[ন্যায়সঙ্গত অধিকারের দাবিতে পরিচালিত, জনসাধারণের প্রতিটি বিশেষ আন্দোলনই তার সফলতা ও বিফলতা, উভয়ের মধ্য-দিয়েই এমন কতগুলি সাধারণ শিক্ষা বহন করে আনে যার উপযোগিতা শুধু সেই বিশেষ আন্দোলনটিতেই সীমাবদ্ধ নয়, যা সমস্ত আন্দোলনের ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য। প্রকৃতি সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে গবেষণাগারের যে ভূমিকা, সমাজ সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে আন্দোলনগুলির ভূমিকা ঠিক তাই। গবেষণাগারে জানার পদ্ধতি হল, বিভিন্ন সজীব বা নির্জীব পদার্থের পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে তার থেকে পাওয়া তথ্যগুলিকে বিশ্লেষণ করা। আন্দোলন চলার সময় আন্দোলনকারীরা তাঁদের সামাজিক পরিবেশের সাথে (যার মধ্যে রয়েছেন তাঁরা নিজেরা, তাঁদের শত্রুপক্ষ, তাঁদের যাঁরা বন্ধু হতে পারেন অর্থাৎ ব্যাপক জনসাধারণ ইত্যাদি) তীব্র ক্রিয়া প্রক্রিয়ার মধ্যে আসার ফলে তাঁদের চিন্তার জগতে যে আলোড়ন ওঠে সেটা সমাজ সম্পর্কে (অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে, শত্রু সম্পর্কে ও বন্ধু সম্পর্কে) এমন অনেক কিছু প্রত্যক্ষভাবে শেখার যেটা অন্য পরিস্থিতিতে সম্ভব হত না। আন্দোলনের অভিজ্ঞতালব্ধ এই শিক্ষাগুলির যদি সঠিক সারসংকলন করা যায়, তবে তার সেই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ পরিধির বাইরের ও ব্যপক মানুষের উপকারে লাগতে পারে। আন্দোলনকারীদের ও ভবিষ্যত আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে তা মূল্যবান দিক নির্দেশক হিসাবে কাজ করতে পারে।
নীচের রচনাটিতে ডাক্তার ও ডাক্তারী ছাত্রদের সাম্প্রতিক (নভঃ-ডিসেঃ ৭৩) আন্দোলনটির এ ধরনের একটি বিশ্লেষণের চেষ্টা হয়েছে। আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী জনৈক ছাত্র, রচনাটি আমাদের দপ্তরে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন। আমরা এই বিশ্লেষণ সম্পর্কে সমস্ত ধরণের মতামতের জন্য সাদর আহ্বান রাখছি। অন্যান্য জায়গায় যে সব যুব ছাত্র আন্দোলন চলছে সেগুলির বিবরণ ও বিশ্লেষণ পাঠান’র জন্যও অনুরোধ করছি—সম্পাদক মন্ডলী, বীক্ষণ]
পটভুমি
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ-এর সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রকৃত অবস্থা হল—চিকিৎসা করার পক্ষে এগুলো অত্যন্ত অনুপযুক্ত। রোগ নির্ণয়ের উপযুক্ত যন্ত্রপাতি এবং ওষুধপত্রের অভাব এই হাসপাতাল গুলিতে আজ অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। এক্স-রে, ই. সি. জি. ইত্যাদি করার যন্ত্রপাতির সংখ্যা নিত্যান্তই কম এবং রোজ মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য সেগুলি চালু থাকে। অথচ হাসপাতালে যাঁরা দেখাতে আসেন তাঁদের অধিকাংশেরই বাইরে থেকে এক্স-রে, ই. সি. জি. ইত্যাদি করিয়ে নেওয়া তো দূরের কথা, ওষুধ কিনে খাওয়ার মত আর্থিক সঙ্গতিও থাকে না। ফলে তাদের অপেক্ষা করে থাকতে হয় দিনের পর দিন, রোগের অবস্থা যাই হোক না কেন।
ব্লাড ব্যাঙ্ক-এর কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় জরুরী অনেক অপারেশনও বহু ক্ষেত্রে স্থগিত রাখতে হয় শুধু মাত্র রক্তের অভাবে। ফলে বলাই বাহুল্য মুমূর্ষু রোগীর অবস্থা হয়ে ওঠে অত্যন্ত ভয়ানক—অনেকে মারাও যান।
অন্যান্য বিভাগের অবস্থাও তথৈবচ। প্রয়োজনীয় ওষুধের বেশিরভাগই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। অথচ ছাত্রাবস্থায় ডাক্তারদের পড়তে হয় অনেক কিছু, অনেক টাকা খরচ করে, অনেক বছর ধরে রোগ নির্ণয় করার অনেক আধুনিক যত্রপাতির কলকব্জা সম্বন্ধে ভাতাপ্রাপ্ত ডাক্তার ও ডাক্তারী ছাত্রদের ওয়াকিবহাল হতে হয় তাঁদের। অনেক ভালো ভালো আর নামী দামী ওষুধের নামও তখন তাদের মুখস্থ থাকে। কিন্তু পুরোপুরি হাসপাতাল জীবন শুরু করার পর ওগুলো তাদের ভুলে যেতে হয়। কারণ সামনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার রোগী যাঁদের দেখতে হবে শুধু মাত্র স্টেথোস্কোপ দিয়ে, চোখ কান বুজে সেই ওষুধই দিতে হবে যা হাসপাতালে আছে। অপারেশন টেবিলে রোগী মারা যাবে, রক্তের অভাবে,যন্ত্রপাতির অভাবে। এহেন অবস্থায়, ছাত্রাবস্থায় শেখা সেই সব ভালো ভালো ওষুধ আর রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোকে মনে জায়গা দিয়ে ব্যঙ্গ করতে দেওয়ার চাইতে, ভুলে যাওয়াই তো শ্রেয়।
