আজ ষষ্ঠী। বাইরে ঢাক বাজছে আর আমি খুপরিতে রোগী দেখছি। রোগী দেখায় বারবার ছন্দ কেটে যাচ্ছে। আজ রোগীও প্রচুর। ডেংগুর ভালোই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। জ্বর নিয়ে প্রচুর রোগী আসছেন। এছাড়াও পেটে ব্যথা, বমি, মাথা ঘোরা ইত্যাদি এমারজেন্সি সব ধরণের রোগীই আছেন। গৌর ইনজেকশন দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছে। কাল থেকে গৌর আবার আসবে না। ও ধুতি পরে, উত্তরীয় গায়ে পুরুত ঠাকুর হয়ে যাবে। প্রতিবছরই ও একটা দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করে। ষষ্ঠীর দিনটা ওর বাবা সামলে দেন।
দুর্গাপুজোর সময়টা আমি বহরমপুরে কাটাই। বহরমপুরে আমার শ্বশুরবাড়ি। বছরে এই একবারই সেখানে যাওয়া হয় । শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পুজোর চারদিন ধরে শুধু ঘুমাই। প্রথমবার গিয়ে এতো ঘুমিয়েছিলাম, শ্বশুরমশাই বলছিলেন, ‘কী রে রুপালী, ঐন্দ্রিলের কি শরীর খারাপ?’
রুপালী আমার উপর খুব রেগে গিয়েছিল। বলল, ‘বাড়িতে তো তুমি প্রায় সারা রাত জেগে থাকো। তারপরও সারা দিন রোগী দেখ। আর এখানে এসে এতো ঘুমাও কেন?’
বড় একটা হাই তুলে বললাম, ‘বহরমপুরে এলে আমার খালি ঘুম পায়।’
রুপালী বলল, ‘যাও যাও দিদির স্কুটারটা নিয়ে সানাই আর রানীকে ঠাকুর দেখিয়ে আনো।’
বললাম, ‘এখন বাইরে খুব রৌদ্র। বিকেলে যাব।’
‘বিকালে আর স্কুটার নিয়ে বের হতে পারবে না। বড্ড ভিড় হয়। দিনের বেলা ঘুরিয়ে আনো।’
অগত্যা দুজনকে নিয়ে বের হই। ঘুম ঘুম চোখে স্কুটার নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ঠাকুর দেখি। এবং ঘণ্টা দুয়েক পরে বাড়ি এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। এমন ঘুম কাতুরে জামাই সম্পর্কে রুপালীর বাবা মায়ের ধারণা নিশ্চয়ই খুব উচ্চ নয়।
এবছর রুপালী এখনও ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি। ফলে আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময়টা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। যা মনে হচ্ছে, শ্বশুর বাড়ি যদি যাওয়াও হয়, এক বা দুদিনের জন্য যাওয়া হবে। পুজোর সময়ের পাঁচটা দিনে আমি সারা বছরের ঘুমের কোটা পূরণ করি। এক- দু’দিনে আর কত ঘুমব।
যাই হোক, মনে বড় দুঃখ নিয়ে রোগী দেখছিলাম। একজন বয়স্ক মানুষ জ্বর নিয়ে দেখাতে এসেছেন। বললেন, ‘জ্বরের সাথে খুব কোমরে ব্যথা আর মাথা ব্যথা। মাথা তুলে বসতেই সমস্যা হচ্ছে। সর্দি কাশি তেমন নেই।’
সম্ভবত ডেংগুই হবে। ডেংগুর পরীক্ষা বেশ খরচ সাপেক্ষ। অনেকেই বাইরে করাতে পারেন না। তাদের সরকারি গ্রামীণ হাসপাতালে যেতে বলি। কিন্তু কাল রবিবার, পরশু অষ্টমী। সেদিনও আউটডোর বন্ধ থাকবে। ফলে পরীক্ষাও হবে না। এনাকে দেখে মনে হচ্ছে ইনি বাইরে পরীক্ষা করাতে পারবেন না। কী করা যায় ভাবছিলাম।
ওষুধ পত্র লিখতে লিখতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?‘
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার আবার বাড়ি। সারাজীবন এখানে ওখানে ভাড়া বাড়িতে খুপরি ঘরে কেটে গেল। এ জীবনে আমার কোনো বাড়ি নেই ডাক্তারবাবু।’
তারপর খানিকক্ষণ থেমে বললেন, ‘ভুল বললাম ডাক্তারবাবু। বাড়ি আমার আছে। গ্রামের নাম বললে চিনতে পারবেন না। কপোতাক্ষ নদীর ধারে একটা ছোটো গ্রাম। গ্রামে কাঁচা রাস্তা। গরুর গাড়ি আর নৌকা ছাড়া কোনো যানবাহন নেই। সেখানেই আমাদের নিজেদের বাড়ি। সে কতকাল আগের কথা। তবু যেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। মা উঠোনে রান্না করছেন। দিদি পাশে বসে মায়ের রান্না দেখছে। শরতের শুরু থেকেই কপোতাক্ষের দুই তীর কাশফুলে সাদা হয়ে যেত। চন্ডীমন্ডবে ঠাকুর গড়তেন হারুকাকা।’
গৌর উঁকি মেরে বলল, ‘একজন পেটের ব্যথায় ছটফট করছে। যদি একবার দেখে দেন, তাহলে ইনজেকশন গুলো দিয়ে দি।‘
কঠিন বাস্তবের আঘাতে ভদ্রলোকের নস্টালজিয়া কেটে গেল। লজ্জিত ভাবে হেসে বললেন, ‘দুঃখিত ডাক্তারবাবু, অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেললাম।’
আমি বললাম, ‘না না উল্টোপাল্টা কেন হবে। আমার তো শুনতে ভালোই লাগছিল।‘
রোগী দেখতে দেখতে বুঝতে পারছিলাম, আমরা কতো সৌভাগ্যবান, যারা সারা জীবন নিজের বাড়িতে কাটাতে পারছি। যে বাড়িতে আমার শৈশবের স্মৃতি আছে, কৈশোরের ভালোলাগা আছে।
আর বুঝতে পারছিলাম কেন মেয়েরা বাপের বাড়ি যেতে এতো আগ্রহী হয়। দরকার হলে হাসপাতালে ডবল ডিউটি, এক্সট্রা নাইট করেও। একদিনের জন্য হলেও। কারণ সেটাই তাদের নিজের বাড়ি। যে বাড়িতে শৈশবের স্মৃতি নেই, সেই বাড়ি কোনোদিন কারো নিজের বাড়ি হয়ে ওঠে না। আর মানুষ সারাজীবন ধরে শুধু নিজের বাড়িতেই ফিরতে চায়।