আরম্ভের আরম্ভ: ২০২৪ বছরটিতে ঘটতে চলেছে বেশ কয়েকটি দেশের নির্বাচন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত। আগামী মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের প্রাথমিক পর্বগুলিতে সিংহ বিক্রমে এগিয়ে চলেছেন প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যার শ্বেতাঙ্গ অতিজাতীয়তাবাদী, অগণতান্ত্রিক, নারী বিরোধী, যুদ্ধবাজ আচরণের জন্য কুখ্যাতি আছে। বিপুল ভোটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কুর্সি দখল করলেন বিরোধী নেতাদের মৃত্যুর দায়ে অভিযুক্ত ভ্লাদিমির পুতিন, ইউক্রেন সমরাভিযানের প্রধান উদ্গাত্ তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ।
ভারতীয় প্রতিষ্ঠিত মিডিয়,গুলি ঘোষণা করে দিয়েছে বিপুল ভোটে নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বারের জন্যে প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। তারপরও মোদীজী মণিপুর ও লাদাখে ঘটমান জাতি সংঘর্ষ ও দাবী দাওয়ার অনশনে না যেতে পারলেও নানা রং বেরঙের সাজে সেজে সারা দুনিয়া যেমন ঘুরে বেড়াতেন সেরকম এখন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, অরুণাচল থেকে গুজরাট চষে বেড়াচ্ছেন। কোথাও তিনি রামের অবতার, কোথাও কৃষ্ণর। তাঁর মুখে কেবল তাঁর পরিবার দেশবাসীর কথা, দেশের উন্নতির কথা, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার কথা, মহাকাশে ডানা বিস্তারের কথা। বিরোধী ‘ইণ্ডি’ জোট আর গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে আক্রমণের কথা। ধর্মীয় ও উগ্র জাতীয়তাবাদী কল্প কথা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সরকারি নোট বন্দী ও কভিড নীতির ফলে মানুষের দুর্দশা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, কৃষি সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সংকট বৃদ্ধি কিংবা কালো টাকার থলি দিয়ে নির্বাচিত বিরোধী সরকারগুলিকে ফেলে দেওয়া।
অথচ কি কর্মসংস্থানের নিরিখে, কি ডলার ইত্যাদির তুলনায় টাকার মূল্যে, কি যাবতীয় উন্নয়ন অর্থনীতি গণতন্ত্র পরিবেশ প্রতিটি সূচকে ভারত চূড়ান্ত ভাবে পেছিয়ে পড়েছে। দেশ জুড়ে স্বৈরতন্ত্রী দমন, পারস্পরিক ঘৃণা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন, নব জাতিভেদ, দলিত ও জনজাতি বিদ্বেষ, দাঙ্গা এবং আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কিছু স্যাঙাত দালাল – শিল্পপতির সাধারণের শ্রমের সরকারি ব্যাংকে রক্ষিত সাড়ে চোদ্দো লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ থেকে আম্বানি, আদানিদের সমস্ত দেশের ও দেশের মানুষের সম্পদ লুঠ করা থেকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে প্রায় তেরো হাজার কোটি টাকার তোলাবাজী কোনটারই কোন বিহিত না হলেও মোদীজীর এজেন্সি আর পুলিশ বিরোধী দলগুলির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দখল করে নিচ্ছে, বিরোধী নেতাদের বাড়িতে অন ক্যামেরা মুহুর্মুহু অভিযান চালাচ্ছে, বিরোধী নেতাদের এমনকি দুই বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীকে নির্বাচনের আগে গ্রেফতার করে জেলে রেখে দিয়েছে।
