২৩শে মার্চ ২০২০
বড্ড অসহায় লাগছে। এক এক করে জনপদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গোটা পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুদূত নিঃসাড়ে আসছে – আসছে। কখন শরীরে বাসা বাঁধবে টেরও পাবো না। ভয়ালতম ভিনগ্রহী সায়েন্স ফিকশনেও এভাবে গোটা পৃথিবী শেষ হওয়ার কথা ছিলো না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে ভয় পাচ্ছি। হয়তো জীবাণুরা সিঁড়ির রেলিং ধরে উঠে আসছে। জনশূন্য পথ। হাত ছোঁয়ালেই মৃত্যু। আস্তে আস্তে শ্বাসকষ্ট দমবন্ধ তারপর সব শেষ। হাসপাতালে আর বেড নেই। টিভিতে মৃত্যু এখন একটা সংখ্যা। ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া একটা সংখ্যা। আমার বাচ্চাদুটো আজও ভালো আছ। ফোনে কথা হয় । কতদিন দেখি না।
খাবার ফুরিয়ে এসেছে আর কতো দিন গৃহবন্দী থাকবো? কিন্তু আমি আক্রান্ত হলে আমার রক্তে আবার ঐ ভাইরাস নতুন জীবন পাবে। ঘরে থাকতেই হবে। উন্মাদ হয়ে গেলেও বেরোবো না। আমি আবার একটা পরিত্যক্তা সুন্দরী ভদ্রমহিলার দায়িত্ব নিয়েছি। সেও ঘরে থাকতে থাকতে বিরক্ত। অবশ্য তার খাওয়া নিয়ে ঝামেলা নেই কলাটা মূলোটা পেঁয়াজ যাই দিই খেয়ে নেয়। এখন সামনের পায়ে মুখ গুঁজে মৃদু সুরে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। ল্যাজ নেড়ে বলছে আমার সঙ্গে একটু খেলা করো।
রাস্তায় সারাদিন ধরে হয়তো খুব বেশী হলে তিনটে এমনি গাড়ি চলে। বাকী পুলিশের গাড়ি আর তীব্র শব্দে হুটার বাজানো মৃত্যুবাহন বা অ্যাম্বুলেন্স। অস্থির লাগছে। এতোটাই যে গান গাইতে ছবি আঁকতেও ইচ্ছে করছে না। সুন্দরী খেতে না পেয়েও খুব খুশি আছে। বোধহয় সারাদিন আমাকে কাছে পাচ্ছে বলে। কলা পেঁয়াজ খেয়েও খুশি থাকা সুন্দরীকে বুকে টেনে ঘুমিয়ে পড়বো। গোটা পৃথিবীতে ও’ই আমার কাছে থাকা একটা মাত্র জীবন্ত প্রাণী। সুন্দরী লেজ নেড়ে গাল চেটে আহ্লাদী আওয়াজ করে ঘুমিয়ে পড়লো।
২৪ শে মার্চ ২০২০
আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে সুন্দরী ব্যালকনিতে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য করলো। এবার খেতে চায়। ওর বিস্কুটও তো ফুরিয়ে এসেছে। দূরে কেউ ঘেউ ঘেউ করছে। সুন্দরী গ্রীলে সামনের পা তুলে দিয়ে র্যাডারের মতো করে কান মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শব্দের লোকেশন খুঁজছে। আজ একটা মাত্র ডিম পড়ে আছে। দুজনেই ডিম ভাত খেয়ে নেবো। এরপর শুধু নুন ভাত। তবুও বেরোবো না। মৃত্যুর মিছিলে নাম লেখাবো না।
টিভি মানেই কেবল সংখ্যা। মৃত্যুর সংখ্যা। তাই টিভি দেখি না। বরং সুন্দরীর সঙ্গে বল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলি। তিন চার দিন পরে আজ অভ্যেস বশে টিভিটা আবার চালালাম। দ্রুত বেগে জরুরী খবর স্ক্রোল করে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছাব্বিশ কোটি সাঁইত্রিশ লক্ষ। গোটা পৃথিবী জুড়ে ধ্বংস আর মৃত্যু। এর আগে একবার অতিমারীতে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। এবার রেকর্ড ভেঙে গেল। শেষকৃত্য করার জন্য লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। পচে যাওয়া দেহ থেকে আবার নতুন কোনও সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়ে রাষ্ট্রপ্রধানরা ভিডিও কনফারেন্সে ব্যস্ত।
তারপর হঠাৎ এলো স্ক্রিন জোড়া ব্রেকিং নিউজ গত চব্বিশ ঘন্টায় গোটা পৃথিবীতে আর নতুন কোনও সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় নি। এক লাফে টিভির সামনে গিয়ে বসলাম যেন সামনে এলে কিছু বেশী দেখতে পাবো। ভারতবর্ষের কোনও প্রান্ত থেকে আর নতুন কোনও সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় নি। বাকি পৃথিবীতেও আর কোনও নতুন সংক্রমণের খবর নেই। আমি সুন্দরীকে একবার ধাক্কা দিয়ে চিৎপাৎ ফেলে দিলাম। ও ভাবলো আজ ধাক্কাধাক্কি খেলা হবে। তীব্র ভাবে শাঁখের মতো করে হোউউউউ চিৎকার করে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমরা জিতে গেছি। বুঝলি আমাদের ঘরের ভেতর আটকে থাকার জন্যে জীবাণুরা কাউকে না পেয়ে বোধহয় পালিয়ে গেছে। সুন্দরী মনের স্ফূর্তিতে নিজের ল্যাজ নিজে খাও খেলায় ডুবে গেলো।