প্রশ্নঃ– আমি একজনের wall এ হোমিওপ্যাথি নিয়ে তার বিশ্বাসের পোস্টে তোমার কমেন্ট দেখেছি। আমি দেখেছি তুমি তার বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বলোনি। অথচ বলতেই পারতে। এক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে বলার যথার্থ মানুষ তুমিই।
আমার প্রশ্ন হল, তুমি কি মনে করো অন্যের বদ্ধমূল বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা ভুল?
এই গোলমেলে প্রশ্নটি ইনবক্সে করেছে আমার কন্যা। গোলমেলে এই কারণে যে, একটির ছদ্মবেশে এখানে দু’টি প্রশ্ন আছে।
প্রথম প্রশ্নটা বেশি জটিল।
আমি কেন তেড়েমেরে সেই অমিয়পথিককে তার ভ্রান্তি ধরিয়ে দিইনি। যদিও আমি তথাকথিত যুক্তিবাদ নিয়ে বারফাট্টাই মেরে থাকি। আধুনিক বিজ্ঞানের জয়গান প্রচারকারী হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে উৎসুক।
প্রশ্নের উত্তরে পালটা প্রশ্ন করে উত্তর দেবার (পড়ুন উত্তর এড়িয়ে যাবার) একটা রীতি আছে। প্রথমে সেই চেষ্টা করি। যদ্দুর মনে পড়ছে সেই পোস্ট করোনা ও তার হোমিওপ্যাথি প্রতিরোধক সংক্রান্ত কিছু ছিল।
আমি নিজে একটা পোস্টও করেছিলাম। কমেন্টে দিলাম
সেইটি সমস্ত কমেন্ট সমেত পড়ে দেখা যেতে পারে।
কোভিড নামের এই নতুন অসুখটা সম্বন্ধে বহুকাল আগে কিছু বলে গেছেন সক্রেটিস। তিনি অবশ্য বৃহত্তর অর্থেই বলেছিলেন। – আমি অন্তত এটুকু জানি যে আমি কিছুই জানি না।
কোভিড নিয়ে ‘জানা’গুলি এখন অবধি তাই।
আমার পালটা প্রশ্নগুলি রাখি। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামের যে ওষুধ, এই অসুখের একেবারে প্রথম দিকে বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল অতি সাবধানীদের মজুতদারিতে, যে ওষুধের জন্য ট্রাম্প ভারতের ওপর অ্যাটম বোমা এই ফেলে কী সেই ফেলে অবস্থা, সেই ওষুধের করোনাবিরোধী অবস্থানটি এখন কী?
তারপর ধরুন, ওই ডক্সিসাইক্লিন বা আইভেরমেকটিন নামের ওষুধগুলি, যার বিরোধিতা করলে ব্রহ্মহত্যার পাপ বা হারামখোরের গুনাহ্ হয়ে যাবার যোগাড়, সেই ওষুধগুলিরই বা যুক্তিযুক্ততা কতটুকু! অবশ্য যুক্তি একটা আছেই, যারা টেলিমেডিসিন চিকিৎসার নামে কপি-পেস্ট মার্কা এই প্রেসক্রিপশন করে দু’ পয়সা কামাচ্ছিল, কামাচ্ছে… সেই তাদের জন্য।
বস্তুত এই কোভিড অসুখটার বহু কিছু এখন অবধি বুঝে ওঠা যায়নি। তার আগেই অবিকল সুনামির মত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট মনে হচ্ছে এটা যেন একটা মাত্র অসুখ নয়। বিরাট একটা স্পেকট্রাম। অ্যাসিম্পটমেটিক থেকে পোস্ট-কোভিড মৃত্যু (আচমকা বা ধীরে ধীরে) পর্যন্ত এর বিস্তার। অবিরত সেই মৃত্যু ঘটে চলেছে আমার নিকটজন থেকে মিলখা সিং অবধি সবার ক্ষেত্রে।
স্বভাবতই পুরো মানব সভ্যতাই দিশাহারা। নিমজ্জমান মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইছে। আমি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের বেলায় কিছু বলিনি, খামোখা হোমিওপ্যাথিক খড়কুটোর বেলায় গর্জন করব কেন? করোনিলের বেলা রামদেবের ধাপ্পাবাজি অবশ্যি বাড়াবাড়ি মাত্রায় চলে গেছিল, ডব্লিউ এইচ ও-কে জড়ানোর অপচেষ্টায়।
করোনার এই হোমিওপ্যাথিক প্রতিষেধকটি আবার আয়ুষ বলে এক দপ্তর আছে তাদের মান্যতা প্রাপ্ত। সেই আয়ুষ কে চালায়? আজ্ঞে হ্যাঁ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার বাহাদুর।
সেই গণতান্ত্রিক বাহাদুরের লকডাউন মানব, লাঠির গুঁতোয়। আবার তার দেওয়া বিনি পয়সার রেশন, অনলাইন ক্লাসের জন্য ট্যাবের পয়সা সব নেব হামলে পড়ে। তাহলে তারই স্নেহপ্রাপ্ত আয়ুষকে মানব না কেন?
