২২১ নম্বর ল্যাব। এই ঘরেই ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন বান্টিঙ। |
মে ১৯২১, দু’মাসের জন্য লন্ডনের চেম্বার বন্ধ রেখে, প্যানক্রিয়াস নির্যাস নিষ্কাশন করতে ম্যাক্লাউডের ল্যাবে এসে পৌঁছলেন বান্টিঙ। এই শহর তাঁর চেনা। তাঁর কলেজ জীবন কেটেছে এই টরন্টো শহরেই। চেনা পরিচয়ের সুবাদেই, বাড়ি ভাড়া পেতে বিশেষ অসুবিধা হলো না তাঁর। সপ্তাহে ২ কানাডিয়ন ডলারের বিনিময় একটা বাসা ভাড়া করলেন বান্টিঙ। পরদিনই হাজির হলেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কনট[ ১৬] মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিস্’এ[১৭]। দেখা করলেন ডা. ম্যাক্লাউডের সাথে। কথা মতো এখানেই গবেষণা শুরু করবেন বান্টিঙ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান হবার সুবাদে কনট মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিসের একটা বড় অংশের দায়িত্ব এখন ডা. ম্যাক্লাউডের হাতে। নিজের দায়িত্বে, গবেষণাগারের ২২১ নম্বর ঘরে বান্টিঙের গবেষণার বন্দোবস্ত করে দিলেন ডা. ম্যাক্লাউড। জোগাড় করে দিলেন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং রাসায়নিক পদার্থ। দিলেন পরীক্ষার মূল উপকরণ- কুকুর। বান্টিঙের জন্য ১০টা কুকুরের বন্দোবস্ত করে দিলেন ম্যাক্লাউড। এই ১০টা কুকুরকে ১০টা আলাদা আলাদা খাঁচায় রাখা হলো। ১০টা কুকুরের প্রত্যেকটাকে আলাদা আলাদা নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হলো। সেই ১০ কুকুর হলো- ৩৮৫, ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৮৯, ৩৯০, ৩৯১, ৩৯২, ৩৯৩, ৩৯৪ এবং ৩৯৯।
অভিজ্ঞ ম্যাক্লাউড ভালো করেই জানেন, বান্টিঙের একার পক্ষে এই পরীক্ষা চালু রাখা এক প্রকার অসম্ভবই। বান্টিঙকে সহায়তা করার জন্য একজন সহকারীর ব্যবস্থা করে দিলেন ম্যাক্লাউড। এই জন্য তাঁর দু’জন ছাত্রকে তলব করলেন তিনি। বেস্ট [১৮] এবং নোবেল [১৯] ছিলেন দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। বেস্ট ও নোবেলকে ডেকে বান্টিঙের পরীক্ষায় সামিল হওয়ার কথা জানালেন। জানালেন, এই পরীক্ষায় ঠিক কী ভাবে সাহায্য করতে হবে তাঁদের। তবে এক সাথে দুজনের সাহায্য করার দরকার নেই বলেই জানালেন তিনি। ঠিক হয়, মোট দু’মাস বা ৮ সপ্তাহের গবেষণার মধ্যে, প্রত্যেকে টানা চার সপ্তাহ করে সাহায্য করবেন বান্টিঙকে।
স্যরের কথায় রাজি হলেন বেস্ট ও নোবেল। কিন্তু প্রথমে কে সহযোগিতা করবেন বান্টিঙকে? দুই বন্ধু বললেন, কয়েন টস হোক। যে জিতবে সে আগে সাহায্য করবে বান্টিঙকে। হলো টস। জিতলেন বেস্ট। চুক্তি মোতাবেক স্থির হলো, গবেষণার প্রথম চার সপ্তাহ বান্টিঙকে সাহায্য করবেন বেস্ট। আর পরের চার সপ্তাহে বেস্টের বদলে নোবেল এসে কাজে যোগ দেবেন।
