেয়েদের ভোটদানের অধিকার।
অবশেষে ১৯৪৭ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় নারীপুরুষ সকলেই মতদানের অধিকার প্রাপ্ত হ’ন।
মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে নারীদের ভোটের অধিকার পেতে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক গড়িয়ে গিয়েছিল। ২০০৬ সালে সংযুক্ত আরব আমীরশাহী এবং তারও পরে ২০১৫ সালে সৌদি আরব মেয়েদের ভোটাধিকারের দরজা খুলে দেয়।
এখন পৃথিবীতে মাত্র একটি দেশেই মহিলাদের ভোটাধিকার নেই — ভ্যাটিকান সিটিতে, বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশে।
ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মেয়েদের ভোটের অধিকারের বয়স প্রায় চার কুড়িতে গিয়ে ঠেকল। চৌদিকে ভোটের ডামাডোল। টিভির হরেক চ্যানেলে এগজিট পোলের প্রশ্নাবলী, শতাংশের আঙ্কিক কচকচি, প্রার্থীর ডায়েট, বিভিন্ন দলের নানান ইস্তাহার, প্রতিশ্রুতি, হুমকি, চমক, নরম গরম বক্তৃতা, জনসভার জোয়ার দেখতে দেখতে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন মনে খচখচ করে ওঠে রোজ। এই যে অর্ধেক আকাশ, মেয়েরা, ঠিকঠাকভাবে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন তো নির্বাচনে?
যে কোনো ইলেকশনের আগে বাড়ির কাজের দিদিদের যখনই জিজ্ঞাসা করেছি, ‘কাকে ভোট দেবে ঠিক করে রেখেছ তো? কাউকে জানাবে না কিন্তু আগে থেকে’ — অবধারিত জবাব পেয়েছি, ‘ওসব ছেলেদের বাবা জানে দিদি, আমাকে যাতে বলবে, তাতে দেব’।
কোনো কোনো যৌথ পরিবারে আবার স্বামী নয়, বাড়ির কর্তা, সে শ্বশুর, ভাসুর যে-ই হোক, তার কথা মতো চিহ্নতেই ভোট দিয়ে আসতে হয়েছে মেয়েদের। এটা যে অনুচিত সেটা বলতে গেলে সিংহভাগ ক্ষেত্রে শুনতে হয়, আমরা কি অতশত বুঝি দিদি? যাতে বলবে, তাতেই তো দিতে হবে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই নিজেদের এই অপারগতাতে সিলমোহর ফেলে, একটা অন্যায্য খবরদারিকে জাস্টিফাই করেছে বেশির ভাগ সময়ে।
শ্রমজীবীদের জন্য হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, একই চিত্র সেখানেও। অনেক অসংগঠিত শ্রমক্ষেত্র, যেমন ইটভাটা, জরির কাজের কারখানা, স্থানীয় হস্তশিল্পের আড়তে আবার ব্যবসার মালিকের কথাই শেষ কথা। সেখানে নরনারী নির্বিশেষে বুঝে (অথবা না বুঝেও) নির্দেশিত চিহ্নে ভোটটি দিয়ে আসছে, এটা চেনা দৃশ্য।
১৯২০-৩০ সালে আমার ঠাকুমার নিজ গর্ভধারণের সংখ্যা নির্বাচনের অধিকার ছিল না, ১৯৪০-৫০ সালে পিসিদের ছিল না বাড়ির বাইরের গন্তব্য নির্বাচনের অধিকার। ১৯৬০-৬৬ সালে মা-মাসীদের কলেজের পড়ার বিষয় নির্বাচন থেকে বিয়ের বেনারসীর রং নির্বাচনের অধিকার ছিল না, জীবনসঙ্গী নির্বাচনের কথা ছেড়েই দিলাম। ১৯৮০-৮৫তে আমার মামাতো মাসতুতো দিদি, বৌদিদের ইচ্ছামতো পোশাক নির্বাচনের অধিকার ছিল না, ছিল না পছন্দসই পেশা নির্বাচনের অধিকারও।
হ্যাঁ, অবশ্যই চিত্রটা সামগ্রিক নয়, তবে আমার পরিবারও তো এই দেশের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছে, যারা হয়ত ততটা আলোকপ্রাপ্ত নয়। তাদের সেই পশ্চাদপদতা অবাক করা হতে পারে, মিথ্যে তো নয় কোনোমতেই।
আরো সময় গড়িয়ে আমি, আমার বোন, বোনঝি, ভাইঝিরা পেয়েছি জোরগলায় নিজেদের পছন্দ জানানোর অধিকার। ‘না’ ও যে একরকম পছন্দ, চয়েস, সেটা জানাতে পারছি জোর গলায়। কেউ পেয়েছি একক জীবন নির্বাচনের অধিকার, তো কেউ অ-প্রথাগত জীবিকা নির্বাচনের অধিকার পেয়ে গিয়েছি।
হ্যাঁ, দিন বদলাচ্ছে। মেয়েদের সব সিদ্ধান্ত সঠিক হয়ত হবে না। সদর্পে ‘মাই চয়েস’ ঘোষণার পরেও ভুল থেকে যাবে হয়ত নির্বাচনে। থাকুক ভুল। ‘আমরাও পারি’ এই আত্মবিশ্বাসটুকু তো ফিরুক।
নিজের জীবনের ছোট ছোট সিদ্ধান্ত থেকে বহির্জগতের বৃহত্তর সিদ্ধান্ত — ভুল করতে করতে, ঠেকতে ঠেকতে মেয়েরা নিজেরাই নিতে শিখুক নিজেদের নির্বাচনের ভার।
যে দল বা প্রার্থীকে দেখে ভোট দিক, দেওয়ার কারণটা যেন স্বচ্ছ হয় নিজের কাছে। এই স্বচ্ছতাটুকু প্রয়োজন। ভুল হতেই পারে মূল্যায়নে, কাঁচকে হিরে ভেবে ফেলে ঠকতেই পারে মন, কিন্তু নিজের কাছে নিজে যেন সৎ থাকে মেয়েরা।
অষ্টাদশ থেকে একবিংশ শতাব্দী, অনেক যুদ্ধ, অনেক রক্তপাতের সাক্ষী আমরা — কোনো ব্যাপারেই তো আর সেভাবে পরমুখাপেক্ষী নই, তাই ভারি ভারি সাংবিধানিক লব্জের ভয় দেখিয়ে মেয়েদের ভোট-প্রতিবন্ধী যেন আর না করে রাখতে পারে সমাজ! আমাদের সকল শুভবুদ্ধি, সব সচেতনতা দিয়ে না-পারার আঁধার ঠেলে ২০২৪ এর সাধারণ নির্বাচন ভাস্বর হয়ে উঠুক, এই আশা রাখছি। আপনারাও রাখুন।