কিন্তু অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন থেকে সাংবাদিক সুমিত মিত্রের মতে মোদীজীর এটাই কৃতিত্ব যে আম আদমি থেকে বিদ্দ্বজনরা মোদীজীর রচিত কল্পকথা বিশ্বাস করছেন, কোথাও কোন জোরালো গণ আন্দোলন নেই। তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভোটও সব জায়গায় হয় শান্তিতে। বিরোধীরা কেউ কেউ ইভিএম কারচুপির কথা বললেও স্বয়ং রাহুল গান্ধী তা নাকচ করে দিয়েছেন। দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান দখল করে মোদীজী পুতুল নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নিজের সুবিধামত ভোটের দিনলিপি স্থির করেছেন। ভোটের আসল ফল কি হবে জানিনা, জেল ও টাকার থলির কৌশলে তিনি বিরোধীদের ছত্রখান করে তাঁর বর্ণিত স্বাধীনতার অমৃতকালে ২০৩৫ অবধি কি কি করবেন তার নির্ঘণ্টও ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে বিশ্ব গুরু সাজিয়েছেন।
আরম্ভ: ১৯৬৮-তে হরিয়ানায় জন্ম এক মধ্যবিত্ত সরকারি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের পুত্র অরবিন্দ কেজরিওয়াল পরীক্ষায় ভালো ফল করে আই আই টি খড়গপুর থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি টেক করে ১৯৮৯-তে টাটা স্টিল-এ যোগ দিলেন। সাধারণ মানুষের সমস্যা, বিপরীতে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি তাঁকে খুব ব্যথিত করতো। তিনি ১৯৯২ তে চাকরি ছেড়ে কিছুদিন মিশনারিজ অফ চ্যারিটি, রামকৃষ্ণ মিশন, নেহরু সেবা কেন্দ্রের হয়ে সমাজ সেবার কাজ শুরু করলেন। তারপর সর্ব ভারতীয় সিভিল সার্ভিস প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফল হয়ে ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে যোগ দিলেন দিল্লিতে আয়কর দফতরের সহকারী কমিশনার হিসেবে। সরকারি চাকরি করে এই দুর্নীতির দুর্লঙ্ঘ পাহাড়কে ভাঙ্গা সম্ভব নয়। তাই তিনি ২০০৬ সালে আয়কর দফতরের যুগ্ম কমিশনারের পদে ইস্তফা দিয়ে গণ প্রতিবাদ সংগঠনের উদ্দেশ্যে রাজপথে নেমে পড়লেন।
অগ্রগতি: ২০০৬ কেজরিওয়াল এর জীবনে অত্যন্ত ঘটনাবহুল বছর। ঐ বছরেই দিল্লির সুন্দর নগরের জলকষ্ট, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে দিল্লি সরকারের জলের উপর কর বসানোর চেষ্টা, রেশন সহ গণ বণ্টন ব্যবস্থায় (PDS) দুর্নীতি, বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতি, বিভিন্ন জন খাতে কাজের খতিয়ান (Audit), জানার অধিকার (RTI) প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একের পর এক গণ আন্দোলন, সত্যাগ্রহ, জনশুনানি, জনস্বার্থ মামলা (PIL) দায়ের করে তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার এবং দুর্নীতি বিরোধী নাগরিক আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। ঐ বছরেই পান রামন ম্যাগসাইসই পুরস্কার। প্রাক্তন সাংবাদিক সাথী মণীশ শিশোদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘পরিবর্তন’, ‘পাবলিক কজ রিসার্চ ফাউন্ডেশন’, ‘কবীর’ অসরকারি সংস্থা। এর সাথে লোকপাল বিল নিয়ে কাজ চলতে থাকে। সেই সময় কেজরিওয়াল কেন্দ্র ও দিল্লির শাসক কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। বহু গুণী এবং সাধারণ মানুষ তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসে। মুকেশ আম্বানির মত মহাপ্রভুর বিরুদ্ধেও তিনি সেই সময় কামান দাগানোর সাহস দেখিয়েছিলেন।