এই কয়েন টস প্রসঙ্গে বান্টিঙ পরে লিখেছেন, “মিঃ বেস্ট ও নোবেলকে [আমার] সহযোগী হিসেবে, প্রত্যেককে চার সপ্তাহের জন্য, নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রথম চার সপ্তাহ কে থাকবেন তা স্থির করার জন্য একটা কয়েন টস করেন তাঁরা এবং মিঃ বেস্ট টসে জেতেন। যদিও চার সপ্তাহ বাদে মিঃ নোবেল আর ফিরে আসেন নি এবং মিঃ বেস্ট আমার সাথে থেকে যান”।
দুই বন্ধু, চার্লস হার্বার্ট বেস্ট (বাঁদিকে) এবং এডওয়ার্ড ক্লার্ক নোবেল। |
চার সপ্তাহ বাদে কেন ফিরে আসেন নি নোবেল? ২৮শে অগস্ট ১৯৭১ সালে লেখা এক চিঠিতে, দীর্ঘ ৫০ বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করে নোবেল লিখেছেন, “বান্টিঙের সাথে কাজ করার জন্য বেস্ট ও আমি নিযুক্ত হয়েছিলাম দু মাসের জন্য … কে আগে কাজে যোগ দেবে তা স্থির করতে আমরা একটা কয়েন টস করেছিলাম, এবং চার্লস বেস্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এটা ঠিক করা হয়েছিল যে মাসান্তে আমরা পালা বদল করবো; যদিও যখন [আমার] সময় এলো, বেস্ট তখন ডা. বান্টিঙের শল্যবিদ্যায় সহযোগিতার কাজে অত্যন্ত সাবলীল হয়ে গিয়েছিলেন, সফল পরীক্ষার স্বার্থে পারস্পরিক বোঝা পড়া করে [আমরা] সহমত হই যে [গবেষণা] সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বেস্টই কাজটা চালু রাখবেন”।
কয়েন টস প্রসঙ্গে, ক্লার্ক নোবেলের ভাই রবার্ট লেইং নোবেল কিন্তু ভিন্ন এক কথা বলছেন। বিস্ময়কর এক বয়ানে রবার্ট লেইং নোবেল বলেছেন, “কয়েন টসে তাঁর ভাইই জিতে ছিলেন, কিন্তু কখনও বান্টিঙের নাম শোনেন নি বলে তাঁকে সাহায্য করতে অসম্মত হন এডওয়ার্ড নোবেল”।
কয়েন টসের মুখ্য চরিত্র বেস্ট আবার এই তিন বক্তার কারও সাথেই সহমত নন। কয়েন টস নিয়ে বিস্ফোরক এক বয়ানে বেস্ট বলেছেন, কয়েন টস হলো ‘টরন্টো স্টার’ [২০] পত্রিকার এক সাংবাদিকের কল্পিত কাহিনী। বেস্ট বলেছেন, সেই সময়ে নোবেলের স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। তাই ছুটিতে ছিলেন তিনি তখন। ১৯৫৪-৫৫ সালে, ‘হার্ডি বয়েজ’এর স্রষ্টা লেসলি ম্যাকফারলেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বেস্ট বলেন, “আমি স্বেচ্ছায় এই কাজের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম, কিছুর বিনিময় নয়, পরিবারিক কারণে আমার ডায়াবিটিসে আগ্রহ ছিল, আর কয়েক বছরের মধ্যে আমি নিজেই ডায়াবিটিস নিয়ে কাজ [শুরু] করতাম এবং ফ্রেড বান্টিঙ আমায় প্রভাবিত করেছিলেন। সেখানে কোনও কয়েন টস হয় নি”।
কয়েন টসের সাথে যুক্ত মূল চরিত্রদের এত পরস্পর বিরোধী মতামতের কারণে নির্দিষ্ট ভাবে বলা যায় না যে ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন ম্যাক্লাউডের ল্যাবরেটরিতে। তবে ইতিহাসের আরেক সাক্ষ্য বিবেচনা করলে, এই বিষয়ে কিছুটা স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি আমরা। সেই সাক্ষ্য মতে, বান্টিঙের কাজে সহযোগিতার আগেই নিজের এক সমস্যার কথা ম্যাক্লাউডকে জানিয়েছিলেন বেস্ট। এক মাস পর, জুনের মাঝামাঝি, একটা সেনা শিবিরে যোগদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন বেস্ট। যার অর্থ, সেই সময়ে