???️?️????️?
আমাদের রাতজাগা হাতুড়ে ডাক্তার ভোররাতে বিমলবাবুর দোকানে প্রথম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সূর্যকে ঘুম থেকে তুলে ডিউটিতে পাঠিয়ে দেন। সে ঘুমভাঙা লাল চোখে উঁকিঝুঁকি মেরে কাজে যোগ দেয়। ঠিক এই সময়েই নিধিরাম সর্দার সাইকেলে করে আসে। সেই দূর হেলা বটতলা থেকে। এসে বিমলবাবুর থেকে ছোট এক ভাঁড় চা আর একটা খাস্তা বিস্কুট খেয়ে অপেক্ষা করে এই চৌমাথার চা দোকানে। ও যেখানে কাজ করে, ওর ঠিকাদার ওকে সেখানে নিয়ে যায়। বেশীরভাগ দিনই একটা লজ্ঝরে ট্রাক আসে। নিধিরাম সাইকেলটা তাতে তুলে নিয়ে পেছনে মাল রাখার জায়গায় বসে কাজে চলে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেকার হাতুড়ের সঙ্গে তার দিব্য জমে যায়। একবার তো হাতুড়ে নিজের আদ্যিকালের বাজাজ কাব স্কুটার চেপে নিধিরামের বাড়িও চলে গেছিলেন। সেদিন দুপুরে জমাটি ভোজ। মনোজের দোকানের ডিমের ঝোল ল্যাটপ্যাটে ঘ্যাঁট আর জলডালের চে’ ঢের ভালো খাওয়া হোলো। বেগুনের বোঁটা আর মটরশুঁটির খোসার কাটলেট (অমৃত – এমনটি হাতুড়ে আগে কক্ষোনো খান নি), আলু কুমড়ো আর বেগুনের মিক্সড ভাজা। চারা পোনার ঝালঝাল ঝোল। সে এক অপূর্ব দাওয়াত।
লক ডাউনে আর নিধিরামের কোনও খোঁজ নেই। কতো মানুষই তো এই সঙ্কটকালে হারিয়ে গেছে। ঢাল তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম আর কীই বা লড়বে? একদিন ঘুমন্ত সূর্যকে কাজে পাঠিয়ে হাতুড়ে বসে আছেন দুনম্বরী চা হাতে। একই ভাঁড়ে দুবার চা নিলে সত্তর পয়সা কম হওয়ার কথা– কিন্তু নির্বিকার বিমলবাবু পঞ্চাশ পয়সা মাত্র ছাড় দেন। এমন সময় বাবার লটপটে সাইকেল চালিয়ে কৌশিক এলো। নিধিরামের সন্তান। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে একটা একটা মুদির দোকানে চাকরি করে। বাবার মতোন দিন আনি দিন খাই নয়। মাস গেলে মাইনে। শত হলেও একবারেই সেকেন্ড ডিভিশন পাওয়া ছেলে!
এসে হাতুড়ে কিছু বোঝার আগেই ঢিব করে একটা প্রণাম “জেঠু বাবার খুব শলীলডা খারাপ তুমি যদি একবার ….”
হাতুড়ে ভয় পান। সময় বড়ো খারাপ। করোনায় ছেয়ে গেছে দেশ কী জানি বেচারার কী আবার হলো ….
