একদা সঞ্ঝাকালে আমাদের শ্রীমৎ হাতুড়েবাবা গবাক্ষ পথে ধূম্রজাল রচনা করতঃ সন্ধ্যার মেঘমালা উপভোগ কচ্ছিলেন এবং সমধুর সুরে “ফুলের মতোন উঠুক ফুটে জিলিপির দল- আহা গরম গরম টক টক ঐ জিলিপিগুলি” গাইছিলেন। এমন সময় ধূমকেতুসম দিদিভাইয়ের আগমন ঘটলো। দরজা ছিলো অর্গল মুক্ত তাই দিদিভাইয়ের হাতের ধাক্কায় ধড়াম করে খুলে গেলো। হাতের প্যাকেট নামিয়ে বললো “এতে জিলিপি আছে। খেয়ে ঐ বীভৎস গান বন্ধ করো”।
কিন্তু হাতুড়ে যদি সুর করে “ভিজে বেড়াল ভিজে বেড়াল, তোমার বাড়ি যাবো” গানটা না করেন তাহলে ওনার সারমেয় সুন্দরী চান করতেই যায় না। কিন্তু সব কথা তো আর প্রকাশ্যে বলা যায় না। তাই উনি চুপপন্থা অবলম্বন করলেন।
দিদিভাই সগম্ভীরে বললো “আমি কবিরাজি করবো”
ভারি খুশি হয়ে হাতুড়ে বললো “আমি কবিরাজি ভালবাসি”। দিদিভাইয়ের রান্নার হাতটি যাকে বলে অতি উত্তম।
“আজ্ঞে না কাটলেট নয়। ওষুধ। গাছপালা ডালপালা শিকড়বাকড়। সেই কবে জীবক বলেছিলেন এ্যামন কোনও গাছ নেই যার কোনও ওষধিগুণ নেই। সেই থেকে আমি ভাবছি এলোপাথাড়ি ওষুধ আর খাবো না তাই এবার আয়ুর্বেদ। বুঝলে? সেটা নিয়ে আলোচনা করতেই এলাম। ভাবছি প্রেসারের ওষুধ বন্ধ করে আয়ুর্বেদ করবো। তোমার কি মত?”
হাতুড়ে কুড়মুড় কুড়মুড় করে জিলিপি খায় “অবশ্যই আছে। সর্পগন্ধা বা রাউল্ফিয়া সার্পেন্টিনা। এটা থেকে এক সময় রেসারপিন নামে একটা ওষুধ হতো। সম্ভাব্যরূপে অ্যাডালফিন নামে বিক্রি হতো”
দিদিভাই সকৌতুহলে প্রশ্ন করে “বন্ধই বা ক্যানো হলো আর গাছের গোটা গোটা পাতা খেলেই বা কি ক্ষতি? গোটা পাতাটাই তো আয়ুর্বেদিক ওষুধ তাই না?”
“তাহলে বলি?” বলে হাতুড়ে জিলিপি সহযোগে শুরু করেন “যে কোনও গাছে বা উদ্ভিদে কিছু কেমিক্যাল ইয়ে রাসায়নিক পদার্থ থাকে তাদের অ্যালকালয়েড বলে তারাই শরীরের নানা পরিবর্তন ঘটায়। সর্পগন্ধায় যে অ্যালকালয়েডগুলো থাকে তাদের নাম অ্যাজমালিন, অ্যাজমালিসিন, রেসারপিন আর সার্পেন্টাইন। এদের মধ্যে রেসারপিন প্রেসার কমায়। বাকিগুলো ক্ষতিকর।”
“তাহলে রেসারপিন উঠে গেলো ক্যানো?”
“আসলে দীর্ঘদিন ব্যবহার করার পরে দ্যাখা যাচ্ছিলো যে বা যারা রেসারপিন ব্যবহার করছে তাদের হার্টের রোগ মানে করোনারি আর্টারির বেশী ক্ষতি বেশী হচ্ছে – তারা হতাশায় বেশী আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের হৃদস্পন্দন উল্টোপাল্টা হচ্ছে – হাত পা ফুলে যাচ্ছে …..”