মাত্র চার সপ্তাহের জন্যই ফাঁকা ছিলেন তিনি। তারপর ১৫ দিনের জন্য শিবিরে যোগ দিতে যেতে হবে তাঁকে। বেস্টের প্রতিবন্ধকতার কথা শুনে, পরবর্তী চার সপ্তাহের জন্য নোবেলকে নিযুক্ত করেন ম্যাক্লাউড। একথা ঠিক যে, বান্টিঙের গবেষণার কাজে নোবেল কোনো দিনও যুক্ত হন নি। আমরা দেখবো, সেনা শিবিরে যোগদান করার জন্য বান্টিঙের গবেষণা চলাকালীন ১৫ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন বেস্ট। এই সময়ে বান্টিঙ একাই সব দায়িত্ব সামলে ছিলেন। নোবেল সেই সময়ে গবেষণার কাজে যোগ দেন নি। এই ঘটনা ইতিহাস সমর্থিত। প্রশ্ন হলো, বেস্টের অনুপস্থিতিতে, সেই ১৫ দিন কেন গবেষণায় সাহায্য করেন নি নোবেল? তাহলে কি শরীর খারাপ ছিল বলে সেই সময়ে ছুটিতে ছিলেন নোবেল (বেস্টের বক্তব্য)? না কী অপরিচিত বান্টিঙকে সাহায্যে প্রস্তুত ছিলেন না নোবেল (ভাইয়ের বক্তব্য)? প্রকৃত ঘটনা যাই ঘটে থাকুক না কেন, কোনো সন্দেহ নেই যে ‘কয়েন টস’ আজও খুবই মুখোরোচক এক বিতর্কের বিষয়।
টস হোক বা না হোক, চার্লস বেস্টই শেষ পর্যন্ত বান্টিঙের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করলেন। ১৭শে মে ১৯২১,[২১] ম্যাক্লাউডের নেতৃত্বে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কনট ল্যাবে শুরু হলো পরীক্ষা। শুরুতেই একান্তে বেস্টকে ডেকে বান্টিঙ জিগেস করলেন, আপনি কি জানেন আমাকে সাহায্য করার জন্য একটা পয়সাও পাবেন না আপনি?
ঘাড় নেড়ে বেস্ট জানান, এ বিষয়ে অবগত আছেন তিনি।
আপনি কি জানেন আমার গবেষণায় যথেষ্ট আস্থাশীল নন ম্যাক্লাউড?
জানি, সংক্ষিপ্ত জবাব বেস্টের।
তাও আপনি সাহায্য করতে চান আমাকে?
নীরবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন বেস্ট।
পারিবারিক কারণে এবং ব্যক্তিগত আগ্রহ বশতই বান্টিঙের গবেষণায় আগাগোড়াই উৎসাহী ছিলেন বেস্ট, সে কথা আমরা আগেই জেনেছি। এহেন বেস্টের সহায়তায় শুরু হলো বান্টিঙের গবেষণা। ‘সার্জারি, গায়নেকলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স’ পত্রিকায় ডা. মোসেস ব্যারনের লেখা পড়ার পর, যে রকম ভেবেছিলেন বান্টিঙ, ঠিক সেই ভাবেই এগোবেন এখন তাঁরা। প্রথমেই অপারেশন করে কুকুরের প্যানক্রিয়াস নালি দুটো বেঁধে দেবেন। কুকুরটাকে ততদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা জরুরি যতদিন না পর্যন্ত তার প্যানক্রিয়াস কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কুকুরের প্যানক্রিয়াস কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে, কুকুরটাকে আবার অপারেশন করে তার পুরো প্যানক্রিয়াসটা কেটে নেবেন তাঁরা। এই নষ্ট হয়ে যাওয়া প্যানক্রিয়াসের অভ্যন্তরে তখনও সজীব অবস্থায়ই থাকবে আইলেটস্ অব ল্যাঙ্গারহান্স। কুকুরের সে সজীব আইলেটস থেকে ইনসুলিন নিষ্কাশন করবেন বান্টিঙ।