অথচ, আগেই বলেছি, তাঁদের কাছে অর্থাৎ এই হাসপাতালগুলিতে যাঁরা রোগ দেখাতে আসেন তাঁদের অধিকাংশই আমাদের সমাজের সেই বৃহত্তম অংশের মানুষ, ওষুধ কিনে খাওয়া তো দুরের কথা, দুবেলা পেট ভরে খাবার মত আর্থিক সঙ্গতিও যাঁদের নেই। ফলে হাসপাতালে এসে তাঁরা ওষুধ একটা পান বটে, কিন্তু রোগ তাঁদের সারে না। হাসপাতাল সম্পর্কে আস্থাহীন হয়ে পড়েন তাঁরা। হতাশা তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ‘ভূত, প্রেত, অপদেবতা’ আর মন্দির, মসজিদ, এবং ওঝা মাদুলি ইত্যাদি কুসংস্কারের জগতে। ডাক্তার আর রোগী পারস্পরিক সম্পর্ক (যা ভালো না হলে রোগ সারা সম্ভাবনা থাকে না) তিক্ত হয়ে ওঠে। একে অন্যের থেকে দূরে সরে যান।
ছাত্রাবস্থা শেষ হওয়ার পর চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত জীবন ও আর্থিকভাবে অত্যন্ত অসচ্ছলতার মধ্যে কাটে। মাসিক ভাতা হিসাবে তাঁরা যা পান, বর্তমান দ্রব্য মূল্যের হিসাবে, তা নিতান্তই কম। থাকার কোন সুব্যবস্থা নেই। আর ছুটি বলতে আছে বছরে সাকুল্যে ৩৫ দিন।
আন্দোলনের বিকাশ ও পরিণতির বিবরণ
হাসপাতালগুলির এই অব্যবস্থার প্রতিকারের জন্যই সরকারের কাছে এর আগে বহুবার আবেদন নিবেদন করা হয়েছে। বহুবার তাঁরা “আশ্বাস”ও দিয়েছেন। কিন্তু একবারো তা কার্যে পরিণত হয়নি। ক্রমশঃ হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেই এটা উপলদ্ধি করতে পারেন যে, একমাত্র সম্মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কর্তৃপক্ষের (সরকার) কাছ থেকে তাঁদের ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়াগুলি পাওয়া যেতে পারে। পশ্চিমবাংলার সমস্ত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হাউসস্টাফদের প্রতিনিধি ও ছাত্র প্রতিনিধিদের (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁরা হলেন ছাত্রসংসদ্গুলির সম্পাদক, সভাপতি ইত্যাদি) নিয়ে গঠিত হয় ‘কেন্দ্রীয় সংগ্রাম সমিতি’ (সংক্ষেপে—সি. এ. সি.)।
গত ১৪ নভেম্বর (১৯৭৩) সি. এ. সি.-র মাধ্যমে ছয় দফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়। দাবিগুলি হলঃ—
ভাতা-বৃদ্ধিঃ- ইনটার্নী, জুনিয়র ও সিনিয়র হাউসস্টাফরা মাসিক ভাতা হিসাবে পান যথাক্রমে ১৯৩ টাকা, ২৫০ টাকা ও ৩০০টাকা। এই ভাতা যথাক্রমে মাসিক ৩৫০ টাকা ৫০০টাকা ও ৫৫০টাকা করতে হবে।
বসবাসের সুবন্দোবস্তঃ- ইনটার্নীদের নির্দিষ্ট কোন থাকার ব্যবস্থা নেই, হাউসস্টাফদের জন্য যে ব্যবস্থা আছে তা অত্যন্ত অপর্যাপ্ত এবং অস্বাস্থ্যকর। প্রত্যেক হাউসস্টাফ ও ইনটার্নীর বসবাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
নিরাপত্তাঃ- বর্তমান অবস্থায় নিরাপত্তা বলতে বোঝায় প্রধানতঃ দুটো জিনিষ।
১. হাসপাতালের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন। যার মধ্যে পড়ে ২৪ ঘন্টার জন্য এক্স-রে মেশিন, ই. সি. জি. মেশিন, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ ও ব্লাড ব্যাঙ্ক চালু করা।
২. হাসপাতালের ভেতর উপযুক্ত পুলিশী ব্যবস্থা।
ছুটিঃ- ভাতাপ্রাপ্ত ডাক্তারদের সারা বছরে ২৩ দিনের ‘আর্ন লিভ’ ও ১২ দিনের ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ ছাড়া আর কোন ছুটি নেই। এক্ষেত্রে দাবি হল সপ্তাহে অন্ততঃ ১ দিন ছুটি দিতে হবে।
উন্নততর টেলিফোন ব্যবস্থাঃ- জরুরী প্রয়োজনে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে টেলিফোন-যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্মারকলিপিতে এও জানানো হয় যে, ২১ দিনের মধ্যে দাবি মানা না হলে তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হবেন।
স্মারকলিপি পেশ করার ১৫ দিন পর অর্থাৎ ৩০ শে নভেম্বর সকাল দশটায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আহ্বানে ‘সি. এ. সি’.র সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে একটি আলোচনায় বসেন। আলোচনায় ভাতাবৃদ্ধির দাবি সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানানঃ Unbudgeted liability” (বাজেট বহির্ভুত দায়)। অন্যান্য দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁকে জানাতে, যাতে—অর্থদপ্তরকে না জড়িয়েই যদি কোন ব্যবস্থা করা যায় (“…..if any local arrangement is possible without involving finance”)। তিনি এও জানালেন যে পরবর্তী কেবিনেট মিটিং-এ দাবিগুলি তিনি উত্থাপন করবেন, এবং পরবর্তী কেবিনেট মিটিং-এর তারিখ ১৪ই ডিসেম্বর (অর্থাৎ ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে) স্থির হয়ে আছে। জরুরী কোন কেবিনেট মিটিং ডাকা যায় কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি জানানঃ জরুরী কেবিনেট মিটিং কেবল মাত্র জরুরী প্রয়োজনেই ডাকা যায় (“…যেমন কোন বড় ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করতে হলে”)। এই দাবিগুলি তেমন জরুরী নয় যার জন্য জরুরী কেবিনেট মিটিং ডাকা যেতে পারে। সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে এই নিষ্ফল আলোচনার পর তিনি জানান যে, নীতিগতভাবে তিনি নিজেও এই দাবিগুলি সমর্থন করেন এবং সেগুলি পূরণ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এই আলোচনার কথা সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তারদের জানানো হয় এবং এই সময় থেকেই তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে সংগ্রামে অংশ নিতে শুরু করেন।
একুশ দিনের দিন অর্থাৎ ৪ঠা ডিসেম্বর একটি চিঠিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সি. এ. সি.-র সদস্যদের আরেকবার আলোচনায় বসার জন্য ডাকেন। সি. এ. সি.-র তরফ থেকে জানানো হয় যে, ৫ই ডিসেম্বর সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তারদের নিয়ে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ থেকে মিছিল করে, তাঁরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন।
ঐদিনই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আবার একটা চিঠি আসে (পত্রবাহকঃ বহুবাজার থানার ও. সি. এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের জনৈক অফিসার) যার সারমর্ম হ’লঃ মিছিল করার ব্যপারটা তিনি স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে জানিয়েছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী চান না এরকম কোন মিছিল বার হোক (কারণ মহানগরীর তৎকালীন অবস্থা) অবশ্য পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় তিনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) সি. এ. সি.-র সদস্যদের তাঁর সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হতে বলেন।
পরদিন সকালের এই বৈঠকে তিনি জানান ভাতা-বৃদ্ধি ছাড়া অন্যান্য দাবিগুলি মেনে নেওয়া হয়েছে (কখন? কোথায়?) এবং সেই দিনই বেলা বারোটায় ভাতা-বৃদ্ধির ব্যপারে একটা জরুরী কেবিনেট মিটিং ডাকা হয়েছে (যদিও তিনি বলেছিলেন এ ব্যপারে জরুরী কেবিনেট মিটিং ডাকা সম্ভব নয়)। কেবিনেটের সিদ্ধান্ত জানার জন্য সি. এ. সি.-র সদস্যদের তিনি বেলা ৪-৩০ টায় তাঁর সাথে দেখা করতে বলেন।
বেলা দুটো। পুর্বা নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ছাত্র, ইনটার্নী ও হাউসস্টাফরা মিছিল করার জন্য নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে জড়ো হচ্ছেন এমন সময় পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে এই মর্মে একটা চিঠি পাওয়া গেলঃ মিছিলের উদ্দ্যেশ্যে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে জমায়েত নিষিদ্ধ করা হল (Assembly inside N R S Hospital for the purpose of procession is prohibited under section 62 (4) of Calcutta Police Act & 39 (4) of Calcutta Suburban Police Act)। উপস্থিত ছাত্র ও ডাক্তাররা আলোচনার পর ঠিক করলেন “আইন” ভেঙ্গে মিছিল তাঁরা করবেন না।
বিকাল ৪-৩০ টায় কেবিনেট মিটিং-এর সিদ্ধান্ত জানা গেলঃ স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটা কমিশন গঠন করবেন যার সভাপতি হবেন ডা; অজিত কুমার বসু; অন্য দুজন সদস্য হবেন—ডাঃ কে. সি. বসুমল্লিক (Director of Health Service) এবং অর্থদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি। এই কমিশন ভাতা-বৃদ্ধি সম্পর্কিত দাবিটিকে অনুসন্ধান করে দেখবেন। কমিশনের রায় তিন মাসের আগে জানা সম্ভব হবে না। এই রায় অনুমোদন বা খারিজ করার পুর্ণ অধিকার সরকারের থাকবে।
সন্ধ্যা ৬টা। কলকাতা মেডিকেল কলেজে আহুত ছাত্র ও ডাক্তারদের একটি সাধারণ সভায় কেবিনেট সিদ্ধান্ত সকলের বিবেচনার জন্য পেশ করা হল। “আইন” দিয়ে মিছিল নিষিদ্ধ করার ঘটানায় ইতিমধ্যেই তাঁরা ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। কেবিনেটের এই সিদ্ধান্ত শোনার সাথে সাথেই সেই ক্ষোভ বিক্ষোভের আকারে ফেটে পড়ে এবং ঘৃণার সঙ্গে তাঁরা তা প্রত্যাখান করেন।
