থাইল্যান্ডে বসে কলকাতার নিউ নর্মাল ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারছিলাম না। খবর, মিডিয়া, সকলের মুখের কথায় একটা ধারণা হয়েছিল যে অন্তত কিছুটা “নিউ” হবে! কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ওঠার পর থেকেই বুঝলাম নতুনের প্রভাব বড়োই কম, তবে আছে।
অনেকেই মাস্ক পড়েছিলেন, নাকের নীচে নয়, যেভাবে পড়া উচিৎ সেভাবেই। তবে বেশ কিছু মানুষকে কেবিন ক্রুরা একাধিক বার বলে গেলেও তাদের কোন হিল দোল ছিলো না। আমার পাশের পাশের জন ছিলেন সে গোত্রীয়। তিনি মাস্ক খুলে নাকে মুখে চোখে হাত দিয়ে সেই হাত দিয়ে সামনের সিট ধরছেন, ওপরের কেবিন খুলছেন, সেফটি ম্যানুয়াল পড়ছেন। দু তিনবার অতি কষ্টে ইগনোর করলাম, তারপর আর পারলাম না। বলেই ফেললাম। তিনি কেবিন ক্রু এর সাথে লুকোচুরি খেললেও আমি বলার পর দয়া করে কথা না বাড়িয়ে মাস্ক পড়ে নিলেন।
এই প্রসঙ্গে বলি, দিন কয়েক আগে মেট্রোতে দুজনকে বলেছিলাম, তারা মাস্ক খুলে, চুল উড়িয়ে চলছিলেন। কিন্তু তাদের বলা মাত্রই মাস্ক খোলা অবস্থায় যেভাবে না পড়ার কারণ বোঝাতে থাকলেন যে আমি আর আমার পাশের সহযাত্রী উঠে গেলাম, কারণ সব ড্রপলেট আমাদের গায়েই আসছিলো!
যাই হোক্, যা বলছিলাম। দিল্লি নেমে এক্সেম্পশন লাইনে দাঁড়ালাম,একজন মহিলা ফোনে অ্যাপ্রুভাল মিলিয়ে দেখছিলেন। আমি সামনে গিয়ে দেখলাম তাঁঁর টেবিলের তিন পাশ ঘেরা, তবুও কিছু অতি উৎসাহী মানুষ চতুর্থ ফাঁকা জায়গা দিয়ে তার সামনে ভীড় করে আছে, এবং তিনি ক্লান্ত কন্ঠে সরে গিয়ে লাইন করে দাঁড়াতে বলছেন।
অন অ্যারাইভাল টেস্টিং এর লাইন আরও মারাত্নক, পিলপিলিয়ে লোকের ভিড়। আমি কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে সব ফর্মালিটি সেরে বেরিয়ে ডোমেস্টিকের দিকে এগোলাম।
সে এক বিচিত্র দৃশ্য! গোলচক্বরের মতন লোকে গোল করে জমায়েত করে রেখেছে। প্রথমে ভাবলাম কিছু চেকিং চলছে, তারপর দেখলাম ওটা চা জলখাবার খাওয়া আর গুলতানির ভীড়। মাস্ক শীল্ড লাগেজের ট্রলি সব নিয়ে গলা ফাটিয়ে এক্সকিউজ মি, হাটিয়ে, হ্যালো, কিছু বলেই কাউকে সরাতে পারছি না। অবশেষে ট্রলির হাল্কা ধাক্বায় কিছটা কাজ হল।
প্লেনে ওঠার সময় দেখলাম প্যাসেজে লোক দাঁড়িয়ে। কারণ কেবিন ব্যাগেজের স্পেস শর্টেজ এবং মাঝের সিটের মানুষেরা প্লেনে উঠে পিপিই টাইপ অ্যাপ্রন পড়ছে। এই পিপিই কিট বোর্ডিং শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগে সকলকে দিয়ে দেওয়া হয়, তাই সেটা পড়ার সময় পাওয়া যায় না, তেমনটা নয়। যাই হোক, আস্তে করে গিয়ে নিজের সিটে বসলাম, প্লেন টেক অফ করলো। এদিক ওদিক আর তাকালাম না। চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম।
কলকাতা ল্যান্ড করার পর এয়ার হোস্টেসরা সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং এর কথা একাধিক বার বলেও কিছু করতে পারলেন না। প্লেন থামার সাথে সাথেই সকলে একসাথে উঠে পড়লো। রো, নাম্বার,
