পুরুলিয়া বরাবাজারের গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তালা ভেঙে এক মহিলা ডাক্তারের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। মেয়েটির নাম সুচিত্রা।
এই খবরটা পড়ে আরেক মহিলা ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেল। কোনো এক হেমন্তের সন্ধ্যায় এক লেডি মেডিক্যাল অফিসারের কোয়ার্টারে চা খেতে খেতে জানালা দিয়ে দূরে গ্রামের মাঠ ঘাটের ঝুপসি হয়ে আসা কুয়াশার সাদা অন্ধকার দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, শীতটা সত্যিই একটু তাড়াতাড়ি এসে গেল। আমার উলটো দিকে কোলের ছোট বাচ্ছা সামলে আমার সাথে চা নিয়ে গল্পরত তরুণী ওই সহকর্মীর সাথে আলাপে জানতে পেরেছিলাম যে তার স্বামী সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। দক্ষিণের একটি নামি সাইবার সিটিতে কর্মরত। আর এই মেয়েটি পোস্ট গ্রাজুয়েট স্পেশালিস্ট পোস্টিং এই গ্রামের হাসপাতালে।
একটু অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, যে ও কেন এখানে পোস্টিং পেল। মেয়েদের, বিশেষ করে ছোট বাচ্চা যার আছে, সে তো একটু চাইলেই শহরের কোনো হাসপাতালে পোস্টিং পেতে পারতো। মেয়েটির সোজাসাপটা উত্তর ছিল, “আমি এমন কিছুর জন্য অনুরোধ করতে পারবো না স্যার। এত দাদা তো আছেন এই হাসপাতালেই, আমার মতোই স্পেশালিস্ট। তাঁরা ডিউটি দিতে পারলে আমিও পারবো। আর আমার মতো ছোট বাচ্চা তো অনেক সিস্টারেরও আছে। তাঁরাও তো ডিউটি দেন। আমি মেয়ে বলে কেন বিশেষ সুবিধা নেব স্যার?”
কথাবার্তাটা এর পরে কোনদিকে মোড় নিত জানিনা। কারণ ঠিক ওই সময়েই হাসপাতাল থেকে জিডিএ এসে অভ্যস্ত গলায় হাঁক পারল, “দিদি কলবুক”। মানে ওয়ার্ড থেকে ডাক পড়েছে। সংক্ষিপ্ত চায়ের আসর, আরো সংক্ষিপ্ত করে অগত্যা উঠেই পড়তে হল। মেয়েটিও তার কোলের বাচ্চাটিকে তার কাজের মাসির হাতে দিয়ে স্টেথো হাতে বেরিয়ে এলো আমার সঙ্গেই।
হাসপাতালের গেট বেশ কিছুটা দূরে। সঙ্গে গেলাম কিছুটা। এমনিতে একা একাই যেতে হয়, কোনো নিরাপত্তা রক্ষীটক্ষী কিছুই নেই গ্রামের হাসপাতালে।
জিজ্ঞেস করবো কি করবো না ইতস্তত করে শেষ অবধি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “কিছু মনে করো না, আমি যে চেয়ারটায় বসেছিলাম, তার মুখোমুখি দেওয়ালে কয়েকটা ছবি টাঙানো ছিল। তার মধ্যে একটি ছবিতে সুইমিং কস্টিউম পড়া, ওটা কি তোমার ছবি।”
মেয়েটির মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো, “হ্যাঁ স্যার, ঠিকই ধরেছেন। একটু আনকমন ছবি, তাই না ? আসলে আমি স্কুল লেভেল থেকেই সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। মেডিক্যাল এর পড়ার চাপ সামলে বেশিদিন আর কন্টিনিউ করতে পারিনি।”
গেট অবধি ছেড়ে ফিরে আসছি। বারবার মেয়েটির মুখটা মনে পড়ছিল। মেন গেটের উজ্জ্বল নিয়ন আলোতে যে শুধুমাত্র ধুধু মাঠের মধ্যে হাসপাতালের নামটাই ফুটে উঠছিল তাই না, ওর সেই কয়েক মুহূর্তের উজ্জ্বল হাসিভরা মুখটাও ফুটে উঠেছিল।
কত ভাবে লড়াই চালাতে হয় মেয়েদের। কেউ পারে কেউ পারে না। সুচিত্রা পারে নি। ওর হাসিভরা মুখটা কোনও দিন আর দেখা হল না।
“ফাইট কোনি, ফাইট”