সেই মতো শুরু হলো কাজ। বান্টিঙ ও বেস্ট দায়িত্ব ভাগ করে নিলেন। কুকুরের পেটে সার্জারি করার মূল দায়িত্ব বান্টিঙের। কুকুরের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রক্ত ও মূত্রের নমুনায় শর্করা ও অন্যান্য পদার্থের উপস্থিতির পরীক্ষা এবং তার কালানুক্রমিক হিসাব রাখার দায়িত্ব বেস্টের। তবে ম্যাক্লাউড জানতেন, শল্যবিদ্যায় যতই পারদর্শী হন না কেন বান্টিঙ, কুকুরের প্যানক্রিয়াসের নালি বাঁধার মতো সূক্ষ কাজে তাঁর উপর ভরসা করা মুশকিল। প্রথম কুকুরের অপারেশনটা তাই নিজ হাতে করতে চান ম্যাক্লাউড। বরাদ্দকৃত কুকুরদের প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা নম্বর দেওয়াই ছিল। কুকুর নম্বর ৩৮৫কে দিয়ে শুরু হলো কাজ। অপারেশন টেবিলে তোলা হলো তাকে। অপারেশন করে, কুকুর ৩৮৫র প্যানক্রিয়াস নালি বেঁধে দিলেন ম্যাক্লাউড। পাশে দাঁড়িয়ে সমগ্র পদ্ধতিটা ভালো করে দেখে নিলেন বান্টিঙ। বান্টিঙ তখন এক স্বপ্নালোকে বিরাজ করছেন যেন। চিকিৎসক হিসেবে জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত মুহূর্তগুলোকে অতিক্রম করছেন তিনি। চরম উৎকন্ঠায় অতিবাহিত হচ্ছে তাঁর প্রতি মুহূর্ত। সাফল্যর দোরগোড়ায় এসে পড়েছেন তিনি। অনাগত সাফল্যের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন যেন। তাই ম্যাক্লাউডের অপারেশন পদ্ধতি একবার দেখা মাত্রই বুঝে গেছেন তিনি যে ঠিক কী ভাবে অপারেশন করতে হবে তাঁকে। কোনটার পর কোনটা করতে হবে, তা বুঝে নিতে কোনো অসুবিধা হয় নি তাঁর।
পরিকল্পনা মাফিক, পরবর্তী অপারেশনগুলোর সবকটাই করলেন বান্টিঙ। কুকুর নম্বর ৩৮৬কে দিয়ে অপারেশন শুরু করলেন বান্টিঙ ও বেস্ট। পরপর কয়েক দিন, বেশ কয়েকটা কুকুরের প্যানক্রিয়াসের নালিপথ বেঁধে দিলেন বান্টিঙ। শল্যবিদ হিসেবে অপারেশন টেবিলে বান্টিঙের দক্ষতা নিয়ে ম্যাক্লাউডের অনুমান সত্য হলো। এই অপারেশন করতে গিয়ে অতিরিক্ত আনাস্থেসিয়া প্রয়োগের ফলে মারা যায় একটা কুকুর। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে মারা যায় দ্বিতীয় আরেকটা কুকুর। তবে বাকি কুকুরদের প্যানক্রিয়াস নালি সফল ভাবে বেঁধে দিতে সক্ষম হলেন বান্টিঙ। অপারেশন টেবিলে সহযোগিতার পাশাপাশি, অপারেশনোত্তর কুকুরদের সুস্থ রাখা, নিয়মিত তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ জারি রেখেছেন বেস্ট। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কাজের দায়িত্বও আছে ম্যাক্লাউডের। ফলে প্রতিদিন অপারেশনের সময় আর সরাসরি হাজির থাকতে পারছেন না ম্যাক্লাউড। তবে প্রতিদিন কাজের রিপোর্ট রাখছেন তিনি। দিচ্ছেন সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নির্দেশও।