বাড়ি গিয়ে কাঁধে রোগী দেখার ঝোলা নিয়ে ক্যাঁটক্যাঁটে সবুজ রংয়ের ঘটঘটে স্কুটারে চেপে কৌশিকের পাশে পাশে চললেন নিধিরাম সর্দারের বাড়ি।
নিধিরামের মেয়ে ঝিলিক দরজায় দাঁড়িয়ে। শাড়ি দিয়ে তৈরি পরদা সরিয়ে নীরবে বললো এসো জেঠু। বিছানার পাশে একটা ছোট্ট জানালা। গোটা ঘরে জ্বর আর ঘামে মেশানো একটা গন্ধ। নিধিরাম হাতুড়েকে দেখে হাসলো। নিশ্চিন্তির হাসি। এসেছে তাহলে। এবার সেরে যাবো। “মুখে সোয়াদ নেই গো – গন্ধও নাগছে না নাকে”
নিধিরামের সর্দারনী সরমা বললো “দাদা মানুষটার বড্ড জ্বর– খেতে পারছে নাকো– মুখেতে স্বাদ নাগছে না ..দাদা তুমিই এখন …” মুখে আঁচল চাপা দেয়।
হাতুড়ে ভালো করে জিগ্গেস করেন– বোঝেন নিধিরাম তার মুখের স্বাদ–নাকের গন্ধ দুটোই হারিয়েছে। নাড়ি ধরতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খেলেন- পুড়ে যাচ্ছে গা। এদের থার্মোমিটারের কথা বলা আর ফোগলাকে হাড় চিবোতে বলা একই কথা। এক গাল হেসে বলবে আমি কি আর ওসব পারি গো? নাড়ি অতি দ্রুত – ক্ষীণ। ভালো করে স্টেথোস্কোপে বুকের শব্দ শোনেন। সেই কৈশোরে শেখা বিদ্যে। কোথাও যেন একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে। মেঘে ঢাকা আকাশে যেমন মেঘের ডাক ছড়িয়ে পড়ে– এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
“নিধিরাম তোমাকে একবার হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসতে হবে .. কয়েকটা পরীক্ষা করা হবে …”
নিধিরাম শরীরের সব শক্তি দিয়ে সরমার কব্জি চেপে ধরে। রক্তহীন সরমার হাত আরও ফ্যাকাশে হয়ে আসে ।
“ঘুরে আমি আর আসবো না দাদা …” নিধিরাম হাঁফায়– “কাউরে ওখানে ঢুকতে দেবে না– তুমি এখেনেই পরীক্ষা করায়ে নাও- যা লাগে যত লাগে…”, সরমা মৃদু স্বরে বলে– হাওয়ায় ভেসে আসে ওর কথা “ওখানেও তো শুনতেছি সকলের পরীক্ষে টরীক্ষে করতেছে না দাদা। তুমি আমার মানুষটাকে সারায়ে দাও”
“হায় রে সরমা আমি সারাবার কে? না আমার হাতে কিছু আছে? একটা রক্ত পরীক্ষাও আমার লেখায় হবে না রে”….হাতুড়ে স্বগতোক্তি করেন।
হাতুড়ে ব্যাগ খুলে খুব প্রাথমিক কিছু রক্ত পরীক্ষা – ওষুধ বিষুধ লিখে দ্যান। তারপর আবার বাজাজ কাবে করে সোজা মনোজের দোকান।
আজ যেন মনোজের রান্নাটা আরোই বিস্বাদ। কিছু বলাও যাবে না। মদন মারা যাওয়ার পর ছোটো বেলায় মেনিঞ্জাইটিস হওয়া নির্বোধ ছেলে মনোজই দোকানটা চালায়। ওর বিয়েও হয়েছে। একটা মেয়েও আছে। গোটা ব্যাপারটাই হাতুড়ের কাছে হাস্যকর রকম বিস্বাদ লাগে।
দিন চলে যায়। দিন চলে যায়। চারটে দিন চলে গেছে নিধিরামের কোনও খবর নেই। লক ডাউনে বিকেলে চায়ের দোকান বন্ধ। নিজের হাতে চা বানানোও ভারি ঝঞ্ঝাট। চা পাতাটা আবার পরিষ্কার করে তোলা। ময়লার গাড়িতে ফ্যালা। মহা মুশকিল। হাতুড়ে চা খেয়ে কাপ ধুয়ে বিমলবাবুর দোকানের বেঞ্চিতে আসীন হয়েছেন। পচা খাল থেকে ঝড়ে উপড়ে আসা ডালপালা পচার গন্ধ আসে। হাতুড়ের বড়ো মন খারাপ লাগে। হারিয়ে যাওয়া অ্যান্টেনাদের জন্য – অ্যান্টেনায় বসে শয়ে শয়ে কাকের সভার জন্য।
এমন সময় কৌশিক এলো। হাতে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট। মুখে আষাঢ়ের মেঘ। রিপোর্ট বলছে রক্তে নিউট্রোফিল অনেক বেশী। কৌশিক বললো “চারদিন পরে রিপোর্ট পেলাম– লক ডাউন তো। জেঠু বাবার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে– শ্বাস উঠেছে.. তুমি একবার চলো …”
আবার সেই গলির মধ্যে ঘর। আবার সেই ম্লান মুখের ঝিলিক। আবার সেই আবাহন এসো জেঠু। না আজ আর নিধিরাম হাসে নি। আজ হাপরের মতো বুকটা উঠছে নামছে। চোখ আধবোজা।
“কি হয়েছে দাদা? রিপোর্ট কি ভালো?”
হাতুড়ে মাথা নাড়েন।
লাজুক ঝিলিক লজ্জার মাথা খেয়ে প্রশ্ন করে “জেঠু কি হয়েছে? করোনা?”