২০১১ – ১২ তে প্রাক্তন সেনা, মহারাষ্ট্রের গ্রাম সংগঠক, গান্ধীবাদী বর্ষীয়ান সমাজসেবী আন্না হাজারে দিল্লির বুকে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও জন লোকপাল বিলের দাবিতে দীর্ঘ অনশন এবং বিপুল জনসমাবেশ ঘটিয়েছিলেন সেখানে বিশিষ্ট সমাজ কর্মী অরুণা রায়, শেখর সিং, প্রশান্ত ভূষণ, কিরণ বেদী প্রমুখের সাথে কেজরিয়াল সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২০১২-তেই তিনি শিশোদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এই অরাজনৈতিক আন্দোলন ‘ইণ্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন’ থেকে বেরিয়ে এসে ‘আম আদমি পার্টি’ (AAP) গঠন করেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিতে শুরু করেন। সেই থেকে তিনি AAP-এর আহ্বায়ক। এই নিয়ে গুরু আন্না হাজারের সাথে মনোমালিন্যও হয়। কোন কোন সমাজকর্মী কেজরিওয়ালদের কর্মকাণ্ডের পিছনে রমন ম্যাগসাইসাই, ফোর্ড ফাউন্ডেশন প্রভৃতির মাধ্যমে মার্কিন অর্থ সাহায্য খুঁজে পান।
যাইহোক, সাদা মাটা চেহারার, মাফলার সহ সাধারণ পোশাক পরা, বলিয়ে কইয়ে উচ্চ শিক্ষিত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামী কেজরিওয়াল দিল্লির আম জনতার নয়নের মণি হয়ে উঠলেন। ২০১৩ তে দিল্লির বিধান সভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নিউ দিল্লি আসনে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের মত হেভি ওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হলেন এবং তাঁর দল দিল্লির ৭০ টি আসনে ২৮ টি আসন জিতে দ্বিতীয় হল। সেই থেকে তিনি নিউ দিল্লি আসনের বিধায়ক। বাইরে থেকে কংগ্রেস, জনতা দল ও নির্দলদের সাহায্য পেয়ে সরকারও গড়ে ফেলল। কেজরিওয়াল মুখ্যমন্ত্রী ও শিশোদিয়া উপ মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
শুরু হল দুর্নীতি বিরোধী আইন এবং লোকপাল বিল লাগু করার জন্যে আন্দোলন। বারাণসী কেন্দ্রে বিজেপির নরেন্দ্র মোদীর বিরূদ্ধে সাংসদ আসনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় স্থান পেলেন। কিন্তু কিছুতেই ঐ আইনগুলি কংগ্রেস, বিজেপি ও আমলাতন্ত্রের বাধায় লাগু করতে না পেরে মুখ্যমন্ত্রীর আসন থেকে পদত্যাগ করলেন।
পরের বছর ২০১৫ তে দিল্লি বিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। আপ বা AAP ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টিতে জয়লাভ করে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। কেজরিওয়ালকে আবার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করা হলো। পরিবর্তিত রূপে লোক পাল বিল পাশ হলো দিল্লি বিধানসভায়।
সেরা সময়: ২০১৫ – ‘২০ ছিল কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে দিল্লির আপ সরকারের একের পর এক উদ্যোগের এবং আপ-এর সম্প্রসারণের সময়। আপ সরকার বেসরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির বিদ্যুৎ মাশুলের কারসাজি ধরে ফেলে বিদ্যুতের ট্যারিফ অনেক কমিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং সকলের জন্যে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে। সকলের জন্যে জল এবং পরে পরিবার পিছু প্রথম ২০ হাজার লিটার বিনামূল্যে জল দেওয়ার ব্যবস্থা করে। অ্যাপ ক্যাবগুলির সার্জ ইত্যাদি মাশুল বৃদ্ধি রোধ করে। দরিদ্র অসংগঠিত ও পরিযায়ী শ্রমিক অধ্যুষিত বস্তি-ঝুপড়িগুলির পাট্টা প্রদান করে এবং উক্ত অঞ্চলগুলির পরিকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি করে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রয়োজনীয় শংসাপত্রের ব্যবস্থা