দিন ১৫ পর, জুনের প্রথম সপ্তাহে, ম্যাক্লাউড জানালেন মাস তিনেকের জন্য একবার দেশে যেতে হবে তাঁকে। দেশ মানে স্কটল্যান্ড। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সেপ্টেম্বর হবে। এর মধ্যে গবেষণার কাজ কী ভাবে চালু রাখতে হবে, বিস্তারিত ভাবে তা বুঝিয়ে দিলেন বান্টিঙ ও বেস্টকে। তাও যদি কোনো প্রয়োজন হয়, তাহলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত, অস্থায়ী ভাবে ভারপ্রাপ্ত ডা. ক্লারেন্স লেসলি স্টারের সাথে যেন যোগাযোগ রাখন তাঁরা। ডা. স্টার বান্টিঙের পূর্ব পরিচিত। ফলে ম্যাক্লাউড অনুপস্থিত থাকলেও, ডা. স্টারের সাহায্য নিয়ে কাজ করতে কোনো অসুবিধার মধ্যে পড়ার কথা নয় বান্টিঙের। নিজের দায়িত্ব বুঝিয়ে, ১৪ই জুন ১৯২১, স্কটল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন ম্যাক্লাউড।
(চলবে)
[১৬] কানাডার কোনো স্বাধীনতা দিবস নেই, কারণ এক অর্থে কানাডা কোনো স্বাধীন দেশ নয়। ইংলন্ডের রাজা/রানিই (বর্তমানে দ্বিতীয় এলিজাবেথ) কানাডার সর্বোচ্চ শাসক। রানির প্রতিনিধি হিসেবে (পরাধীন ভারতের মতো) গভর্নর জেনারেলই আজও কানাডা শাসন করে থাকেন (তবে কানাডায় স্বাধীন পার্লামেন্ট বর্তমান)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কানাডার গভর্নর জেনারেল ছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার তৃতীয় পুত্র আর্থার (১৮৫০-১৯৪২), যিনি আবার আয়ারল্যান্ডের কনট অঞ্চলের জমিদারও (ডিউক অব কনট) ছিলেন। গভর্নর জেনারেল আর্থার তথা ডিউক অব কনটের সম্মানে টরন্টোর ল্যাবরেটরির নামকরণ করা হয় ‘কনট মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিস্’ (একই কারণে দিল্লীর একটা অঞ্চলের নাম ‘কনট প্লেস’)।
[১৭] ১৯১৩ সাল নাগাদ, নিজের উদ্যোগে, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছন দিকে একটা গবেষণাগার ও গবেষণার জন্য পশু খামার নির্মাণ করেন ডা. জন জেরাল্ড ফিৎজেরাল্ড (১৮৮২-১৯৪০)। ১লা মে ১৯১৪, কিছু অনুদান সহ নিজের সমস্ত উদ্যোগ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করেন ডা. ফিৎজেরাল্ড। গবেষণাগারের নাম রাখা হয় ‘কনট এন্টিটক্সিন ল্যাবরেটরিস’। মূলত ডিপথেরিয়ার টীকা নিয়ে কাজ করে দ্রুত সাফল্য লাভ করে কনট এন্টিটক্সিন ল্যাবরেটরিস। কলেবরে বৃদ্ধি পেলে, নতুন আঙ্গিকে পুনর্বিন্যাস করা হয় ল্যাবরেটরিকে এবং ২৫শে অক্টোবর ১৯১৭ সালে গবেষণাগারের নতুন নাম রাখা হয়- ‘কনট মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিস্’। অলাভজনক সংস্থা থেকে লাভজনক সংস্থায় পরিণত করার লক্ষ্যে, ১৯৭২ সালে, ২ কোটি ৯০ লক্ষ ডলারের বিনিময় কনট মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিসকে কিনে নেয় ‘কানাডিয়ন ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন’। এই হস্তান্তরের পর গবেষণাগারের নতুন নাম হয় ‘কনট ফান্ড’। আরো কয়েক দফা হস্তান্তরের পর, বর্তমানে এই গবেষণাগারটি ‘সানোফি পাস্তুর’ নামে পরিচিত।