হাতুড়ে উত্তর না দিয়ে ব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট যন্ত্র বার করেন। বোতাম টিপে চালু করে নিধিরামের আঙ্গুলে লাগিয়ে দ্যান। একটু পিঁক পিঁক শব্দ করে দুটো সংখ্যা ফুটে ওঠে। পালস একশো চল্লিশ আর রক্তে অক্সিজেন মাত্র বাষঠটি। হাতুড়ে স্তব্ধ বসে থাকেন। এক পা এক পা করে মৃত্যু আসছে। ঐ যেন শুনি চরণধ্বণি রে। সে আসে… . সে আসে ….ধীর নিশ্চিত চরণে …..
“নিধিরাম চলো তুমি হাসপাতালে চলো .. আমি তোমাকে নিয়ে আসবো সঙ্গে করে …”
“আমার মরা শলীলডা?” নিধিরাম হাঁফায়।
“কি হয়েছে? রিপোর্ট কি খারাপ? খুব খারাপ?” সরমার চোখ থেকে ওর উঁচু হওয়ে ওঠা গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। পড়তেই থাকে।
“সরমা …কৌশিক শোনো নিধিরামের সম্ভবতঃ করোনা হয়েছে। শ্বাসকষ্ট জ্বর স্বাদ গন্ধ চলে যাওয়া … এগুলো সবই …”
কৌশিক ভূমিনিবদ্ধ চোখে বলে “করোনার পরীক্ষা তো হয় নি..তাহলে?”
হাতুড়ে কৌশিকের মাথায় হাত রাখেন “এই রোগে রক্তে ভাইরাস ঢুকলে প্রথমে আমাদের শরীরের রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আসল যারা সেনাপতি তাদের বুদ্ধি* নষ্ট করে দেয়। পড়ে থাকে মারকুটে মাথামোটা সৈনিক- নিউট্রোফিল। এদের কাজ সেনাপতির কথা অনুযায়ী জীবাণুদের মারা– করোনায় যখন সেনাপতি ঠিক মতো কাজ করে না এরা সেই সময় হুহু করে বাড়তে থাকে। যেটা তোদের বাবার হয়েছে। এই নিউট্রোফিল সংখ্যায় বেশী হলে শুধু জীবাণু নয় শরীরের সুস্থ সব কোষকে ধ্বংস করে দেয়। প্রথম ফুসফুসের। তারপর হার্ট কিডনি– এক এক করে। চল আমরা সবাই মিলে নিধিরামকে হাসপাতালে নিয়ে যাই”
নিধিরাম অস্ফুটে কাৎরায়, “এ কোন দ্যাশে জনম দিলি বাপ? আমি এই দেশে থাকতাম না। এখেনে রক্ত পরীক্ষে হবে না। হাসপাতালেও হবে কিনা তাও জানতাম না”।
ও দরদী রে আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় উঠতাম না। নিধিরাম মনোজ তোরা কোন দেশে কোন নৌকায় করে জীবন তরণী পার হতিস রে? এই তো তোদের স্বাধীন কপাল। চরম অবিশ্বাসী হাতুড়ে কপালে হাত দেন। নিধিরাম হাসপাতালে যাবে না। ঝিলিক বাবার মাথায় হাত বোলায়।
নতমুখী শক্তপোক্ত কৌশিক বলে “বাবা আমাদের কাছেই মরবে” ওর চোয়ালের শক্ত হয়ে ওঠে।
সরমা হাতুড়ের হাত ধরে রেখেছে- শক্ত করে। “দাদা যা হবে চোখের সামনেই হতি দাও– ওর তো কিছু না-ও তো হতি পারে। গেলিও তো চিকিচ্ছে পাবে কি না … তুমি তো জানো দাদা..…” সরমার সরু আঙ্গুলে এতো জোর?
হাতুড়ে বাইরে বসে ফ্লেক ধরান। একটা গাছে একপাল শালিক গিন্নী আড্ডা মারছে। এক জোড়া ফিঙে তারে বসে শিস দিচ্ছে। সবে দোসাওয়ালা টং টং ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেল। নিধিরামও চলে গেল। সেই দেশে সেই বাড়িতে যেখানে মাঝপথে নাও ডুইব্যা যায় না। সেই দূর মেঘের দেশে তার সেই বাড়ি। লাল সুড়কির পথ চলে যায় কতোদূর? আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যএ দেয় পাড়ি ।
করোনার হিসেবে নিধিরাম সর্দারের নাম নেই।
*তথ্য – ডাক্তার অনির্বাণ দত্ত ।
অসাধারণ!
ধন্যবাদ