গাড়ি দুর্ঘটনা হওয়ার পর অনেকগুলো ঘটনা পরপর ঘটে গেল। আমার কলিগ ডাক্তারের অন্যত্র ট্রান্সফার অর্ডার এলো। সে খুব খুশি। আমাকে অনুরোধ করলো রিলিভার ছাড়াই যেন আমি তার চার্জ বুঝে নিয়ে ছেড়ে দিই। শুভানুধ্যায়ীরা আমাকে বারণ করা সত্ত্বেও ছেড়ে দিই তাকে। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল দুষ্টু গরু রেগে গেলে বাঘের থেকেও ভয়ংকর হয়ে যেতে পারে। তার থেকে গোয়াল শূন্য রাখা ভালো। আমার দুর্ঘটনার গল্প কিভাবে যেন মায়ের কানে চলে গেল। বাঁশবেড়িয়া থেকে মায়ের গুরুদেবকে সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির হতে হ’ল। আবারও পিজি এন্ট্রান্সে র্যাঙ্ক হ’ল। এবারেও দূরবীন দিয়ে দেখার মতো বিশ্রী র্যাঙ্ক। কাউন্সেলিং গিয়ে ক্লাসমেট অনন্ত ভট্টাচার্যের সাথে দেখা। খুব চিন্তাগ্রস্ত মুখ করে বললো – “তুই তো টেলএন্ডার স্পেশালিস্ট হয়ে যাচ্ছিস। এরপর কোনোদিন ভুল করে ভালো র্যাঙ্ক করে ফেললে এক্সামিনাররা বিশ্বাস করতে পারবেনা, তোর খাতা রিভিউ করতে পাঠিয়ে দেবে।” আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রভাত বিদ্যুৎপর্ষদে চাকরি নিয়ে রাম্মামে জয়েন করলো। আর বাবা সমস্ত দেখেশুনে বললেন “মন ঠিক করে নাও, যদি ভবিষ্যতে ড্রাইভিংটা পেশা করে নেওয়ার ইচ্ছায় থাকো তো শুধু শুধু এতদূর এসে পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই।”
গোলমেলে সেই সময়ে একমাত্র আশার আলো দেখালেন মায়ের গুরুদেব। এমনিতে ভদ্রলোকটিকে আমি সহ্য করতে পারতামনা। ডাক্তারি পড়তে ঢুকে হাড়গোড় এবং মড়াটড়া নিয়ে বিস্তর নাড়াঘাঁটা করার ফলে ভূতপ্রেত দত্যিদানোর ওপর আশৈশব লালিত বিশ্বাস চটকে গিয়েছিল। ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাসটা অপরচুনেস্টিক প্যাথোজেনের মতো পরীক্ষার আগে আগে বা রেজাল্ট বেরোবার সময় জাঁকিয়ে বসতো। তারপরের সময়ে পাক্কা কমিউনিস্ট – আত্মাও নেই, পরমাত্মাও নেই, সব সমান । গুরুদেব মানে তো আমার কাছে আপাদমস্তক ভন্ড একটা মানুষ। ভদ্রলোকের সাথে আমার বাক্যবিনিময় শুনলে রাজনৈতিক দাদা-দিদিরাও কানে আঙুল দেবেন। এহেন গুরুদেব নিদান দিলেন -ছেলের বিয়ে দিতে হবে। চৌঠা ডিসেম্বরের মধ্যে বিয়ে না দিলে আগামী পাঁচবছরের মধ্যে ভয়ংকর সব বিপদ পাহাড়ের খাঁজে, নদীর স্রোতের বাঁকে, সমুদ্রের গহনে আমার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। সেইসব খাঁজ, বাঁক ও গভীরতা থেকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র সুলক্ষণা একটি মেয়ে। বন্ধুরা কথাগুলোয় বিপদ আর মহিলাদের মধ্যে কিছু সাজুস্য খুঁজে পেয়ে যারপরনাই আহ্লাদিত। তাদের উৎসাহ দেখে মাঝেমধ্যে সন্দেহ হচ্ছিল -বিয়েটা আমারই তো?
