নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নাসা মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব খোঁজার জন্য প্রায় একশ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্টিয়াল ইন্টেলিজেন্স – সংক্ষেপে, ইংরেজি আদ্যক্ষরগুলো মিলিয়ে, সেটি। সেখানে বিজ্ঞানীরা অষ্টপ্রহর শুধু তেমনই সিগন্যাল খুঁজবেন, যা কিনা বুদ্ধিমান প্রাণী বাদে অন্য কোনও উৎস থেকে আসা সম্ভব নয়।
কিন্তু জীববিজ্ঞানীরা এমন মহৎ ভাবনার বিরোধিতা করে বসলেন। প্রশ্ন তুললেন, বুদ্ধিমান প্রাণী ব্যাপারটা কী? বললেন, ‘সেটি’ প্রকল্প আদতে যেভাবে ভাবছে, তার উৎস বিজ্ঞান নয় – উৎস বিজ্ঞান-পূর্ব লোকবিশ্বাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ধর্মবিশ্বাস, মানবসভ্যতার উন্নতি বিষয়ে ভিক্টোরিয়ান ধ্যানধারণা এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ – সব মিলিয়েমিশিয়ে যে জগাখিচুড়ি, তার ফসল এই ভাবনা। যার সঙ্গে বিবর্তনের তত্ত্ব মেলে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই আমরা কথায় কথায় উচ্চতর-নিম্নতর প্রজাতি, বিবর্তনের সিঁড়ি ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করি। বিশ্বাস করি, “বিবর্তনের ধাপ” অতিক্রম করে “নিম্নতর জীব” থেকে “উচ্চতম প্রজাতি” হিসেবে বুদ্ধিমান মানুষের “বিকাশ”। এমনকি বিবর্তনের যে ইংরেজি শব্দ ইভোলিউশন, ব্যুৎপত্তি অনুসারেই তা যখন অন্যত্র ব্যবহৃত হয়, সেই ইভলভ শব্দটি উন্নতির অনুষঙ্গে ব্যবহার্য। অতএব, বিবর্তনবাদ বিষয়ে আমাদের ধারণা খুবই ঝাপসা। আমাদের তো বটেই, প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদেরও। অথচ বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তত্ত্বের মধ্যে বিবর্তনবাদ অন্যতম এবং নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মতোই বিবর্তনবাদের মূল সূত্রগুলোও সার্বজনীন। তাহলে?
আমাদের সৌভাগ্য বলা যেতে পারে, হাতের নাগালে বিবর্তনবাদ বিষয়ে বাংলাভাষায় একখানা চমৎকার বই এসে গিয়েছে। যথাসাধ্য সরল ভাষায় বিবর্তনবাদের মূল কথাগুলো সেখানে বলা হয়েছে। বইটির নাম, “বিবর্তন – আদি যুদ্ধ, আদি প্রেম”। লেখক, জয়ন্ত দাস।
বিবর্তনবাদ বা ডারউইনবাদ নিয়ে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। কিন্তু কয়েক লক্ষ বছর ধরে জীবনের বিকাশ বিষয়ে মতামতের খামতি নেই। এমনটা কেন? জয়ন্তবাবুকেই উদ্ধৃত করি –
“ডারউইনবাদ নিয়ে অবিশেষজ্ঞ মানুষের জোরালো মতামতের একটা কারণ যদি হয় পুরনো বিশ্বাস, তবে আরেকটা কারণ হয়ত ডারউইনবাদের আপাত সরলতা। কোয়ান্টাম থিওরি বা আপেক্ষিকতাবাদ বিস্তর অঙ্কের ব্যাপার। গভীর পড়াশোনা ছাড়া তার সাঙ্কেতিক প্রকাশ মাথায় ঢুকবে না। খুব কম লোকই মনে করেন যে তিনি এগুলো বিজ্ঞানীদের চাইতে ভালো বোঝেন। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব? সেটা আবার না বোঝার আছেটা কী? ডারউইনের মূল সূত্রগুলো বোঝা সত্যিই খুব শক্ত নয়। আর এখানেই আমরা ঠকে যাই।”
তবু মনে রাখা জরুরি – “আপেক্ষিকতাবাদ বা কোয়ান্টাম থিওরি বিশেষজ্ঞদের জানলেই হয়ত চলবে, কিন্তু জীবনের উন্মোচন আর বিকাশের কথা আমাদের সবারই জানতে হবে।”
জানতে তো হবে, কিন্তু জানব কেমনে? “আমরা এলাম কোথা থেকে, আমাদের বুদ্ধি ও চরিত্রের উৎস কী, এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক চর্চা আমাদের দৈনন্দিন সাধারণ বৌদ্ধিক চর্চার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কিন্তু বিজ্ঞান এ ব্যাপারে কতদূর এগিয়েছে, সে কী বলে আর কেন বলে, তার প্রমাণ কতটা সুনিশ্চিত, সে সব আমাদের জানা নেই। স্কুল-কলেজের বিজ্ঞানের পাঠক্রমে যেটুকু আছে তা বইয়ের পাতায় আবদ্ধ, সকলের মনে তা প্রতিষ্ঠা পায়নি।” তো সেই জানানোর জন্যেই এই বই। বারবার উদ্ধৃতি ব্যবহার করলাম এই বইয়ে ব্যবহৃত যে ভাষা তার সারল্যের উদাহরণ দিতে।
