‘মারীর দেশ’ নিয়ে লেখাগুলোর একটাও গল্প নয়। প্রত্যেকটি ঘটনাই আমার চোখে দেখা। এমনিতেও আমার ব্যক্তিগত মত, লেখকের নিজের লেখার কাছে সৎ থাকা খুব জরুরি। কেউ না দেখলেও আয়নার সামনে দাঁড়ানোর দায় তাঁর থাকেই। আমি নিজেই জানি এই লেখাগুলো এলেবেলে, পৌনঃপুনিকতায় দুষ্ট। তবু যখন সে লেখার তলাতেই কোনও নব্বই ছুঁইছুঁই ভদ্রলোক তাঁর অশক্ত হাতে লেখা ভালো লাগার কথা জানান, সেটাই আমার হাবিজাবি লিখে যাওয়ার অক্সিজেন হয়ে যায়। লিখে ফেলার পর লেখার ওপর পাঠকের অধিকারও তো বড় কম নয়…
অসুস্থ শিশুদের নিয়ে অনেক লিখেছি। আজকের লেখাটা তাদের মায়েদের নিয়ে। ‘পেশেন্ট-পার্টি’ নিয়ে। যদিও আমি পারতপক্ষে ‘পেশেন্ট-পার্টি’ কথাটা বলা পছন্দ করি না। বড্ড কর্কশ শোনায়। আমি ‘বাড়ির লোক’ বলতেই অভ্যস্ত। এমনিতে হাসপাতালের কথা ভাবতে বসলে অসুস্থ শিশুদের মুখ ভেসে ওঠে, হাজারো যন্ত্রপাতির নিযুত সংখ্যা আর অ্যালার্ম ভেসে ওঠে, রক্ত-পেচ্ছাব-ঘাম-মল-মূত্র ভেসে ওঠে কিন্তু খুব চট করে বাচ্চার বাড়ির লোকের কথা ভেসে ওঠে না। ওঠা উচিত ছিল কিনা সে বিতর্ক থাক। সহজে মাথায় আসে না, এটাই সত্যি। এবং, নিঃসন্দেহে সেটা খুব গর্ব করে বলার মতো বিষয় নয়। মায়েরা হাসপাতালের ভেতরে থাকেন। বাচ্চার বাবা বা বাড়ির অন্যান্যরা বাইরে। বিভিন্ন সময় প্রয়োজন হ’লে বাইরে থেকে তাঁদের ডেকে পাঠানো হয়। ডেকে সময়মতো না পাওয়া গেলে ভীষণ বিরক্তি হয়। অনেক সময় দু-চার কথা শুনিয়েও দিই। বেশিরভাগ সময়েই উল্টোদিক থেকে একটা অপরাধী-অপরাধী মুখ দেখা যায়। কিংবা দু-একটা অস্ফুট কথা। তখন আমার মাথার ওপর কয়েক কোটি কাজের বোঝা। তার ওপর সময়মতো বাড়ির লোক না পেয়ে কাজ আটকে গেলে বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার কখনও হয়তো ঘন্টাখানেক ঘাম ঝরানোর পর বহু কষ্টে বাচ্চার একটা চ্যানেল করা গেছে। কোনোমতে কাজ সেরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। কল এলো, ওই বাচ্চা আবার চ্যানেল খুলে ফেলেছে। মায়ের জন্য অবধারিত ভাবে বেশ কিছু বাক্যবাণ রাখা থাকবে। চেঁচামেচি করে ফেলি। “নিজের বাচ্চাকে একটু ধরে রাখতে পারো না? কী করো সারাদিন? বাচ্চাকে দেখা ছাড়া আর তো কোনও কাজ নেই… এভাবে চল্লিশবার ফুটিয়ে চ্যানেল করা যায় নাকি? তোমাকে ফোটালে বুঝতে পারতে…” অধিকাংশ সময়েই প্রত্যুত্তরে শুধু নীরবতা।