ওরা না হয় বিজ্ঞানবিরোধী মৌলবাদী!
এরা? সরকারি হাসপাতালে হোমিওপ্যাথি আউটডোর, পাঁচতারা হাসপাতালে হোমিওপ্যাথি আরএমও। ক’টার প্রতিবাদ করেছি?
সিধে কথা, বড়দের কথা মানতে হবে। হ্যাঁ, এটাই সভ্যতার তান্ত্রিক নিদান। সে গণতন্ত্রই বল আর রাজতন্ত্রই বল।
হোমিওপ্যাথি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছু আসে যায় না। জনগন যদি কে সি পালকে ভোট দেয়, আগামী কাল থেকে শপথ গ্রহণ করে সূর্য আর নক্ষত্রজগৎ পৃথিবীকে ঘিরে পাক খাবে। ওই যে বললাম, গণতন্ত্র!
তার চেয়ে বরং হোমিওপ্যাথি নিয়ে আমার জীবনের ব্যক্তিগত কিছু বুলবুল ভাজা নিবেদন করি।
ক্লাস ফাইভ-সিক্সে হিলোরা নামের গণ্ডগ্রামে, যাদের বাড়ি ভাড়া থাকতাম, তাদের বড় ছেলে কালিদাস দা, তিন তিন বার ম্যাট্রিক ফেল করার পর হতোদ্যম না হয়ে শ্রীদুর্গা হোমিও হল বলে একটা সাইনবোর্ড বানিয়েছিলেন। তিনি প্র্যাক্টিস শুরু করার আগেই মা সেখান থেকে বদলি হয়ে যান। এই ঘটনাটা বললাম সাধারণ মানুষের ধারণাটা বোঝানোর জন্য।
অসাধারণরাও ব্যতিক্রম নন। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাই যেখানে…। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ইত্যাদি আরও কতজন।
স্কুল জীবনে হোমিওপ্যাথি বড় কষ্ট দিয়েছে। পেট ব্যথা বা ওইরকম কিছু বলে ক্লাস কামাই করে বাইরের এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটি’র সুযোগ ছিল না। হেড স্যারের কাছে গেলেই রেফার করে দিতেন হাবুল স্যারের কাছে।
তিনি হোমিওপ্যাথি জানতেন। কিছু মিষ্টি গুলি বা ঝাঁঝালো ফোঁটা ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে রাখতেন টিচার্স রুমের বারান্দায় বেঞ্চিতে। ছুটির ঘণ্টা অবধি।বিড়ম্বনার একশেষ। ক্লাস ফাইভের বাচ্চারা অবশ্য টিফিন বেলায় এটা ওটা বলে স্যারের কাছ থেকে মিষ্টি গুলি খেয়ে আসত। হাস্যমুখ স্যার না করতেন না কাউকেই।
একটা বলবার মত ঘটনা ঘটেছিল আমার হোস্টেল জীবনে। সত্যি কাহিনি। বলি তবে। আমার রুমমেট গৌতমের চিবুকে একটা গ্যাঁজ মত ছিল। শেভ করতে গেলেই প্রতিবারে রক্তারক্তি কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড। পরে অপারেশন করে সেটি বাদ দেওয়া হয়।
গৌতম গোড়ায় হোমিওপ্যাথি করছিল। লাভ হয়নি কিছু। এদিকে তখন আমার সদ্য প্রেমিকা সুনন্দা(আমার গত চল্লিশ বছরের গৃহিণীও বটে)। শ্রীমতীর হাতের তালুর উল্টো পিঠে একটা গুলটি বেরিয়েছে। তার পোষাকি নাম গ্যাংলিয়ন।
গৌতম আমাকে খুব হেলাফেলা করে তার মোটেই কাজ না হওয়া হোমিও ওষুধের শিশিটা ধরিয়ে বলল – যা, এটা তোর বউকে খাওয়া গিয়ে।
খাওয়ালামও। এক সপ্তাহে গুলটি হাওয়া!