মোট বারোখানা অধ্যায়ে এই বইকে ভাগ করা হয়েছে। তার আগে একখানা ভূমিকা। লেখকের। একখানা মুখবন্ধ। লিখেছেন ভারত সরকার নিয়োজিত ন্যাশনাল সায়েন্স চেয়ার ডঃ পার্থপ্রতিম মজুমদার। সবার আগে “লেখকের কৈফিয়ত : কেন এই বই”। শেষে তিনখানা পরিশিষ্ট। প্রথমটিতে জিনতত্ত্বের অ-আ-ক-খ জানানো হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে মেন্ডেল ও তাঁর বংশগতি তত্ত্বের কথা। তৃতীয় পরিশিষ্টটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। রিচার্ড ডকিন্সের দ্য সেলফিশ জিন বইটি বিজ্ঞাননির্ভর বইয়ের মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে শীর্ষে। ডকিন্স অবশ্য নিজে এই নামটি ব্যবহার করতে চাননি এবং এই নাম যে বইয়ের বিষয় সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা দিয়ে ফেলেছে সে নিয়ে পরবর্তীকালে আক্ষেপও করেছেন। তবু এই বইয়ের সাফল্য অনস্বীকার্য। গত শতকের ষাটের দশকে উইলিয়ামস ও হ্যামিল্টন এক গণিত-নির্ভর তত্ত্বের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় জিনের প্রাথমিক ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ডকিন্স সেই তত্ত্বকেই অতুলনীয় দক্ষতার সঙ্গে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বিবর্তনের তত্ত্ব সর্বজনীন হলেও এই জিন-সর্বস্ব তত্ত্ব তেমন নয়। জয়ন্তবাবু তাঁর তৃতীয় পরিশিষ্টে সেই সীমাবদ্ধতার কথা আলোচনা করেছেন। এছাড়া রয়েছে বইয়ে ব্যবহৃত চিত্রতালিকা, টীকা ও তথ্যসূত্র, সহায়ক গ্রন্থের তালিকা। এবং বাংলায় বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে বিরল ব্যাপার, শেষে ইন্ডেক্স বা সূচক।
বারোটি অধ্যায়ের নাম যথাক্রমে – কেন আমি বাবা-মায়ের মতো, চার্লস ডারউইন – চিন্তাজগতে বিপ্লব, যৌন নির্বাচন, মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন, জটিলতার জিনচিহ্ন, লাগামছাড়া জিন-বদলের শৃঙ্খলা, স্বার্থপর জিন ও তারপর, জিন সমাজ আচরণ, প্রজাতির উদ্ভব, অস্ত্র দৌড় – জিনের লড়াই, বিবর্তন কি সত্যি, বিবর্তন নিয়ে ভুল ধারণা। প্রতিটি অধ্যায়কে আবার একাধিক পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে।
বইটা দুভাবে পড়তে পারেন। এক তো শুরু থেকে শেষ অবধি, একটানা। আর নাহলে, শেষ দুখানা অধ্যায়, মানে একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়, প্রথমেই পড়ে নিয়ে তারপর বইটা পড়া শুরু করতে পারেন। সেক্ষেত্রে পাঠের অভিজ্ঞতা ভিন্ন মাত্রা পেতে পারে। যেকথা বারবারই বলছি, এ বইয়ে ব্যবহৃত ভাষা অত্যন্ত আটপৌরে ও সরল। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বইটিও সরল। ডারউইনের যুগান্তকারী তত্ত্বের মতো গভীর বিষয়ের কোনও অতিসরলীকরণ এই বইয়ে পাবেন না, সুতরাং এ বই যথেষ্ট জটিল। সুখপাঠ্য হলেও এ বই আত্মস্থ করা আয়াসসাধ্য। এবং অনেক অধ্যায়ই পুনর্পাঠের শ্রম দাবি করে। হকিন্সসাহেবের সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত বইটি বেস্টসেলার হলেও তার বিষয় ছিল দুরূহ। যতজন কিনেছিলেন, তার মধ্যে কতজন পড়ে উঠেছিলেন বলা মুশকিল। যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানবেন, সরল ভাষায় লিখিত বিজ্ঞানের বই বিষয়ের কারণেই সরল হওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু ভাষার সারল্য জটিল বিজ্ঞানকে বোঝার চেষ্টার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। হ্যাঁ, ওই সাহায্যটুকুই করতে পারে। তারপরও চেষ্টা ও বোঝার শ্রম পাঠককেই করতে হয়। জয়ন্তবাবুর বইয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা বলার। পপুলার সায়েন্স অনেকদিনই পশ্চিমদেশে বেস্টসেলার তালিকায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, যদিও এদেশে সেই ধরনের লেখালিখি কম। জনপ্রিয় পত্রপত্রিকায়ও বিজ্ঞান নিয়ে লেখালিখি যা হয়, তার অধিকাংশই হয় তেমন “পপুলার” নয়, নাহলে তাতে “সায়েন্স”-এর ভাগ কম। জয়ন্তবাবুর বইটি সেখানে বিরল ব্যতিক্রম।
বইটির প্রকাশক গাঙচিল। চমৎকার ছাপা, বাঁধাই। প্রচ্ছদও, একটু স্কুলপাঠ্য জীববিজ্ঞানের বইয়ের মতো দেখতে লাগলেও, দৃষ্টিনন্দন। দামটা হয়ত আরেকটু কম হলে ভালো হতো। সে আর কী-ই বা করা যাবে!
বিবর্তন – আদি যুদ্ধ, আদি প্রেম
জয়ন্ত দাস
গাঙচিল
দাম – ৫০০ টাকা