পরদিন অর্থাৎ ৬ই ডিসেম্বর মিছিল বার করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে সমস্ত মেডিকেল কলেজে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। হাউসস্টাফ এবং ইনটার্নীরাও হাসপাতালের বহির্বিভাগে সকাল ৮-৩০ মিঃ থেকে ১০ টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেন। অবশ্য ১০ টার পর থেকে অতিরিক্ত কাজ করে বহির্বিভাগের সমস্ত রোগীকেই তাঁরা দেখে দেন।
দলমত নির্বিশেষে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আওয়াজ উঠে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের এই ডাক সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বেশীর ভাগ অংশকেও, এ পর্যন্ত আন্দোলন সম্পর্কে সঠিক খবরাখবর যাঁরা রাখতেন না আর রাখলেও অত্যন্ত নিস্পৃহ ছিলেন, স্পর্শ করে। সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে শুরু করেন তাঁরা। ৭ই ডিসেম্বর সমস্ত মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও ডাক্তাররা সামিল হন বিশাল এক মিছিলে ( কলকাতা রাজপথে এর চাইতে অনেক বড় মিছিল অহরহ চোখে পড়লেও, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মেডিকেল কলেজগুলির এই রকম সম্মিলিত মিছিল সম্ভবতঃ এর আগে হয়নি)। শ্লোগান উঠেঃ ‘জন সাধারণ, ডাক্তার, ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ’; “রোগীদের স্বার্থে ডাক্তাররা লড়ছে লড়বে”;। ……অনভিজ্ঞ আর সংকোচে ভরা কন্ঠস্বরগুলি ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণতা লাভ করে…’ডাক্তাররা পথে কেন, সরকার তুমি জবাব দাও’ ….আরও দৃড় আরও শাণিত হয়ে উঠতে থাকে মিলিত কন্ঠে।
ভাতা প্রাপ্ত ডাক্তার ও ডাক্তারী-ছাত্রদের সাম্প্রতিক আন্দোলন আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফের নবলদ্ধ বিশ্বাস ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই—লড়াই করে বাঁচতে চাই’।
এসপ্লানেড ইস্ট সারবদ্ধ পুলিশ বেষ্ঠনী যথারীতি মিছিলের গতিরোধ করে। লাঠির ঘায়ে আহত হন কিছু ডাক্তার ও ছাত্র। সবাই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সি. এ. সি. তখনই ঘোষণা করেনঃ দাবি না মেটা পর্যন্ত তাঁরা হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে কাজ কর্ম বন্ধ করে দেবেন। তবে জনসাধারনের স্বার্থের কথা ভেবেই ‘এমার্জেন্সী’ ও প্রসূতি বিভাগের কাজকর্ম যথারীতি চালিয়ে যাবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হলে তিনি জানান, বি. এম.এস.-এর কর্মীদের দিয়ে তিনি হাসপাতাল চালাবেন।
৮ই ডিসেম্বর পুলিশের লাঠি চার্জের প্রতিবাদে মেডিকেল কলেজগুলিতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। বেলা ১০ টা থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে সি. এ. সি.-র অফিসের সামনে ছাত্র ও ডাক্তাররা ৪৮ ঘন্টার অনশন ও অবস্থান শুরু করেন। কর্মবিরতির পাশাপাশি অন্তর্বিভাগে সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকটি হাসপাতালে একটি করে এমার্জেন্সী মেডিকেল স্কোয়াড গঠন করা হয়।
৯ই ডিসেম্বর অর্থাৎ কর্মবিরতির তৃতীয় দিন, সরকার তাঁর প্রচার যন্ত্রের মাধ্যমে এই আন্দোলন “জনস্বার্থ-বিরোধী”, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত” ইত্যাদি প্রচার শুরু করেন। অন্যদিকে, ছাত্র ও ডাক্তাররাও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মহানগরীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, পথসভার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে আন্দোলনের স্বপক্ষে প্রচার চালাতে থাকেন।
সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয় কমিশনের রায় দেওয়ার সময় কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে—কমিশন তার রায় ২৬শে জানুয়ারীর মধ্যে পেশ করবে। মুখ্যমন্ত্রী সি. এ. সি. কে তাঁর এই ফর্মূলা মেনে নিয়ে আন্দোলন তুলে নিতে “অনুরোধ” করেন।