এক এক করে যাওয়া, কে শোনে কার কথা! গাড়ি করে ফিরতি পথে দেখলাম লোকজন বেশ নির্ভীক।
চোদ্দ দিন হোম কোয়ারানটাইন কাটিয়ে বাইরে বেরোলাম। মিশ্র প্রতিক্রিয়া, কেউ মাস্ক পরে তো কেউ রাস্তায় থুতু ফেলে। যেখানে যাই যে অভিঞ্জতাই হোক মেট্রোতে উঠে বেশ ভালো লাগতো। যথেষ্ট নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা ছিলো। কিন্তু শেষ কয়েক সপ্তাহে দেখছি মেট্রো গেট টপকে গেলেই মাস্ক নেমে যাচ্ছে, কেউ কেউ তো ব্যাগেই পুরে ফেলছেন। অটো রিকশা বাস সে সবের কথা না বলাই ভালো।
শ্রীমতী জয়তী চক্রবর্তীর একটা অনুষ্ঠান দেখতে গেছিলাম আই সি সি আর-এ। সেখানেও অরগানাইসাররা এসে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে কিছু মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করলেন। বাইরে বেরোলে মনে হচ্ছে কোভিড নাইনটিন বলে কিছু কোনদিন ছিলোই না। মিটিং মিছিল অবরোধ মেলা সব চলছে। পাড়ার মোড়ের আড্ডা, দোকান সবখানেই এক চিত্র।
এই নিয়ে কাউকে কিছু বলতে গেলেই শুনছি “আর পারা যাচ্ছে না”, “কোভিড নিয়েই চলতে হবে”, “সব বন্ধ থাকলে মানুষ খেতে পাবে না, সব খুলে দেওয়া উচিৎ”।
খোলা তো সব হয়েছেই, কিন্তু নিয়ম মানতে বারণ করা হয়েছে কি! মহারাষ্ট্রে আবার সংখ্যা বাড়ছে, অন্য শহরেগুলোতেও সেকেন্ড ওয়েভ আসবে বা হয়তো চলছে। এতো রঙ বেরঙের ভোট বাজারে মহামারী নিয়ে ভাবার সময় কারোর হবে না, সেটাই স্বাভাবিক, শুধু ভোটে জিতলেই চলবে!
এইসব বলতে গেলে এক বিশেষ শ্রেণীর বোদ্ধাদের থেকে আমাকে শুনতে হয়েছে নিজে মাস্ক পরলেই হলো, অন্যকে বলে কি হবে! আমি উত্তরে বললাম, না হবে না। মাস্কে আমার নাক মুখ ঢাকছে, সারা শরীর নয়। গায়ের পাশে কেউ হাঁচলে কাশলে বা কথা বললে ড্রপলেট সব জায়গায় লাগে। সেই অবস্থায় সারাদিন বাইরে থাকলে কখনো সেটায় হাত লাগতেই পারে আর তা নিজের অজান্তেই মুখে আসতে পারে। আমার কথা তাদের কাছে বাড়াবাড়ি লেগেছে।
বহুবছর ধরে মলিকিউলার বায়োলজি নিয়ে কাজ করছি, তাই অ্যাসেপটিক মেসার্সের কিছুটা আমার জানা। আর তার সূত্রেই বলছি, ভাইরোলজি ব্যাপারটা জল ভাত নয়। সোশ্যাল মিডিয়া ব্লগ আর একপেশে নিউজ চ্যানেলের হেডলাইনকে ভরসা করে নিজে নিজে নিয়ম বানাবেন না প্লিজ। নিউ নর্মাল মানে নিয়ম মেনে রাস্তায় বেরানো। গরম ঘাম হাঁসফাঁস করা এইগুলার সাথে চেষ্টা করলে একটু মানিয়ে নেওয়া যায়।
রঙ বেরঙের ভোটের শেষে যদি আরেক দফা লকডাউন হয়, কতোটা ক্ষতি হবে তার কোন ধারনা নেই। অলরেডি ইকোনমি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বাচ্চারা এখনও ঘরে বন্দী, বয়স্করা সাহস করে বেরোচ্ছেন না। আবার সব বন্ধ হলে শরীর মন কোনো কিছুর অস্তিত্ব আর থাকবেনা।
তাই দয়া করে একটু ভাবুন, অন্যকেও ভাবান।