রবিবার ভোর ৬টা। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। তাও আবার শীতকালে। কিন্তু ফোন বাজলে উঠতেই হয়। যদি শুধু নম্বর উঠত, ফোনটা সাইলেন্ট করে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতাম। কিন্তু পেশেন্টের নাম পাশে লেখা এ এন সি। মানে পেশেন্ট প্রেগন্যান্ট। হয়তো জল ভাংছে, ব্যথা উঠেছে। ফোন ধরলাম।
-স্যার, আজকেও বেরল না। কত চেষ্টা করলাম। এবার না বেরলে মারা যাব।
-কিন্তু বাচ্চা বেরনোর সময় আছে। ঠিক সময় সে বেরিয়ে যাবে। না হলে সিজার করে দেব। অত চিন্তা কোর না।
-না স্যার বাচ্চা নয় পটি। ৩ দিন হয়নি। আপনার ওষুধও কাজ করছে না।
মনে মনে ভাবছি তার জন্য রোববার ভোর ৬ টায় ফোন। কিন্তু মা জননী এত আবেগ নিয়ে বেগ না আসার কথা বলছিল যে আমি রাগ করতে পারলাম না। ওষুধ বলে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমতে ঘুমতে স্বপ্ন দেখলাম এক কুয়াশা ঢাকা বলে রেল লাইনের পাশে বসে উবু হয়ে বসে প্রাকৃতিক শোভা দেখছি।
আজ চেম্বার করতে হবে। করোনার ব্যাকলগ ক্লিয়ার করতে হবে। সকালেই শিখেছি কোনোকিছু বেশিদিন আটকে রাখা ভালো না। লিফটে নামছি। ১৪ তলা থেকে দুটো ছেলে উঠল। বছর ৮-৯ বয়স। একজন মাস্ক পরে অন্যজন না পরে। হাতে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট। মাস্ক না পরা জন টি শার্ট পরা। সেটা উচু করে নাক, মুখ ঢেকে বলল, তুই আমার মাস্ক আনিস নি?
ছোট জন বলল, স্যরি ভুলে গেছি। তুই আমারটা পরে নে।
-ধ্যাত বুদ্ধু, তাই হয় নাকি!
লিফিট গ্রাউন্ড ফ্লোরে থামলে আমি বেরিয়ে এলাম। বাচ্চাগুলো আবার ওপরে উঠে গেল মাস্ক পরতে। ছোটদের থেকেও কত কিছু শেখা যায়।
আজকের শেষ রুগী এক বৃদ্ধা । বয়স ৮০ এর কাছাকাছি। বয়স তাঁকে চেষ্টা করেও ছুঁতে পারেনি। লকডাউনের পর আজ প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। সুন্দর করে সেজে এসেছিল। সঙ্গে নাতি। চেম্বারে ঢুকে ৬ ফুট দূরের চেয়ারে বসলেন। কী বলে ওনাকে ডাকব ভাবতে গিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল মাসিমা…
– কী সমস্যা মাসিমা?
– বুঝলে গোপাল খালি মনে হয় নীচে দিয়ে সব বেরিয়ে আসবে।
ওনার সমস্যার কী কী সমাধান আছে বোঝাচ্ছিলাম। কিন্তু কানে একটা শব্দই বাজছে- গোপাল, গোপাল। ডাক্তার, ডাক্তারবাবু, স্যার, কাকু, ডাকাত, শালা অনেক কিছু শুনেছি। গোপাল এই প্রথম। মোগ্যাম্বোও মনে হয় কোনোদিন এত ‘খুশ’ হয়নি। তা আমার সদ্য পাওয়া মাসিমা যাওয়ার সময় আমার টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন। নাতি হা হা করে উঠল। ডাক্তারবাবুর কাছে যেও না। করোনার সময় কাছে যাওয়া বারণ।
– তুই থাম তো।
-গোপাল, মাথাটা নীচু করোতো। তোমার মাথায় গুরুমন্ত্রটা পড়ে নিই। তোমাকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখবে। করোনা ধারেকাছে আসতে পারবে না।
আমি মাথা নীচু করলাম। উনি আমার মাথায় হাত রেখে জপ করতে লাগলেন।
তাঁর মন্ত্র শুনে আমিও অবাক। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমিও বলছি-
ওহে দয়াময়, নিখিল- আশ্রয়, এ ধরা পানে চাও
পতিত যে জন করিছে রোদন, পতিত পাবন তাহারে উঠাও
মরণ যে জন করিছে বরণ তাহারে বাঁচাও।
কত দুঃখ শোক, কাঁদে কত লোক, নয়ন মুছাও।
আজ আমার আর এক গুরুদেব শিব্রামের জন্মদিন। প্রণাম গুরুদেব।
ছবি: Ajoy Biswas এর দেওয়াল থেকে নেওয়া। অজয় খুব ভালো ছবি তোলে, ওর বেনারসের ছবিগুলো আমার বিশেষ প্রিয়।