পাত্র রাজি, পাত্রপক্ষ আরও বেশি করে রাজি। কিন্তু পাত্রী নেই। খবরের কাগজে অ্যাডভারটাইজমেনট গেল। একজনকে দেখতে যাওয়াও হ’ল। সে মুখের ওপর জানিয়ে দিলো যে ডাক্তারপাত্র তার মোটে পছন্দ নয়। অনেক কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও বললাম না। আসলে ডাক্তার পেশার মানুষেরাও যে দুহাত, দুপা, ঘাড়ের ওপর একটা মাথাওয়ালা মানুষ সেটা অনেকেই তলিয়ে ভাবেনা। মেয়ে ডাক্তারদের কোনো ছেলেকে বা ছেলে ডাক্তারদের কোনো মেয়েকে ভালো লাগতে পারে। অন্য পেশার নারীপুরুষদের মতো নিজের পছন্দের মানুষের প্রেমে এরাও পড়ে। ভালবাসায় এরাও ভাসে। আঘাত পেলে সারারাত অচেনা তারার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ভাসায়। ভালবাসার মানুষের হাত ধরে সারাজীবন হাঁটতে চায় ডাক্তাররাও। অনেকেই জানেনা।
মেয়েদেখা ব্যাপারটার মধ্যে আমার একটু আপত্তি আছে। তারওপর মেডিক্যাল সেন্টারে একা ডাক্তার বলে টানা তিনচার দিনের বেশি ছুটি পাওয়া যায়না। ফলে আমি আমার কর্মক্ষেত্রে ফিরে এলাম। সব ব্যাচে একজন মুশকিলআসান টাইপের ছেলে থাকে, আমাদের ছিল শৌভিক। সে মাকে ম্যানেজ করে ফেললো। “অনির্বাণের চোখে সকলই শোভন, সকলই নবীন , সকলই বিমল । আপনি শুধু পছন্দটা করে রাখুন।” আমাদের ব্যাচের কতো বাঘা বাঘা ডাক্তারকে শৌভিক কথার প্যাঁচে কব্জা করে রেখেছে আর মা তো শিশু। মা জোর লড়াই চালিয়ে একজনকে পছন্দ করে ফেললো।
প্রজেক্টচিফ দত্তসাহেবকে জানালাম যে আমার দিন দশেকের ছুটি লাগবে, বিয়ে করতে যাবো। একটু ভেবে নিয়ে দত্তসাহেব বললেন যে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রাম্মাম থেকে ডাক্তার প্রভাত পোড়েলকে কয়েকদিন ডেপুটেশনে রেখে দেওয়া হবে। কি সর্বনাশ! প্রভাতের তো আমার বিয়েতে বাসর জাগার কথা! আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম “তাহলে অন্তত বিয়ের তিনটে দিন ওকে ছেড়ে দিন। তিনচার দিন নাহয় আমাদের ড্রাইভাররা ‘নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ টু জলঢাকা’ লিখে গাড়িতে আটকে রাখবে। ”
কিন্তু বাধ সাধলো প্রভাত। শিলিগুড়িতে দুইবন্ধুর দেখা। প্রভাত ‘দেখাশোনা করে’ বিয়ের ডেড এগেন্সটে। নাক সিটকে বললো “তুই কি টেরোডকটাইল না টাইরানোসরাস যে এখনো দেখাশোনা করে বিয়ে করছিস? তোর সম্বন্ধে তো বেচারি কিছুই জানবেনা – তুই যে এই চেহারাতেই ঘর কাঁপানো নাক ডাকিস সেটা তোর জানানো উচিত।( মোটেই ঠিক কথা নয়। পরে জেনেছি, কুড়ি বছর সংসার করার অভিজ্ঞতা থেকে।) কিংবা তুই যে হাড়হাবাতে কিপ্টে, বন্ধুর পয়সায় দুপুরের লাঞ্চ সারিস, সেটা অবশ্যই তার জানা উচিত।” সেদিনের বিলটা আমিই মিটিয়েছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে।
মোটকথা আরও দু’চারটে মোক্ষম কথা প্রভাত আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। “মেয়েটা হয়তো বাড়ির চাপে বিয়ে করছে। বিয়ের সময় বেঁকে বসবে। ওর হয়তো অন্য কাউকে পছন্দ।( প্রভাত পুরনো বাংলা সিনেমার পোকা।) কিংবা কোনো ভয়ংকর রোগ আছে। ক্ষেপিও হতে পারে, মাঝরাতে উঠে তোকে হয়তো ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিলো। নাহলে নামকরা ডাক্তার, তারওপর বাঁড়ুজ্জে ব্রাহ্মণের মেয়ের তোর সাথে বিয়ে হবে কোন দুঃখে।”
নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। ঠিক করে নিলাম একদিন ভাবী স্ত্রীর সাথে দেখা করবো। লজ্জার মাথা খেয়ে ফোনে কথাটা মাকে বলেও ফেললাম। মা বললো “চিন্তা নেই, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” বাড়ি ফিরলাম। মায়ের ‘সব ব্যবস্থা’ মানে বাবা-মা, সেজোমামা, ছোট মেসোমশাইকে নিয়ে ভাবীস্ত্রীর সাথে একা-একা দেখা করতে যাওয়া। মা ওখানে গিয়ে ঘোষণা করলো “ছেলে মেয়ের সাথে কিছু কথা বলতে চায়, আমরা বরং দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। ”
অচেনা, অজানা একটা মেয়ের সাথে চুপচাপ বসেছিলাম। বাইরে হাহা হিহি হাসির আওয়াজ কানে আসছিলো। হঠাৎ করে কানে এলো কেউ একজন ছেলের পায়ের মাপ জিজ্ঞেস করছে। মেয়েটিকে বললাম “আপনার আমার থেকে বাইরের সবাই অনেকটা এগিয়ে গেছে।” মেয়েটা মাথা নিচু করে নেয়।
কিছুই জানা হয়না, কিছুই বোঝা হয়না। বাড়ি ফিরে আতঙ্কে ঘুম আসেনা, মেয়েটা পাগল নয়তো। এমনিতে আমি পাগলদের ভয় পাই। কাকেই বা দুশ্চিন্তার কথা জানাই। বাড়ি শুদ্ধ সবাই “বিয়ে-বিয়ে” বলে ক্ষেপে রয়েছে। দোতলার ওপর নিজের ঘরের জানালা দিয়ে দেখি একটা রাত ধিরে ধিরে ভোরের আলোয় নিজেকে মিশিয়ে নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।
এই নৃশংস ঘটনা আমরা ভুলতে দেবো না……
একটা মেয়ে ছিলো, অনেক স্বপ্ন নিয়ে সে ডাক্তার হয়েছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারে, প্রথম জেনারেশন ডাক্তার হওয়ার পথ খুব সহজ হয়না। সেসব লড়াই করে মেয়েটা নামের আগে
বাপু হে । ডাক্তারি ছেড়ে লিখুন । লোকে অন্ততঃ সম্মান করবে । আর এই লেখা কোনোমতেই বৌমাকে পড়তে দেবেন না ।
???
” ডাক্তারের গাম্ভীর্যে বিকশিত দন্ত আড়াল ” না
” কবির সারল্যে কাব্য রচনা ” যে আমাদের মোহিত করে , সেই “মহান” ?
মিষ্টু
অনেক ধন্যবাদ ???
Sir….darun…amaro jante ichhe hochhe…ma’am Jane to???khub Valo lekha…chalea Jan…sobai achi
পৃথিবীর সব মহিলা তাদের স্বামীর সম্বন্ধে সব জানে। ( মহিলাদের বিশ্বাসে আঘাত করা ভীষণ অপছন্দ করি???)
তোমার চোখেতো এখন সকলই থুড়ি only বিমল আমাদের মিষ্টি বৌদি। ?
ঠিকই তো। তবে অনলি ভিমল তো এখন আর সেভাবে অ্যাডে নেই….???????.
দিন দিন আপনি কিন্তু আমার কাছে প্রিয় লেখক হয়েউঠছেন স্যার
অনেক ধন্যবাদ, অর্ঘ্য। ?
দারুণ হয়েছে স্যার…. আরও
নতুন গল্পের অপেক্ষায় রয়েছি।
গল্প নয়। সত্যি ঘটনায় একটু রঙ বুলিয়ে দেওয়া। এমনকি আমায় বন্দুক দেখিয়ে অপারেশনেে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সম্পাদকমশাই যদি চালিয়ে যেতে বলেন, সে গল্পও লিখবো। আসলে সবার জীবনই একেকটা আস্ত উপন্যাস- আর আমার জীবনটাতো আগাথা ক্রিস্টি মার্কা থ্রিলার!!! অনেক হাসির মাঝখানে বেশ কিছুটা কান্নাও লুকানো আছে।
খুব ভালো হয়েছে লেখাটা , সবার জীবনেই বিয়ে টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় তবে বিয়ের ভাবনায় আপনার এই সারল্য আমার খুবই ভালো লেগেছে, আমার মনে হয় ম্যাডাম জানলে আনন্দই পাবে, সবার মতো আমিও অপেক্ষায় থাকলাম বাকি গল্পের জন্য মানে বিয়ের পর বিপদ কাটলো কিনা তার জন্য ।
বিয়ের পরে কোনও পুরুষমানুষের বিপদ কাটে না………….
????
ভগবান যাঁকে দেন, চপ্পড় ফুঁড়েই দেন । ডাক্তারও আবার ওতো ভালো লেখেনও । লেখাটা বন্ধ করবেন না প্লীজ ।
ধন্যবাদ ভাই ???
কি সুন্দর মজা করে লেখেন আপনি
অনেক ধন্যবাদ শাশ্বত। ??
Beautiful lekha Anirbaner Dustu – Misti Galpo . Bouma muchki muchki hashe aar garbito hoi nischoi.
Like!! I blog frequently and I really thank you for your content. The article has truly peaked my interest.
A big thank you for your article.
বলার ভাষা নেই । হাসির ছলে কি সুন্দর লিখেছেন। আপনার জীবনে এই সামান্য অংশ টা জেনে খুব ভালো লাগল ????