কার্যকারণ জানি না মশাই। কেউ হয় তো বলবেন কাকতালীয়। তবে আমার কিন্তু তখন তারাপদ রায়ের গল্প মনে পড়ে গিয়েছিল।
তাতে ছিল বাঙালেরা উচ্চারণ ঠিকঠাক করতে পারে না এই প্রচারটা ভুল। পারে। কিন্তু ঠিক জায়গায় বলতে পারে না, এই যা।
যেমন কথাটা হয়তো এমন যে, – জোচ্চোর শ্যাম বাবুকে দেখে পাড়ার সকলে শেম শেম বলে উঠল।
বাঙাল সেটিকে বলবেন, – আরে, ওই জুচ্চোর শেম বাবুরে দেখা পাড়ার হক্কলে শ্যাম শ্যাম কইরা চ্যাঁচাইল।
অস্যার্থ, হোমিও ওষুধে কাজ ঠিকই হয়, তবে যেখানে যেটি হবার সেটি হয় না। আমার গিন্নিই প্রমাণ।
চাকরি জীবনে দেখেছি, ধুবুলিয়া হেলথ সেন্টারের অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার, বাইরে প্র্যাকটিস করেন হোমিওপ্যাথি। আর সেখানেরই সরকারি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বাইরে প্র্যাকটিস করেন অ্যালোপ্যাথি। আর দুজনেই হাসপাতালের আউটডোরে একে অন্যের প্র্যাকটিসের প্রেসক্রিপশন দেখে গজগজ করেন, – কিচ্ছু জানে না তবু লেখে!আমাদের প্রবাদপ্রতিম এফএসএম শিক্ষক জেবি মুখার্জি বলতেন, ভিন্ন প্রসঙ্গে যদিও
– পৃথিবী আনন্দময়, যার যাহা মনে লয়…
চিকিৎসা ব্যাপারটিও তাইই। সবাই অভ্রান্ত। হোমিওপ্যাথি আদৌ কাজ করে কিনা, সেটা না ভেবে ভাবতে হবে এ ব্যাপারে গণতন্ত্র কী বলে। জনপ্রতিনিধি কী বলে। চণ্ডীমণ্ডপের সবজান্তা সিইওর মতে ঠিকটা কী?
শুধু ওই সার্জারি, ভেন্টিলেটর, ডায়ালিসিস, আর নানান ইনভেসিভ ব্যাপারস্যাপার, ভ্যাক্সিন আর হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি হলে শেষের দিকের চিকিৎসাও, মডার্ন মেডিসিন (পড়ুন অ্যালোপ্যাথি) জানা লোকেরা দখল করে রেখেছে। । এই যা…
আমার এই এলোমেলো সাফাইয়ে বুঝতে পারছি
লাভ তো কিছু হলই না। ক্ষতি হল বিস্তর।
কন্যাটি গাল ফোলাবে, কেন হা রে রে করে হোমিওপ্যাথিওয়ালাদের ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়লাম না। বিরক্ত হবে আমার দ্বিধা দেখে।
মডার্ন মেডিসিনের মানুষজন যাঁরা সঙ্গত কারণেই আমাকে আপনজন ভাবেন, তাঁদেরও রাগ হবে ‘অবৈজ্ঞানিক’ কাণ্ডের প্রতি নরম আচরণ দেখানোয়।
আর হোমিওপ্যাথি অনুরক্ত অমিয়পথিকেরা ক্ষেপে যাবেন সুক্ষ্ম তাচ্ছিল্যটুকু দেখে।
সে ক্ষতি যা হয় হোক, এবারে প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে যাই।
অন্যের বদ্ধমূল ভুল বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা উচিত কিনা।
অবশ্যই উচিত। বিশেষ করে সেই ভুল বিশ্বাস যদি সমাজ-সভ্যতার ক্ষতি করে।
কিন্তু, হ্যাঁ, এই ‘কিন্তু’টা খুবই জরুরি। কিছুকাল আগে অবধি যুক্তি দিয়ে সেই তর্ক প্রচুর করে থাকলেও এখন আর করি না।
করি না তার কারণ বদ্ধমূল ভুল বিশ্বাস ভাঙতে গেলে যে মানসিক জোর লাগে আর লেগে থাকার ক্ষমতা লাগে, তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি হারিয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে ভুল বিশ্বাস পুরোনো দাদের মত। যাদের আছে তারা ওইটি চুলকে আরাম পায় বলে আরোগ্য চায় না।
অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছি, যে কোনও তর্কের আগে তার্কিকেরা যে অবস্থানে থাকে তর্কের শেষেও সেখানেই রয়ে যায়। মাঝখান থেকে সময় আর সম্পর্ক নষ্ট হয়। হাতে গোণা সময়ে… ওই আর কী… কেমন যেন মনে হয়,
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়!
আমি মাথা ঘামাই না এদের কুযুক্তিতে ও কোমর ভেঙে দেব, হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব এই জাতীয় প্ররোচনায়।
দীর্ঘ যাত্রায় মেনে নিই রেলগাড়ির ছারপোকাটিও সহযাত্রী। জীবন আমাকে আর কিছু না শেখাক এইটুকু শিখিয়েছে।
মাগো, রাগ করিস না। এই মেনে নেওয়াই আমার নিয়তি। তবে তোরা মানিস না। লড়াইটুকু জারি রাখিস।