[১৮] অন্টারিয় প্রদেশের পেমব্রোক শহরের এক চিকিৎসক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন চার্লস হার্বার্ট বেস্ট (১৮৯৯-১৯৭৮)। পেমব্রোক শহরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠান্তে, উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯১৫ সালের শরৎকালে টরন্টো শহরে আসেন বেস্ট। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতেই সহপাঠী হিসেবে ক্লার্ক নোবেলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে তাঁর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ১৯১৮ সালের বসন্তকালে ৭০তম ‘হর্স আর্টিলারি’তে যোগদান করেন তিনি। ৩রা অক্টোবর ১৯১৮ সালে ‘সেকেন্ড কানাডিয়ন ট্যাঙ্ক ব্যাটেলিয়ন’এর সদস্য হিসেবে ইংলন্ড যান বেস্ট। ডিসেম্বর ১৯১৮ সালে কানাডায় ফিরে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চালু করেন তিনি। ফেব্রুয়ারি ১৯১৯, অষ্টাদশী মার্গারেট হুপার মাহোনের (১৯০০-১৯৮৮) সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর। ১৯২১ সালে ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন বেস্ট। ভর্তি হন ডাক্তারি কোর্সে। ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯২৪, মাহোন ও বেস্ট বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জুন ১৯২৫, ডাক্তারি পাশ করেন বেস্ট। ১৯২৯ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজওলজির বিভাগীয় প্রধান হিসাবে ম্যাক্লাউডের স্থলাভিসিক্ত হন বেস্ট। ১৯৩১ সালে কনট ল্যাবের ‘এসোশিয়েট ডিরেক্টর’ নিযুক্ত হন তিনি।
[১৯] ১৯১৫ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে ভর্তি সময় থেকেই চার্লস বেস্টের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে এডওয়ার্ড ক্লার্ক নোবেলের (১৯০০-১৯৭৮)। বান্টিঙের দলে শেষ পর্যন্ত ঠাঁই না পেলেও, ইনসুলিন নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা আছে নোবেলেরও। ইনসুলিনের সেই ঊষা লগ্নে ডায়াবিটিস ও ইনসুলিন নিয়ে দশটারও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের সহলেখক ছিলেন নোবেল। ১৯২২ সাল থেকে, বড় সামুদ্রিক মাছের প্যানক্রিয়াস থেকে বৃহৎ বাণিজ্যিক আকারে ইনসুলিন উৎপাদনে সচেষ্ট হন ম্যাক্লাউড। ম্যাক্লাউডের সেই উদ্যোগের প্রধান সহযোগী ছিলেন নোবেল। যদিও তাঁদের প্রয়াস শেষ পর্যন্ত চালু রাখতে পারেন নি তাঁরা, কারণ মাছেদের থেকে স্তন্যপায়ী (খরগোশ, কুকুর, বাছুর ইত্যাদি) প্রাণীদের প্যানক্রিয়াস থেকে সংগৃহীত ইনসুলিন অধিক ফলদায়ী বলে প্রমাণ হয়েছিল ততদিনে।
[২০] ৩রা নভেম্বর ১৮৯২ সালে ‘দ্য ইভনিং স্টার’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয় বর্তমান কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রচারিত পত্রিকা ‘দ্য টরন্টো স্টার’। ২৪শে জানুয়ারি ১৯০০ সালে ‘দ্য টরন্টো ডেইলি স্টার’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে পত্রিকাটি। ৬ই নভেম্বর ১৯৭১ সালে পত্রিকাটার নাম পরিবর্তন করে ‘দ্য টরন্টো স্টার’ রাখা হয়। ‘দ্য টরন্টো ডেইলি স্টার’কেই সংক্ষেপে টরন্টো স্টার বলে উল্লেখ করেছেন বেস্ট।
[২১] ১৬ই মে ১৯২১, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হয় বেস্টের। পরদিন থেকেই বান্টিঙের কাজে যোগ দেন বেস্ট।