দিদিভাই আঁৎকে ওঠে “থাক থাক আর দরকার নেই। আমি বাবা রেসারপিন খাচ্ছি না…. কিন্তু কিডনি স্টোনে কুলত্থ কলাই চলবে না?”
“কুলত্থ কলাই” হাতুড়ে ব্রেনে সার্চ বাটন টিপে দিয়ে জিলিপি খেতে থাকে কুড়মুড় কুড়মুড়।
“শুধু জিলিপি খেলেই হবে? বাকিটা বলো”
“ডোলিকোজ বাইফ্লোরাস লিন”
হাতুড়ের ঘনাদা বচন শুনে দিদিভাই চটে কাঁই “হাবিজাবি না বকে যা জানতে চাইছি সেটা বলো”
পাঞ্জাবির হাতায় জিলিপির রস মুছতে মুছতে হাতুড়ে বলে “ক্কি জ্জ্বালা রে বাবা! সেটাই তো বলছি। এটা কুলত্থ কলাইয়ের ভালো নাম। এর প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় কুড়ি শতাংশ অর্থাৎ মুরগির মাংসের সমান সমান। জল এবং ফ্যাট আছে। এছাড়া আছে অ্যান্টিনিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর- হিমাগ্লুটিনিন এবং একটা প্রোটিয়েজ ইনহিবিটিং ফ্যাক্টর। কিডনি স্টোন …..কিডনি স্টোন ….কিডনি স্টোন….”
“আহা রেকারিং ডেসিমেল চালাচ্ছো ক্যানো?”
হাতুড়ে বিষ্মিত হয় “আমি আবার মেলগাড়ি কবে চালালাম? আর কিছু তথ্য কোথাও পাচ্ছি না। বাকি যা আছে সেগুলো লোককথা বা বলা যায় পরম্পরা। যে যা বিশ্বাস করে সেটাই বলে। চলন্তিকার মতোন এক এক দেশে এক এক রকম চলতেই থাকে”
দিদিভাই কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। উনি অবশ্যি বেশীক্ষণ গুমরোনোর মতো মানুষই নন। আবার প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করে । “তাইলে হার্টের জন্য কি গাছ আছে?”
হাতুড়ের এটা জানা কোশ্চেন। ফ উত্তর দ্যায় “ডিজিট্যালিস ল্যানেটা আর ডিজিট্যালিস পার্প্যুরা”
“কোথায় পাবো সেই গাছ?”
“সাধারণভাবে ব্রাজিল আর দক্ষিণ আমেরিকায়”
“এর থেকে ওষুধ তৈরি হয়?”
“বিলক্ষণ হয়। চমৎকার হয়। ডিজিট্যালিস বাজারে ল্যানোক্সিন নামে পাওয়া যায়। ওটার ডিজিট্যালিস অংশটা হার্টের পেশী শক্তিশালী করে। প্রেসার বাড়ায়। কিন্তু হার্ট ব্লক করে। হৃদস্পন্দন অনিয়মিত করে দ্যায় তাই এর ব্যবহার কমে গ্যাছে। এতে অন্য যে সব কেমিক্যাল থাকে সেগুলো হলো ল্যানাটোসাইড সি, আর ডিগোক্সিজেন”
দিদিভাই স্পষ্টতই বিরক্ত হয় “দ্ধুর যতো সব হাবিজাবি। আমাদের নিমগাছের সম্বন্ধে এলোপাথাড়ি কি বলছে শুনি? নিম তো খুব উপকারী ….”
হাতুড়ে টাকে সদ্য গজানো সিকি ইঞ্চি পাকা চুল চুলকোতে থাকে।
“চুলের এই অবস্থা কি করে হলো?”
“নিজে নিজে চুল কাটতে গিয়ে….” সঙ্কুচিত হাতুড়ে।
“আবার?” দিদিভাই বিষ্মিত বেশী না ক্রুদ্ধ বেশী সেটা বোঝা যায় না। আসলে হাতুড়ে নিজের দাঁত নিজে তোলো এই নীতিতে ভয়ানক রক্তপাত ঘটিয়ে হাসপাতালে গেছিলো তাই সবাই একটু ইয়ে করে।
হাতুড়ে প্রসঙ্গান্তরে যায় “অ্যাজাডিরেক্টা ইন্ডিকা? মানে নিম। নিমের রস চামড়া ও জিনিসপত্রের জীবাণুনিরোধক হিসেবে চমৎকার তবে এটা খুব ভালো স্পার্মিসাইডাল অর্থাৎ শুক্রাণু ধ্বংসকারী। এটা একটা নির্দিষ্ট মাপের বেশী মাত্রায় খেলে বীর্য শুক্রাণু শূন্য হয়ে যাবে। আবার টেস্টোস্টেরন হর্মোনও কমে যেতে পারে। গুরুদেব হয়তো তাই নিয়মিত নিমপাতার রস পান করতেন। অবশ্যি এটা আমার নিজস্ব ধারণা”।
“আর জীবক? ও যে বললো…..?” দিদিভাইয়ের চোখে অবাক বিষ্ময় থৈথৈ করে।
“এক জীবনে একার পক্ষে তো ভারতের সব গাছপালার গুণাগুণ বিচার করা সম্ভব নয় তাই উনি স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস আর লোককথা শুনে শুনে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। আমরা তো প্রমাণ-নির্ভর চিকিৎসা করি … এবং তখন তো গবেষণা কেন্দ্র বা ল্যাবরে… মানে পরীক্ষাগারও ছিলো না” হাতুড়ের মুখ আর হাত জিলিপি ধ্বংস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে “তবে তথ্য বলে উদ্ভিজ্জ বিষের তালিকায় হেমলকের পরে পরেই ধুতুরা আর কলকে ফলের স্থান- যদিও ধুতুরার নির্যাস থেকেই জীবনদায়ী অ্যাট্রোপিন তৈরি হয় কিন্তু গোটা ফল? নৈব নৈব চ।”
দিদিভাই বড়ো ব্যথিত চিত্তে বিদায় নিচ্ছিলো। অবশিষ্ট জিলিপি খেতে খেতে হাতুড়ে প্রশ্ন করলো “আচ্ছা দিদিভাই (কুড়মুড় কুড়মুড়) পেঁয়াজকলি আমিষ না নিরামিষ?”
অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি হেনে দিদিভাই আয়ুর্বেদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদায় নেয়।
(আরও ঢের ঢের গাছ নিয়ে ঢের ঢের কথা বলার ছিলো। তবে সর্বংলিহ এলোপাথাড়ি বিদ্যা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন ইসবগুলকে দিব্যি গোটাগুটিই আত্মীকরণ করেছে।)
চমৎকার লেখা।
গুরুদেবের নিমপাতার রস খাওয়ার পেছনে গূঢ় কারণ বিষয়ে লেখকের অনুমানটা দারুণ।
খুব খুউউব ভালো লেখা। খেটে লেখা, অথচ হাল্কা চালে – কাজটা দুরূহ। কিন্তু, লেখক অনায়াসেই সেটি করতে পেরেছেন।
ধন্যবাদ । গুরুদেবের গূঢ় খবরটা আন্দাজপ্রসূত তবে কার্যকারণ ওনার জ্ঞানের পরিধি জানা থাকলে মনে হয় আন্দাজ সঠিক ।
আর দ্বিতীয়তঃ আমি গুরুতর কিছু লিখতেই পারি না । সবটাই ক্যামন ফক্কুড়ি মার্কা হয়ে যায় ।
সেটুকুই বা কম কি ? হাসুক সবাই । মন নির্মল থাকবে ।
আপ্লুত