১০ই ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদের সভায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও ডাক্তারের উপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর ফর্মুলাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা হয়। সভায় জানা যায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক বৈঠকে সি. এ. সির হাতে ৪০০০০ টাকা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কেন এবং কাদের দেওয়া হচ্ছে জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এটাকে ‘অন্তরবর্তীকালীন সাহায্য’ বলে জানান এবং নিজেদের মধ্যে।(সি. এ. সি.-এর সদস্যদের মধ্যে…?) তা ভাগাভাগি করে নিতে বলেন। হিসেব করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেখান হয় যে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত হাউসস্টাফের ভাগে ১৯ টাকা করে পড়ে—স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন এটাকে দুঃস্থ হাউসস্টাফদের মধ্যে ভাগ করে নিতে বলেন। সি. এ. সি.-র সদস্যরা এটাকে ঘুষ বলে মনে করেন এবং প্রত্যাখান করেন।
ছাত্র ও ডাক্তারদের পথসভা চলতে থাকে। আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশান’, ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ব্লক’ ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি’। আন্দোলন ক্রমশঃ আরও তীব্রতা লাভ করতে থাকে।
১১ই ডিসেম্বরঃ—সি. এ. সি.-র তরফ থেকে সরকারকে এই মর্মে একটি চরমপত্র দেওয়া হয়ঃ দাবি না মিটলে ১১ তারিখ সন্ধ্যে ৬ টা থেকে ৩৬ ঘন্টার পর “এমার্জেন্সী” ও প্রসূতি বিভাগ বয়কট করা হবে।
সাধারণ পরিষদের সভায় ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন ও বি. এম. এস. এসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা তাঁদের নিঃশর্ত সমর্থন জানালেন।
সরকার একদিকে দাবিদাওয়া নিয়ে মেছোবাজারের মত দর কষাকষি শুরু করলেন ও অন্যদিকে “কঠোর” হওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। “দান”-এর টাকাটা ৪০০০০ থেকে বাড়িয়ে ৫৬৮৫০ করা হয়। “বাসু কমিশন –এর মেয়াদ কমিয়ে ১২ই জানুয়ারীতে দাঁড় করানো হয় আর এই শর্ত মেনে না নিলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ‘The law will take its own course—আইন তার নিজস্ব পথেই চ’লবে’ (অর্থাৎ চালানো হবে !)। সাথে সাথে সি. এ.সি.-র সদস্যদের তিনি নিজেদের ‘কেরিয়ার’ সম্পর্কেও চিন্তা করতে বলেন এবং খুব পরিস্কার ভাষায় বলেন, “মহারাষ্ট্রে যে ভুল হয়েছে, এখানে সে ভুল করা হবে না। এখানে পুলিশ দিয়ে আন্দোলন ভাঙ্গা হবে না, জনসাধারণকে দিয়ে আন্দোলন ভেঙ্গে দেওয়া হবে।“ (অর্থাৎ গুন্ডা বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হবে)।
১২ই ডিসেম্বরঃ- ছাত্র ও ডাক্তাররা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই হুমকিকে অস্বীকার করে আন্দোলন চালিয়ে যান। সংকটাপন্ন রোগীদের কথা ভেবে “এমারজেন্সী স্কোয়াড” আরও ২৪ ঘন্টা চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয় এবং রোগীদের সাহায্যার্থে পথ-চিকিৎসালয় খোলা শুরু হয়ে যায়। ছাত্র ও ডাক্তাররা “বাঁচাবার …বাঁচবার…” ব্যাজ এঁটে দলে দলে ওষুধ সংগ্রহ অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। রাত জেগে রোগী দেখার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরাও ইস্তেহারের মাধ্যমে আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান আর সরকারের আচরণের তীব্র নিন্দা করেন, সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন প্রচুর ওষুধপত্র নিয়ে; এগিয়ে আসেন সাধারণ মানুষেরা, টাকা পয়সা আর অন্যান্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে,
ওয়েষ্ট বেঙ্গল নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন, এস. এফ. আই., পি. এস. ইউ., ডি. এস.ও., এস. বি, এফ. আর এস. এস. ও ফেডারেশন অব এসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ান এন্ড টেকনিকাল অফিসার্স, রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটি এন্ড আরও অনেক গণসংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান হয়।
“সরকারের নির্মমতা ও চরম উদাসীন মনোভাবের জন্য রোগীরা কষ্ট পান, আমরা তা চাই না। তাই এমার্জেন্সী স্কোয়াড আগামীকাল (শুক্রবার) সকাল ৬টার পরেও চালু থাকবে। যে মুহুর্তে প্রাইভেট নার্সিং হোম ও ওয়ে-সাইড ক্লিনিকের ব্যবস্থা শেষ হবে, এমার্জেন্সী স্কোয়াড সেই মুহুর্তে প্রত্যাহার করা হবে”—জানান সি. এ. সি।
ঐ দিনই সমস্ত কলেজের পাশে পথ-চিকিতসা কেন্দ্র চালু হয়।
১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক সংস্থা ও সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো হয়।
১৫ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ঃ ১৭ই ডিসেম্বর থেকে প্রসূতি বিভাগ ও এমার্জেন্সী বয়কট করা হবে।
