বর্ষাকালের সকালে বাইকে রাজীবের চেম্বারে গেলে ভিজতে হবেই। রেনকোট পরলে ঘামে ভিজতে হবে, আর না পরলে বৃষ্টিতে। কোথায়, কখন, কীভাবে যে বৃষ্টি নামবে- বলা মুশকিল।
গত রবিবার যেমন রৌদ্র দেখে বেরলাম, কল্যাণী এক্সপ্রেস ওয়েতে উঠতেই ঝুম বৃষ্টি নেমে গেল। রাস্তার ধারে দাঁড়ানোর মতো ছাউনি নেই। এক্সপ্রেস ওয়েতে দাঁড়িয়ে রেনকোট পরাও মুশকিল। অতএব চুপচুপে ভিজে গেলাম।
রাজীব আমার অবস্থা দেখে বলল, আরে… আপনি তো একেবারে ভিজে কাক হয়ে গেছেন।
বললাম, তাও ভালো, কাক বলেছো, ভিজে বেড়াল বলোনি।
রাজীব হেসে বলল, আগে মাথা টাথা মোছেন। গেঞ্জি খুলে নিংড়ে নেন। কফি খান। তারপর পেশেন্ট দেখবেন।
বৌদি এসে কফি দিয়ে গেলেন। ভিজে গায়ে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে রোগী দেখার মজাই আলাদা। একটাই সমস্যা হাঁচি শুরু হয়ে গেল।
আমার হাঁচি একবার শুরু হলে আর থামেনা। চলতে থাকে… চলতেই থাকে। রাজীবকে ডেকে বললাম, টিস্যু পেপার টেপার কিছু দাও।
রাজীব বলল, আপনার অবস্থা তো হেব্বি জটিল। কথা বলতে গেলেই তো হাঁচি হচ্ছে। একটা এলার্জির ওষুধ দি?
বললাম, এলার্জির ওষুধ খাওয়া যাবে না। বড্ড ঘুম পায়। হাঁচতে হাঁচতে তবু রোগী দেখা যায়। কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যায় না।
একটু বাদেই বৌদি গোটা পাঁচেক টিস্যু পেপার নিয়ে এলেন। বাপ্পাদা দেখতে এলেন। দোকানে কাজ করে যে দুটি মেয়ে তারাও দেখতে এলো। বাপ্পাদা বললেন, রাজীবের কাছে শুনলাম আপনার নাকি খুব জ্বর চলে এসেছে। তাহলে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নেন। তারপর আধঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে রোগী দেখবেন।
দুটি জিনিস বুঝলাম। প্রথমত ডাক্তারি করার সুযোগ পেলে বাঙালিরা সহজে ছাড়ে না। স্থান- কাল, পাত্র- পাত্রী যাই হোক না কেন তারা ডাক্তারি উপদেশ দেবেই। দ্বিতীয়ত গুজব আগুনের চেয়েও দ্রুত পল্লবিত হয়ে ওঠে। কয়েকবার হাঁচি দিতেই জ্বরের গল্প শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে হয়তো নিউমোনিয়ায় অবস্থা মরো মরো হয়ে যাবে।
তবে এসব নিয়ে আর চাপ নিই না। করোনা মহামারীর সর্বোচ্চ সময়ে লোকজন দু-তিনবার আমাকে মেরে ফেলেছেন। সে মেরেছেন, বেশ করেছেন। ভূত হয়ে জীবন কাটাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। বরঞ্চ ভূতেরা প্রভূত সুযোগ সুবিধা পায়, যেটা সাধারণ মানুষেরা পায় না।
বৌদি বললেন, আমার এক বান্ধবী মেয়েকে নিয়ে এসেছে। এবার ওকে ঢোকাচ্ছি। মেয়েটা ভয়ংকর ন্যাকা। মা বাবাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে।
আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে তার মা ঢুকলেন। বৌদি বললেন, এর সাথে আমি স্কুলে পড়তাম। আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। তোর মেয়ের আবার কী হলো?
মেয়েটির মা বললেন, গত সাতদিন ধরে মেয়ে ঠিক ঠাক খাচ্ছে না। কথা বলছে না। মেজাজ সারাক্ষণ তিরিক্ষে হয়ে রয়েছে। কিছু বললেই ফোঁস করে উঠছে।
আমি হাঁচি চেপে রোগী দেখায় মন দিলাম। বৌদি বলল, কীরে, কী সমস্যা হলো তোর?
মেয়েটির মা বলল, আজকালকার মেয়ে। বুঝতেই পারছিস।
বৌদি বলল, কীরে, প্রেম ট্রেম করছিলি নাকি? কেটে গেছে?
মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। রোগ ধরা গেছে। বললাম, দু একটা ইয়ে … কেটে যাওয়াই ভালো। না হলে আসল লোককে খুঁজে পাবি কী করে?
বৌদি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ… ওসব অনেক হবে। চাপ নিস না। মাঝখানের এই সময়টায় বরঞ্চ একটু পড়াশুনো করে নে।
মেয়েটিকে সামান্য ওষুধপত্র দিয়ে আর কাউন্সিলিং করে বাড়ি পাঠালাম। বৌদি বললেন, বৃষ্টিতে আজ পেশেন্ট কম। রাজীবের একজন স্পেশাল পেশেন্ট আছে। দাঁড়ান পাঠাচ্ছি।
প্রতি চেম্বারের শেষেই রাজীবের এরকম দু-তিনজন বিশেষ রোগী থাকে। এই রোগীদের মধ্যে মিল গুলি হচ্ছে এঁদের বয়স সত্তরের বেশি। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। হয় সন্তান নেই বা থাকলেও সন্তানেরা তাঁদের দেখাশোনা করেনা।
রাজীব একটি বুড়িকে নিয়ে ঢুকল। রাজীবের বিশেষ রোগীদের পোশাক আশাকের অবস্থা খুব ভালো হয় না। কিন্তু এই বুড়ির পরনের থানটা অন্যদের মতো তেলচিটে ময়লা এবং শতচ্ছিন্ন নয়। বেশ সাদা। প্রায় ধপ ধপ করছে।
রাজীব বলল, দেখেন না, কী সমস্যা… বুড়িমা কাল রাতে এসে খুব কান্নাকাটি করেছেন। ওনার দুই ছেলে। দুজনেই ভালো ব্যবসা করে। দু তলা বাড়ি। কিন্তু দুটোই অমানুষ। মাকে কেউ দেখে না। কাল বিকালে বুড়িমাকে মেরে গায়ে কালশিটে ফেলে দিয়েছে। আমি কাল প্রেশার দেখেছি। প্রেশারও বেশ বেশি। ১৭০ বাই ৮৬। সুগার কাল রাতে ২২২। ছেলেরা মাকে ডাক্তার টাক্তারও দেখায় না। আপাতত ওষুধ টষুধ যা পারি জোগাড় করে দি।
বললাম, তুমি না হয় জোগাড় করে দেবে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে। ওঁর ছেলেরা তো আবার গায়ে হাত তুলবে।
রাজীব বলল, দেখি… বুড়িমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিচ্ছি। বিকালে একবার ক্লাবের কয়েকজনকে নিয়ে যাব। একবার বলে দেখি।
ভালো কথায় কী কাজ হবে? যারা নিজের বয়স্ক মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারে তোমার কী মনে হয় তাঁদের কাছে শান্তির ললিত বাণী ব্যর্থ পরিহাসের মতো শোনাবে না?
রাজীব বলল, শান্তিপূর্ণ আলোচনায় কাজ না হলে অন্য পদ্ধতি নিতে হবে। দরকার হলে ক্যালাতে হবে।
আমি অত্যন্ত আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, মারামারি হবে? তাহলে প্লিজ সন্ধ্যা ছটার পর চলো। আজ বিকালে আমার চেম্বার নেই। কোনো ক্যাম্প ট্যাম্পও নেই। বেশ কিছুদিন ধরে মনটা ঝিমিয়ে রয়েছে। এরকম একটা মহৎ উদ্দেশ্যে মারামারি দেখার সুযোগ মিস করতে চাই না।
বুড়িমা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। এবার বললেন, তোমাদের মতলব কী বলতো? আমার ছেলেরা যেমনই হোক তোমরা তাদের মারধর করার কে?
রাজীব বলল, যে সন্তানেরা বুড়ি মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারে তাদের মার খাওয়াই উচিৎ। নইলে তাঁরা শুধরবে না।
বুড়ি হঠাৎ খেপে উঠলেন। বললেন, তোমার সাহায্যের দরকার নেই। আমার ছেলে আমার সাথে কী করবে সেটা আমি বুঝে নেব। তোমাদের নাক গলাবার দরকার নেই।
বুড়ি উঠে হাঁটা দিলেন। রাজীব তাঁর পেছন পেছন দৌড়ল। সে বলছে, ওষুধ গুলো নিয়ে যান। না হলে যা প্রেশার- আজই স্ট্রোক ট্রোক হয়ে যাবে।
আমার হাঁচি আরো বেড়েছে। খুপরিতে বসে অপেক্ষা করছি কখন রাজীব আবার বুড়িমার মান ভাঙিয়ে ফেরত নিয়ে আসে।