করে। ২০১৫-এর দিল্লি ডেঙ্গু মহামারীতে কেজরিওয়াল হাসপাতালে গিয়ে গিয়ে নজরদারি চালান। দিল্লি ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের বাসে মহিলাদের নিঃশুল্ক যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। পরিবেশ বান্ধব কিছু ব্যবস্থাও গ্রহণ করে। আপ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে সেই সময় নিয়মিত দিল্লি যাওয়ার কারণে চাক্ষুষ দেখেছি সমর্থনের ভিত্তিতে আপ কংগ্রেস ও বিজেপির মত দলকেও ছাপিয়ে যায়। আর এই সময়েই প্রথমে কংগ্রেসের সাথে, তারপর দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সাথে, তারপর বিজেপির সাথে আপের তীব্র দ্বন্দ্ব চলে। প্রবল লড়াই চালিয়ে আপ সরকার টিকে যায় এবং সারা ভারতে আপ সংগঠন কম বেশি ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই আপের ঝাড়ু চিন্হ নিয়ে পুরসভা থেকে সংসদীয় আসনে প্রার্থী হয়ে যান। একই সাথে কেজরিওয়াল এর কিছু স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণের মত অনেকে দল ছাড়েন। কেউ কেউ বিজেপিতে যোগ দেন। কিন্তু কেজরিওয়াল তাঁর জনসমর্থন অটুট রাখতে পারেন এবং পরবর্তী ২০২০-এর দিল্লি নির্বাচনেও ৭০টির মধ্যে ৬২টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। পরবর্তী পাঞ্জাব বিধান সভা নির্বাচনে আপ জয়লাভ করে সরকার গঠন করে এবং গোয়া বিধান সভা নির্বাচনেও ভালো ফল করে।
কিন্তু আপ সরকারের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ১৩% ও ১১% বরাদ্দ করে আন্তরিকতা ও সুপরিকল্পনার মাধ্যমে রাজ্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন যা স্বাধীন ভারতে এযাবৎকাল কোথাও হয়নি। ভাঙাচোরা সরকারি স্কুল ও হাসপাতালগুলি সুসজ্জিত হয়ে তার কার্যকারিতা ও পরিষেবা বহু গুণ বৃদ্ধি করে। সাধারণ পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা বিনামূল্যে উন্নত শিক্ষা লাভ করে এবং সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে সমস্ত ধরনের আধুনিক চিকিৎসা লাভ করতে থাকেন।
ঐ সময় আপ দলের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে তাদের নবনির্মিত সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে একটি রিপোর্ট দেওয়ার। প্রস্তাবটি গ্রহণ করি, কিন্তু আপ-এর আতিথেয়তা নেই না। একদিন দিল্লি নিবাসী সমাজকর্মী সোমেন চক্রবর্তী আর আমি দিল্লি মেট্রোর ব্লু লাইনের আর কে আশ্রম স্টেশনে দেখা করে শ্রমিক অধ্যুষিত পাহাড়গঞ্জ অঞ্চলে যাই। পুরনো বসতি ও শ্রমিক মহল্লার মধ্যে ফুটপাথের উপর আধুনিক ঝকঝকে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ‘মহল্লা ক্লিনিক’-গুলি দেখে অবাক হয়ে যাই। এরকম যে করা যায় ধারণাই ছিল না। সেখানে প্রাথমিক সব চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। একজন আংশিক সময়ের চিকিৎসক, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন ল্যাবেরোটরি টেকনিসিয়ান, একজন মহিলা স্বাস্থ্য কর্মী এবং একজন সাফাই কর্মী (সকলেই contractual কর্মী) মিলে সামলাচ্ছেন। রোগীরা বাড়ির কাছে বিনা মূল্যে আপৎকালীন ও বহির্বিভাগের সমস্ত পরিষেবা এবং গুরুতর কোন রোগ বা আঘাতের কারণে পরবর্তী বড় হাসপাতালে বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স-এর সাহায্যে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়াও ওখানে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, প্রাথমিক পরীক্ষাগুলি হচ্ছে। বাদবাকি পরীক্ষাগুলি সরকার নিয়োজিত সংস্থা বিনামূল্যে ওখান থেকেই নমুনা সংগ্রহ করে (এক্স রে, ইউ এস জি ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে করিয়ে আনছে) করিয়ে দিচ্ছে। চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী এবং রোগীদের সাক্ষাৎকার নিলাম। এরপর আমরা দিল্লির upgraded স্বাস্থ্য কেন্দ্র যেখানে tuberculosis সহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবার ব্যবস্থা রয়েছে সেটি দেখতে যাই এবং দিল্লির সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের এক ডেপুটি ডাইরেক্টরের সাক্ষাৎকার নেই। এই প্রবীণ মহিলা শিখ চিকিৎসক ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেন, অগ্রগতির পাশাপাশি সমস্যা ও বাধাগুলিরও উল্লেখ করেন। জেনে অবাক হই ও পরে কনফার্ম করি দিল্লির tertiary হাসপাতালে বিনামূল্যে আধুনিক যকৃৎ প্রতিস্থাপনেরও ব্যবস্থা আছে। দিল্লির তদানীন্তন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অগ্রগতি নিয়ে একটি নিবন্ধ ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
এরপর সেইদিন এবং পরের কয়েকদিন দিল্লির শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলি ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও স্কুল পরিদর্শন করি। কোথাও আগে থেকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে হাজির হয়েছিলাম, ইচ্ছা করে বহুপ্রশংসিত মডেল স্কুলগুলিতে না গিয়ে সাধারণ স্কুলগুলিতে গিয়েছিলাম। অনেক জায়গায় অনেক সাধ্যসাধনা করে ঢুকতে হয়েছে। কিন্তু দেখেশুনে তাজ্জব হয়ে গেছি যে সরকারি ব্যবস্থায় এতখানি করা কি করে সম্ভব হলো? আর মনটাও ভরে গেছিলো শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেখে।
প্রতিটি সরকারি স্কুল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলে সুন্দর রং করা। অন্য কোন দেওয়াল লিখন বা পোস্টার নেই। স্কুল চলাকালীন গেট বন্ধ। ড্রেস পরা সিকিউরিটি। যোগাযোগ করলে আই ডি কার্ড দেখে ওয়াকি টকি-তে হেড মাস্টারের সাথে কথা বলিয়ে অনুমতি নিয়ে রেজিষ্টারে নাম ইত্যাদি লিখিয়ে তবেই ছাড়লো। প্রতিটি স্কুলের বড় কম্পাউন্ড, সঙ্গে বড় মাঠ, গাছপালা, সুন্দর বাগান। মাঠে ইউনিফর্ম পরিহিত ছাত্র ছাত্রীরা গেমস পিরিয়ডে মনের আনন্দে খেলছে। কম্পাউন্ডের ভিতরটা একদম পরিচ্ছন্ন, সাফাই কর্মী এবং মালিরা কাজ করছেন। সর্বত্র সিসিটিভি রয়েছে। স্কুল বাড়ি ঝকঝকে এবং চমৎকার রং করা। ক্লাশ রুম গুলিও। এমনকি প্রতিটি গাছের গোড়াগুলিও রং করা।
ভিতরে গিয়ে হেড মাস্টার রুম, টিচার্স রুম, উঁচু ও নীচু ক্লাশের ক্লাশ রুম, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি সবই দেখলাম। ঝকঝকে। নার্সারি ক্লাশের play room দেখে আশ্চর্য হলাম। যে কোন নামী করপোরেট স্কুলকে হার মানিয়ে দেবে। দরিদ্র অসংগঠিত ও পরিযায়ী শ্রমিকের সন্তানরা স্কুলের দেওয়া ইউনিফর্ম পরা মনের আনন্দে খেলছে। প্রধান শিক্ষক, অন্যান্য শিক্ষক, ছাত্রদের সাথে কথা বললাম। ….. মনে মনে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দিয়েছিলাম আপ সরকারকে এই আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে এই ধরনের বৈপ্লবিক কাজ করার জন্য।