১৭ই ডিসেম্বরঃ- সকাল ৬টা থেকে প্রসূতি বিভাগ আর এমার্জেন্সী বয়কট করা হয় এবং পথ-চিকিৎসা কেন্দ্র একটি জরুরী বিভাগ খোলা হয়। কাছাকাছি নার্সিং হোম ও ছাত্রাবাসে সংকটাপন্ন রোগীদের শয্যার ব্যবস্থা করা হয়। অনেক ছাত্র ও ডাক্তাররা জরুরী বিভাগের জন্য রক্ত দান করতে এগিয়ে আসেন ওই দিনই পথ-চিকৎসাকেন্দ্রে রোগীর ভীড় হয় সবচেয়ে বেশি।
রাত ৯ টা হঠাৎ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সি. এ. সি.-কে আলোচনায় ডাকলেন। আর সাথে সাথেই, সদস্যদের মধ্যে যাঁদের পাওয়া গেল, তাঁদের নিয়ে সি. এ. সি. স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে গেলেন (প্রসঙ্গতঃ একজন সি. এ. সি. সদস্য অসুস্থ ছিলেন আর অন্য দুজনকে, কেন জানি না, খবর দিয়ে নাকি পাওয়া যায়নি)। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘরে, মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে রহস্যাবৃত এক আলোচনাসভা বসলো। আর সেখান থেকে বেরিয়ে এসেই সি. এস. সি. সম্পুর্ণ অপ্রত্যাশিত এক ঘোষণা করে বসলেনঃ “ দাবি মিটে গেছে”, কাজেই “আন্দোলন তুলে নেওয়া হল।
সবাই কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন। খোঁজখবর করতেই জানা গেল ইন্টার্নী, জুনিয়ার হাউসস্টাফ ও সিনিয়ার হাউসস্টাফ যথাক্রমে মাসিক ভাতা পাবেন ২৭৫, ৪০০ ও ৪৫০ টাকা (প্রসঙ্গতঃ দাবি ছিল যথাক্রমে ৩৫০, ৫০০, ৫৫০ টাকা)। আর অন্যান্য দাবিগুলি সম্পর্কে “মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বলেছেন সহানুভূতির সঙ্গেই সেগুলি বিবেচনা করা হবে।
“কেবল ‘সহানুভূতি’,‘বিবেচনা’ আর ‘আশ্বাস’?”–ঘৃণা আর ক্ষোভে ফেটে পড়লেন সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তাররা।–কোথায় গেলো সেই বাঁচাবার দাবিগুলো? ২৭৫, ৪০০, আর ৪৫০ টাকাই যদি যথেষ্ট হয়ে থাকে, তবে তো বেশি চেয়ে অন্যায়ই করা হয়েছিল? আর সাধারণ সভার মতামত না নিয়ে একক ভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সি. এ. সি.-কে কে দিয়েছে?
সি. এ. সি.-কে জবাব দিতে হবে। পর দিন বিকেলেই সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তাররা নিজেদের উদ্যোগে কলকাতা মেডিকেল কলেজে একটি সাধারণসভার আয়োজন করলেন। কিন্তু অধিকাংশ সি. এ. সি. সদস্যই এতে উপস্থিত ছিলেন না সম্ভবত সাধারণ সভার মুখোমুখি দাঁড়াবার মতো সাহসের অভাব ঘটেছিল তাঁদের যে দু-একজন উপস্থিত হলেন তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, তা হলঃ
রহস্যজনক সেই সভায়, সি. এ. সি. রই কিছু সদস্য সি. এ. সি. র উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন—সরকারি শর্ত মেনে নেওয়ার জন্য। অন্যরা বিরোধিতা করায় তাঁরা বলেছিলেন যে সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তারদের বোঝানোর (?) দায়িত্ব তাঁরা নিচ্ছেন। চুড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য অবশেষে ভোটের প্রস্তাবও রাখেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রীর পাশের ঘরে ভোটের ব্যবস্থা হয়।আর সরকারি শর্তের স্বপক্ষেই ভোটের ফলাফলের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরী হয়, বুকে ‘রেডক্রস’ আঁটা “স্বেচ্ছাসেবকে”র (অর্থাৎ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর “জনতার”) মজুত বাহিনীকে দিয়ে। ফলাফলঃ শর্তের স্বপক্ষে ৯ আর বিপক্ষে ৩। যুগ্ম আহ্বায়কদ্বয় ভোটদানে বিরত ছিলেন।আর বলাই বাহুল্য এই ফলাফলের ভিত্তিতেই ঘটল বিরাট এক সম্ভাবনার লজ্জাজনক এই পরিসমাপ্তি।।
পর্যালোচনাঃ
কিন্তু পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো যে আন্দোলনের এই পরিণতি—তা যত করুণই হোক না কেনো এবং অংশগ্রহণকারীদের কাছে তা যত অপ্রত্যাশিতভাবেই আসুক না কেনো –আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া কোন কারণে হয়নি। এর জন্যে দায়ী কারণগুলি আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনের মধ্যে সুপ্ত ছিল। পর্যালোচনা করলে আমরা এও দেখতে পাবো যে পরিণতির দিক থেকে করুণ হলেও, বিকাশের গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই আন্দোলনের তার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেক ইতিবাচক অবদানও রেখে গেছে। এই পরিণতির জন্য দায়ী অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলির অনুসন্ধানের আগে এই ইতিবাচক অবদানগুলিকে নিয়েই আলোচনা করা যাক ।
