না। দামি ব্রান্ডেড গয়নার বিশেষ ছাড়ের দিন বা নামি স্যালোতে ডিসকাউন্টে সৌন্দর্য ঘষামাজার জন্যে নয়। দিনটি রক্তমাংসের খেটে খাওয়া মেয়েদের সমান শ্রমের, সমান সম্মানের, সমান বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন।
এগুলো আমরা জানি। তাও মধ্যবিত্ত জীবনচর্চায় আলগোছে পাওনাগুলোর হিসেব কষে নিই দরদাম করে। না অপরাধ নয়। তবে দিনের শেষে যেন ভুলে না যাই সেই সব পূর্ব-রমণীদের। তাদের চেষ্টাকে। জীবন চর্চার গণ্ডির মধ্যে যেন নিজের অধিকারের পাওনা গন্ডা চাপা না পড়ে যায়। যেন মূক না হয়ে যাই।
বাগমারি। আমার কর্মক্ষেত্র। যদিও করোনার ঠেলায় প্রায় ৯ মাস যাতায়াত বন্ধ। কিন্তু প্রাণের টান ফুরায়নি। বাচ্চাগুলোর জন্য, ওখানকার মেয়েদের জন্য, সর্বোপরি পাঠশালার জন্য সবসময়ই একটা মন কেমন থেকে যায়। একদিন বাগমারির বাচ্চাদের কথা লিখেছিলাম। আজকে বলি ওখানকার মেয়েদের কথা। বাগমারির মেয়েরা কেউ বসে থাকে না। মৌলিক অধিকারের দায়ে, কর্মমুখর এরা সবসময়ই সচল- প্রাণবন্ত।
এইসব কামলা সুন্দরীদের সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে তারা যে কোন কাজে ব্যস্ত। হয় লোকের বাড়ি কাজে যাচ্ছেন বা আসছেন। কলতলায় কাপড় কাচছেন -জল তুলছেন। বাচ্চা মানুষ করছেন, একটা কোলে, একটা কাঁখে নিয়েই।
মূলত আশেপাশের এলাকায় ঠিকে ঝির কাজ, কেউ বা করেন প্লাস্টিক থেকে তামার তার সংগ্রহের কাজ, কেউ বা খাতার কাটিং থেকে রঙিন পাতা বেছে বস্তায় ভরার কাজ করেন। ঝিরিঝিরি কাগজের স্তুপ থেকে রঙিন কাগজের স্ট্রিপ বেছে এক কেজির বস্তায়, প্রাপ্তি সাড়ে তিন টাকা। শ্রমে-ঘামে মাখামাখি সেইসব প্রাপ্তি।
কিন্তু নিজের জন্য সময়?? দেন কি তারা?? প্রশ্ন করতেই হাসিতে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ল আমার কামলা সুন্দরীরা। সেকি গো দিদি? সবই তো নিজের জন্যই?? না, সারাদিন এত পরিশ্রম। বিশ্রাম বা নিজের স্বাস্থ্যের কথা তো ভাবতেই হয়। না গো স্বাস্থ্য আবার কি? দুবেলা পেট ভরা ভাত আর বছর বছর বিয়ানো (সন্তানের জন্ম দেওয়া)– এই হলেই ঢের।
অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন মেয়েদের হাতে টাকা থাকলেই জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। আসবে মেয়েদের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন।
এইসব মেয়েরা প্রায় প্রত্যেকেই কিছু না কিছু রোজগার করেন। কিন্তু নিজের জন্য বা নিজের স্বাস্থ্যের জন্য কিছুই করেন না। প্রশ্ন করলাম মাসিকের প্যাড ব্যবহার করো? অবধারিত উত্তর–না গো, দিদি, অনেক দাম। মেয়েদের স্বাস্থ্য!! যার দায়, সেই রাষ্ট্র তখন ঘুমোচ্ছে। মেনস্টুয়েশনের প্যাডে জিএসটি বসাচ্ছে। কামলা সুন্দরীরা শ্রম দিয়ে ইঁট গাঁথছেন, গাঁথছেন রাষ্ট্রের বুনিয়াদ।
সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বর মদে টাকা ওড়ায়। একার আয়ে কোনরকম চলে। প্যাড ট্যাড-ওসব বিলাসিতা। কারো কাছে উত্তর পেলাম, মেয়েটার জন্য এনে দি গো, দিদি। নিজের জন্য আর হয় না।
তার মানে জানো, মাসিকে কেন প্যাড ব্যবহার করা উচিত! পড়াশোনা জানিনা, অতশত বুঝিনা। মেয়েটা বায়না করে। ইস্কুলে কয়েকবার পেয়েছিল। তা থেকেই আর ন্যাকরা ব্যবহার করতে চায় না।
শহরের অনেকগুলি বস্তি আমার ঘোরা। তবে বাগমারি এদের থেকে একেবারেই নেই-রাজ্য। উন্নয়ন এখনো এসে দাঁড়ায় নি। ফেলে দেওয়া বস্তা, পলিথিন, মাটি, সরু চাঁচের বাখারি দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ভাঙ্গা ঝুপড়ি। পেছনের প্রায় খালের উপর ব্যক্তিগত খাটা পায়খানা। তাতেও অস্থায়ী পলিথিনের আব্রু।
করপোরেশনের আজমালি জলের ব্যবস্থা, আর মাথার উপরের হাই এক্সটেনশন তারে হুকিং। এই নিয়েই চলে বাগমারি খালপাড়ের বস্তি জীবন।
এহেন খালপাড়ের জীবনে একমাত্র ব্যতিক্রম ভাষা ও চেতনা পাঠশালা। পাঠশালা নিয়মিত নয়। মাঝেমধ্যে স্যারেরা, দিদিমণিরা এসে পড়াশোনা করান, ছবি আঁকান। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর চোখে কিছু স্বপ্ন বুনে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওড়ার জন্য ডানা তৈরীর চেষ্টা করেন। কিন্তু মেয়েরা। তাদের ভাঁড়ার শূন্য।
ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮-তে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারে রেকর্ড সংখ্যক মহিলা মারা গেছে এদেশে। প্রায় ৩১১৯০১ জন। যেখানে সরকারি তথ্য অনুযায়ী নথিভূক্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ৭০ হাজার মহিলা। এখনো প্রতিবছর এদেশের ৩৫% মহিলারা এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
বাগমারি- কলকাতা- ভারত। ছবিটা এক। মেয়েদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য। এখনো দেশের মাত্র ৩৬ শতাংশ মহিলারাই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করেন। বাকিরা??? মাসিকের সময় নোংরা পুরাতন কাপড়। সংক্রমণ। দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ। সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার। এই খাতরো কা খিলাড়িতে যাঁদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি, কোনরকম উতরে যাচ্ছেন তাঁরা। উতরে যাচ্ছেন। শ্রম দিচ্ছেন। দৌড়াচ্ছেন কামলা সুন্দরীরা ।
8 ই মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। এবার একটু নিজেদের কথা ভাবি। স্বাস্থ্য, শারীরিক- মানসিক দুই দিকেই সচেতন হই। একটু।
এ বছর বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বাগমারি খালপাড় এলাকায় ভাষা ও চেতনা সমিতির পাঠশালায় বসবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন। উদ্যোগ স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ-এর। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক স্বামী জিতাত্মানন্দের স্মৃতিরক্ষার্থে অর্থসাহায্য করেছেন তাঁর ছাত্ররা। আশা রাখছি বিকেল চারটের সময় আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারব।
সব বন্ধুদের ওই সময় উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
বন্ধুরা, আপনারা সবাই জানেন মহিলাদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো বেশিরভাগ মহিলারাই সচেতন নয়। কেন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যাবহার করবেন বা কতক্ষণ করবেন সেই বিষয়ে সচেতনতা তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি। সময় এসেছে মহিলাদের স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা তাদের নিজেদেরকে উপলব্ধি করানোর। আসুন সবাই মিলে সেই চেষ্টা করি।
ভালো থাকবেন। সবার উপস্থিতি কামনা করি।
চমৎকার লেখা । প্রয়োজনীয় লেখা ।
Knd attn. Piyali.
Can u kndly whatsapp me? Regarding todays progrm.