অধগমন: ২০২০-তে দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কেজরিওয়াল এবং তাঁর আপ সরকার কোন অজ্ঞাত কারণে নিশ্চুপ থাকলেন। তাঁর দুই সম্প্রদায়ের কাউন্সিলরদের কেউ কেউ সরাসরি দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়লেন। CAA বিরোধী আন্দোলনেও কেজরিওয়াল কোন ভূমিকা রাখলেন না। Covid মহামারী নিয়ন্ত্রণেও কেন্দ্র সরকারের মতই ব্যর্থতার প্রমাণ দিলেন। বহু মানুষের মৃত্যু হলো। আগে থাকতেই তিনি বিপাসনা যোগ করতে মাঝেমাঝেই কর্পোরেট ধর্ম গুরুর আশ্রমে গিয়ে থাকা শুরু করেছিলেন। এবার শুরু করলেন বিজেপির সাথে হিন্দুত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা–বিনামূল্যে নাগরিকদের সরকারি অর্থে চার ধাম সহ তীর্থ ক্ষেত্রগুলিতে নিয়ে যাওয়া, প্রচুর জাঁকজমক করে দিল্লিতে রাম ও হনুমান পূজন শুরু করা ইত্যাদি। বিরোধী কংগ্রেসের তীব্র বিরোধী হলেও শাসক বিজেপির প্রতি নরম লাইন নিলেন। বিরোধীদের অভিযোগ গুজরাট বিধান সভা নির্বাচনে কয়েকটি আসনে প্রার্থী দিয়ে কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপিকে জেতার সুযোগ করে দিয়েছেন। বিজেপির সাথে বোঝাপড়া করে চলা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে সখ্যতা গড়ে তুললেন। বিরোধী ইণ্ডিয়া জোটে থেকেও থাকলেন না, মমতার জিনজার গ্রুপে ঢুকে পড়লেন।
কোথায় শ্রমজীবী মানুষদের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে মদ্য পান বন্ধ করবেন, বিহারের মত রাজ্যে যা করে দেখিয়েছেন নীতিশ কুমার, বিপরীতে ২০২১-এ টাকা তুলতে মমতা দেবীর মত এমনই এক আবগারি নীতি নিলেন যেখানে মুদির দোকান থেকে আরম্ভ করে যত্র তত্র মদ পাওয়া যায়। ঐ নীতিতে সরকারি ব্যবস্থার মাধ্যমে মদ বিক্রি কার্যত বন্ধ করে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ঢালাও অনুমতি দিলেন। প্রবল সমালোচনার মুখে পরে পিছু হটলেও ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ঢালাও মদ বেচার সুযোগ দিয়ে নিজেরা ১০০ কোটি টাকা উৎকোচ নিয়েছেন এই অভিযোগে দুই সিনিয়র ক্যাবিনেট মন্ত্রী শিশোদিয়া ও প্রাক্তন সরকারি আর্কিটেচারাল ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্র জৈন গ্রেফতার হয়ে তিহার বাসের পরে দশ বার সমনেও সারা না দেওয়ার পর এবং দিল্লি হাই কোর্টে রক্ষা কবচ না পেয়ে অবশেষে নিজেই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে গ্রেফতার হলেন। দুর্নীতির বিরূদ্ধে লড়াই চালিয়ে উঠে আসা কেজরিওয়ালের বিরূদ্ধে আরেকটি অভিযোগ রয়েছে যে তিনি তাঁর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর আবাস সারাতে ও সাজাতে প্রচুর সরকারি অর্থ নয়ছয় করেছেন।
শেষ নয়: রাজনীতিক – নেতা – মন্ত্রীদের দুর্নীতির দুর্বিপাকে পড়া এই দুর্ভাগা দেশে ভুক্তভোগী অসহায় গরীব ও মধ্যবিত্ত নাগরিকরা কেজরিওয়ালের মধ্যে এক মসীহকে পেয়েছিলেন, তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। এখনও তদন্ত শেষ হয়নি, শাসক দলের নির্বাচনের আগে বিরোধীদের এজেন্সিগুলি দিয়ে দমনের দিকটিও আছে (বিশেষ করে আপ যেহেতু দিল্লি ও পাঞ্জাবে শক্তিশালী এবং হরিয়ানা, গুজরাট, গোয়া প্রভৃতি রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে), তথাপি তাঁদের একটি সুখস্বপ্ন ভেঙে গেছে। এবার হতাশা কাটিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখার এবং নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার সময়।
২৪.০৩.২০২৪