ভাতাপ্রাপ্ত ডাক্তার ও ডাক্তারী ছাত্রদের সাম্প্রতিক আন্দোলন এই আন্দোলনের ইতিবাচক অবদানগুলি হলঃ
১) আমাদের দেশের অন্যান্য পেশাভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মত, মেডিকেল কলেজগুলিতেও কর্তৃপক্ষেরই হাতে তৈরী এবং সযত্নে সংরক্ষিত এমন একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ আছে যা ছাত্রছাত্রীদের সৎ এবং সুস্থ মানবিক গুণগুলির বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে, অসুস্থ ও বিকৃত মূল্যবোধের জোয়ারে তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অসচেতন ভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীই এর শিকার হ’ন; তাঁদের সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি হারিয়ে যায়। গড়ে ওঠে ভিত্তিহীন অহমিকা ও ঘৃণ্য স্বার্থপরতার একটি কলুষিত পরিবেশ, পরবর্তীকালে যা গোটা চিকিৎসক সমাজকে সাধারণ মানুষদের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। চিকিৎসক তাঁর সামাজিক কর্তব্যকে ভুলে যান, ডাক্তার ও রোগীর পারস্পরিক সম্পর্ক একটা তিক্ত চেহেরা নেয়।
ডাক্তার ও ডাক্তারী-ছাত্রদের সাম্প্রতিক এই আন্দোলন এই কলুষিত পরিবেশের প্রতি সরাসরি আঘাত হেনেছে। নিজেদের ও রোগীদের স্বার্থে এই আন্দোলনে সামিল হবার পর ডাক্তার ও ছাত্রদের এক বিরাট অংশ উপলব্ধি করেন—ব্যপক জনসাধারণের সমর্থন ছাড়া এ আন্দোলন এক পাও এগোতে পারে না। সি. এ. সি.র পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রচারপত্রগুলির (‘বীক্ষণ’, নবম সংকলন দ্রষ্টব্য) সবকটিই তাঁদের এই নবলদ্ধ উপলদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে। এই উপলদ্ধির তাঁদের পথে নামিয়েছিল, বিভিন্ন পথসভার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন তাঁরা। গড়ে উঠতে শুরু করে ডাকাতার ও রোগীর মধ্যে একটা নতুন সম্পর্ক, অদ্ভূত ঐক্য।
একসাথে কাজ করার মধ্য দিয়ে, শুধুমাত্র নিজেদের কলেজের মধ্যেই নয়, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তাররা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মেডিকেল কলেজগুলিতে বর্তমান স্বার্থপরতা ও হীন প্রতিযোগিতার কলুষিত পরিবেশের পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যের একটা নির্মল পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন।
২) এ আন্দোলন বিশেষ কোন রাজনৈতিক মত বা গোষ্টীর অনুগামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সমস্ত দল ও মতের ছাত্র ও ডাক্তাররাই এতে সামিল হয়েছিলেন। পশ্চিমবাংলার ছাত্র আন্দোলনে আজ সেখানে দল ও মতের প্রশ্নটির এত প্রাধান্য এবং যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে ছাত্রসমাজ আজ পারস্পরিক হানাহানি ও কলহের শিকার—সেখানে ডাক্তার ও ডাক্তারী ছাত্রদের আন্দোলনে ঐক্যের উপরোক্ত চেহারাটা নিঃসন্দেহে ছাত্র সমাজের সামনে একটা আদর্শ উদাহরণ স্বরূপ।
৩) দাবি ন্যায় সঙ্গত হওয়াটাই যে তা পূরণ হওয়ার যথেষ্ট শর্ত নয়, সংগ্রামই তা পূরণ হওয়ার একমাত্র শর্ত—এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে অংশগ্রহণকারীরা এটা উপলদ্ধি করেছে। একটা করে দিন গেছে আর একটু করে এই উপলদ্ধি তাদের মনের গভীরে শেকড় গড়েছে, লড়াই মনভাব হয়ে উঠেছে আরও আপসহীনঃ “Our demand are just, we hate consideration “
কিন্তু এত সম্ভাবনা, এত ইতিবাচক দিকের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত লজ্জাজনক পরিণতি লাভ করলো, তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, নেতৃত্বের একাংশের বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রয়োজনীয় মুহুর্তে অন্য অংশের দৃঢ়তার অভাব।
সি. এ. সি. যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তাদের কেউই সংগ্রামের কষ্ঠি পাথরে যাচাই হয়ে যাননি। কি ছাত্র, কি ডাক্তার, প্রায় সবক্ষেত্রেই এরা ছিলেন মনোনীত ব্যক্তি (নির্বাচিত নয়)। আর এই মনোনয়নও কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসারে হয়নি। ফলে একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে নেতৃত্বের ভূমিকায় এমন অনেক অবাঞ্ছিত ব্যক্তির প্রবেশ ঘটেছিল, প্রতি পদক্ষেপে যারা ভেতর থেকে আন্দোলনকে দুর্বল করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যে সব কলেজ থেকে মূলত এই ধরনের ব্যক্তিরাই সি. এ. সি.তে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, সেই সব কলেজগুলিতে সাধারণ ছত্র ও ডাক্তারদের আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনার ব্যপারে ঐ নেতৃত্বের কোন ভূমিকা ছিল না। গোড়ার দিকে নেতৃত্ব সেখানে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়ই ছিলেন। এমনকি সেক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তাররা যখন তাদের নিজেদের উদ্যোগেই এগিয়ে এলেন তখনও ছাত্র ও ডাক্তারদের পরিচালিত করার ব্যপারে এই সব সদস্যদের ভূমিকা ছিল একই রকম।
