এই গল্পটা আজ কেন বলছি তার বিশেষ কোনো কারণ নেই, জাস্ট ইচ্ছা হলো তাই। বছর দুই আগে জুন মাসে একখানা বিপ্লব হয়েছিল বাংলার বুকে, যার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সারা ভারতে, এমনকি ভারতের বাইরেও। আজ যদিও সেই বিপ্লবের কোনো মাহাত্ম্যই হয়তো নেই। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ডাক্তারেরা আজও নিগৃহীত, এমনকি এই মহামারীর পরেও। সেদিনের মহানায়ক ইসলামোফোবিক আলোচনায় বিশ্বাসী। সেদিনের বৃথা আশ্বাসগুলো আজ নবান্নের প্রেক্ষাগৃহে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। সেদিনের পরেও ডাক্তারদের একটা বড় অংশ আজও শাসকদলের সমর্থন করেন, গত নির্বাচনে ভোটও দিয়েছেন নিশ্চয়ই। মোটমাট আমাদের সেই বিপ্লবের কোনো প্রভাবই আজ আর নাই।
কিন্তু আন্দোলনটা মিথ্যা নয়, সেটা হয়েছিল। প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে চলেছিল এবং সেই আন্দোলন ভেস্তে দেওয়ার জন্য হাজারো প্রচেষ্টা হয়েছে। কখনো রাজনৈতিক রং লাগানো হয়েছে, কখনো পুলিশ লাগানো হয়েছে, কখনো গুণ্ডা-মস্তান। বিভিন্ন কলেজ থেকে বিভিন্ন খবর আমরা পেয়েছিলাম, সেই অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। হস্টেলে কোনো অর্ডার, কোনো খাবার আনানো বা অন্য কোনোভাবে কোনো বাইরের মানুষের প্রবেশ যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়েছিল। কোনো রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া একটা আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না, সেটা সম্ভব হয়েছিল বিচক্ষণ নেতৃত্ব আর সাধারণ মানুষের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের জন্য।
যাইহোক এর মাঝেই একদিন উনি নীলরতনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পথ ভুলে পিজি-তে চলে আসেন এবং কিছু প্ৰি-প্লানড নাটক, মিডিয়া বাইট সেরে বেরিয়ে পড়েন। তখন আমাদের গোটা কলেজটা এমার্জেন্সির সামনে, যদিও এমার্জেন্সির গেট কখনোই আটকানো হয়নি। হঠাৎ এক সময় পুলিশ ঘোষণা করে অবিলম্বে এই জায়গা খালি না করলে তারা ব্যবস্থা নেবে। কিছুক্ষণ পরে আমাদের ভিড়ে কিছু অচেনা লোকজনেরও দেখা পাওয়া যায়, তাদের উদ্দেশ্য ঠিক কী বোঝা যাচ্ছিল না। যে কোনো সময় কিছু অঘটন ঘটতে পারে আঁচ করে আমরা একাডেমিক বিল্ডিং-র দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। যুদ্ধে এগোনো যেমন দরকার, প্রয়োজনে পিছিয়ে আসাও জরুরি।
যাইহোক, সবাই সেই কথা শুনে জায়গা ছেড়ে দিলেও একজন ইন্টার্ন পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে একা দাঁড়িয়ে, তার নামটা না বলাই থাক। গোটা চত্বর প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে, প্ল্যাকার্ড হাতে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় একা সে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে- একটা সাধারণ মেয়ে, একজন সাধারণ জুনিয়র ডাক্তার। তাকে ডেকে আনতে গেলাম, সে বলে, “দাদা আমরা কেন পেছনে হটবো! আমরা আমাদের জায়গা ছেড়ে কেন যাবো!!” ব্যারিকেডের ওপারে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী, পেছনে সেই ‘অচেনা লোকজন’- তাকে এত কিছু বোঝানোর সময় ছিল না। “পরে সব আলোচনা হবে, এখন চল”, বলে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম।
নাহ, এই মেয়েকে কেউ চেনে না; ‘white revolution’-র মুখ সে নয়; সে নবান্নে গিয়ে হাসপাতালে অটো স্ট্যান্ড, কোলাপ্সিবল গেট, ডেন্টাল এম্বুলেন্সের কথা বলেনি; সে শীতল চোখে ‘আমরা পদবি দেখে চিকিৎসা করিনা’ বলে সুপার হিরোও হয়নি- কিন্তু আমার কাছে ‘মিছিলের মুখ’ সেই মেয়েটাই, ডাক্তার সমাজের শিরদাঁড়ার প্রতীক সেই মেয়েটাই। যতদিন এই আন্দোলনের কথা মনে পড়বে, এই ঘটনাটাই আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ??
দারুন, দারুন। খুব ভালো লেখা।