আসলে উল্টোদিকটা ঠিক চোখে পড়ে না। বা পড়লেও মনে থাকে না সবসময়। আসলে খুব চেষ্টা করে আমরা নিজেদের খানিক পাল্টে ফেলার চেষ্টা করি কিন্তু তাতে শ্রেণীচরিত্র পুরোপুরি বদলায় না। আমার চোখে পড়ে না ওই মায়েরা দিনের পর দিন একটা ছোট্ট ভ্যাপসা ঘরে একসাথে কোনোভাবে দু-মুঠো খেয়ে, কুঁকড়ে-মুকড়ে দিন কাটাচ্ছে। কখনো মাথা এলানোর সামান্য সুযোগও নেই। বাচ্চার বেডের পাশে চেয়ারে, কখনো মেঝেতেই একটু চোখ বুজে ফেলা। স্নান, খাওয়ার সময়েও ডাক আসতে পারে। তখন পড়িমরি করে ছুটে আসতে হয়। তারপর সারাদিন রোবটের মতো বাচ্চার দেখভাল করে যাওয়া। ক্লান্ত শরীর টানতে না চাইলেও টেনে সেই যেতেই হয়। এভাবেই একসাথে থাকতে থাকতে অজান্তে তারা বন্ধু খুঁজে পায়। “তমার মেয়ে ত আজ কী সুন্দর পুরা ভাতটা খেয়ে লিল অনিতাদি… আমিনা, তর ব্যাটাকে দুদ ধরাবি যা। কেঁদ্যা ভাসি দিল…” অথচ সেদিনই হয়তো তার নিজের বাচ্চার জ্বরটা একশো তিনের কাঁটা পেরিয়েছে। সুপ্রিয়ার লক্ষ্মীর পটের সামনে বসেই মাথায় ঘোমটা টেনে নামাজ পড়েছে আমিনা। মৌলবীর দোয়াভরা কালো সুতো একই সাথে ছুঁয়েছে অনিকেত আর আয়েশার কপাল। কারো বাচ্চা সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে তারা সবাই একসাথে মিষ্টি খেয়েছে। বলাবলি হয়েছে, বাচ্চাটাকে দেখে রেখো গো দিদি… আবার সেদিনই কারো চিরমুক্তি। ছোট্ট শরীরকে আর ছুঁচের যন্ত্রণা সইতে হবে না… গলায়-মুখে-পেচ্ছাবের দ্বারে নল ঢুকিয়ে রাখতে হবে না… মায়ের আছাড়িপিছাড়ি কান্নার সময় বাকিদের চোখেও ভরা শ্রাবণ। কে বলে দুঃখের দিনের ভাগ হয় না?
বাইরে তাদের বাড়ির লোক। বেশিরভাগ সময়েই বাচ্চার বাবা। হোটেলে থাকার পয়সা নেই। হাসপাতাল চত্বরেই ত্রিপল টাঙিয়ে থাকা। গেটের পাশে কুড়ি টাকার ডিম-ভাত। পয়সা বাঁচাতে হবে। তাই পনেরো টাকার সব্জী-ভাত। “অম্বল অম্বল লাকচে। আজ আর ডিম খেলুম নি।” এভাবেই দিন। এভাবেই রাত।
কার ওপর রাগ করি? কার ওপর বিরক্তি ওগরাই? হয়তো ওই সময়টাতেই বাবা খেতে গেছে কিংবা মা স্নানে। আবার আমার ব্যস্ততাটাও মিথ্যে নয়। অবশ্য পশ্চাৎপক্ক লোকজনেরও অভাব নেই, বলাই বাহুল্য। অগত্যা, বিপুল চক্রব্যূহে হাতে শেষমেশ পড়ে রইলো প্যারাসিটামল। এছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার নেই, দেওয়ার নেই। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ফেলি। আবার ভাবতে বসি, ইস! এতটা না বললেও হ’ত। জানি, সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। তবু প্রশ্নটা সত্যি। সে প্রশ্নের সামনে আমার অসহায়ভাবে ঘেঁটে যাওয়াটা সত্যি।
রাত গভীর হয়। চারদিক নিশ্চুপ হ’লে প্রশ্নগুলো আরও কিলবিলিয়ে ওঠে। এমনিতেই আমার ঘুম ধরতে দেরি হয়। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। এই সময়টাতেই আরশিকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। না পেলে কোলবালিশটাকেই জড়িয়ে ধরে বক আর বাঘের গল্প শোনাই। আরশি এখন বাবার ছবি আঁকতে শিখেছে। সেই ছবিটা বারবার খুলে দেখি। কাল আবার একই প্রশ্নের সামনে যুদ্ধ করার দিন।
(স্লেটে আরশি বাবার ছবি এঁকেছে)