আর অপর অংশটি চরিত্রে যথেষ্ট সততা থাকা সত্ত্বেও, বিপুল এই আন্দোলনকে তার সফল পরিণতির দিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ছিলেন না তারা। নিজেদের অনভিজ্ঞতার জন্যই তারা কখন শত্রুর শক্তিকে ছোট করে নিজেদের শক্তিকে বড় করে দেখেছেন আবার কখনো উল্টোটাই করেছে। আন্দোলনের গোড়া থেকে শত্রুকে ছোট করে দেখার ফলে—তাদের মধ্যেই শক্তি সমাবেশের মধ্যে দিয়ে শত্রু যে তাদের আন্দোলনকে ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করবে, এ ব্যপারে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না তাঁরা। আর শেষ পর্যন্ত যখন তারা এটা খেয়াল করলেন তখন শত্রুর শক্তিকে এতো বেশি বড় করে দেখতে লাগলেন যে সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তারদের শক্তির উপর তাঁদের আর আস্থা রইল না। ফলে সবচেয়ে সংকটময় মুহুর্তে, সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহুর্তে শত্রুর হুমকি আর ভীতি প্রদর্শন এর মুখে তাঁদের সমস্ত দৃঢ়তা সমস্ত মনোবল অমঘ নিয়োমেই যেন ভেঙ্গে পড়ল। “বাচাবার” এবং “বাঁচবার” দাবিতে সংগঠিত এই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত “বাঁচবার” দাবি আংশিকভাবে পুরণ হলেও “বাঁচাবার” দাবিগুলিকে শুধু মাত্র ভিত্তিহীন অস্পষ্ট “আশ্বাস” আর “বিবেচনা” অপর ছেড়ে দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহৃত হল। ফলে সাধারণের চোখে অবস্থাটা যা দাঁড়ালো তা অত্যান্ত দুঃখজনক—“বাঁচবার” দাবিগুলিকে পাওয়ার জন্যেই যেনো “বাঁচাবার” দাবিগুলিকে হাজির করা হয়েছিল—কর্তৃপক্ষ যা বার বার এ আন্দোলন সম্পর্কে প্রচার করেছে।
অবশ্যই নেতৃত্বের এই দুর্বলতাগুলি সাধারণ ভাবে মেডিকেল কলেজগুলির সাধারণ ছাত্র ও ডাক্তারদের পেছিয়ে থাকা চিন্তারই প্রতিফলন মাত্র। নেতৃত্বের মতন তাঁদেরও কোন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে তারা নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না। নেতৃত্বের ভূল পদক্ষেপগুলিকে দেখিয়ে দিয়ে সেগুলি দৃঢ়তার সঙ্গে সংশোধনের চেষ্টা বা নেতৃত্বের বিপথগামী অংশকে অপসারিত করে সফল বিকল্প নেতৃত্বের সৃষ্টি করতে সক্ষম হননি তাঁরা।
আন্দোলনের বর্তমান পরিণতির আরেকটি অবশ্যম্ভাবী কারণ, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজগুলির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, নার্স এবং সাধারণ কর্মচারীদের এই আন্দোলনের স্বপক্ষে টেনে আনতে পারা যায়নি। শেষের দিকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ভাবে এই প্রচেষ্টা শুরু হলে, মাঝ পথে আন্দোলনের এই পরিসমাপ্তির ফলে, কোনরকম নির্দিষ্ট চেহারা নেবার আগেই অঙ্কুরেই এই প্রচেষ্টায় ছেদ পড়ে।
কোন সামাজিক আন্দোলনই শেষ বিচারে পুরোপুরি ব্যর্থ হতে পারে না। পরিণতির দিক থেকে যতই লজ্জাজনক হো কনা কেন, সেই একই বিচারে ডাক্তার ও ডাক্তারী-ছাত্রদের সাম্প্রতিক আন্দোলন পুরোপুরি ব্যর্থ হতে পারে না। বর্তমান আন্দোলনে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন মেডিকেল কলেজের ডাক্তার ও ডাক্তারী-ছাত্ররা, আগামী দিনে আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে সেগুলিকে সফল্ভাবেই কাজে লাগাবেন তাঁরা- এবারে ভুলগুলির পুনরাবৃত্তি তখন আর হবে না। এ অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে সেই প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের জন্ম অবশ্যম্ভাবী ভাবেই দিতে পারবেন তাঁরা, যে নেতৃত্ব শত্রুর হুমকি, প্রলোভন আর ভীতি প্রদর্শনের মুখে আজকের মতো ভেঙ্গে পড়বে না। বাঁচার এবং বাঁচবার দাবি সেই দিনগুলিতে অবশ্যই সমান গুরুত্ব লাভ করবে।
ডা আশীষ কুমার কুন্ডুর এই রিপোর্টটি দিলীপ চৌধুরীর সহায়তায় রচিত।
বীক্ষণ পত্রিকার প্রথম বর্ষ দশম সঙ্কলনে ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত।